বাংলা কলা (দিলবর তাউসের অপ্রকাশিত গল্প)
আমার বন্ধু দিলবর তাউস ২০০৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ। তার বউ সাবিনা সুলতানা দুই বছর অপেক্ষা করার পর ২০১০ সালের শেষের দিকে আবার বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে কানাডা চলে গেছে। তারপর থেকে সাবিনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুধু ভার্চ্যুয়াল: ফেসবুকে আমরা পরস্পরের বন্ধু। সে আমার কোনো কোনো স্ট্যাটাসে 'লাইক' চিহ্ন দেয়, আমিও তার কোনো কোনো স্ট্যাটাসে। ব্যস, এটুকুই। ফেসবুকের মেসেঞ্জারে মেসেজ বিনিময় ও ফোন করার যে সুবিধা আছে, সেটাও আমরা কখনো ব্যবহার করিনি। দরকার হয়নি। আসলে, আমার বন্ধু ছিল দিলবর তাউস; সাবিনা সে-অর্থে আমার বন্ধু নয়, বন্ধুর বউ। সে আমাকে মশিউল ভাই বলে ডাকত, আমি তাকে ডাকতাম সাবিনা ভাবি বলে।
প্রায় দশ বছর পরে সেই সাবিনা ফেসবুকের মেসেঞ্জারে আমাকে একটা মেসেজ পাঠাল: মশিউল ভাই, কেমন আছেন, একটু কথা ছিল, ইত্যাদি। ঘটনা হলো, সে কীভাবে যেন তাউসের একটা অপ্রকাশিত গল্প খুঁজে পেয়েছে, সেটা আমাকে পাঠাতে চায়, আমি যেন ভালো কোনো পত্রিকায় সেটা ছাপানোর ব্যবস্থা করি। তার ধারণা, আমি এই কাজটা খুব সহজেই করতে পারব। কারণ, আমিও লেখালেখির জগতের মানুষ।
তাউস নিরুদ্দেশ হয়েছে প্রায় তেরো বছর আগে, প্রায় দশ বছর ধরে সাবিনা অন্য এক লোকের বউ, নিশ্চয়ই তাদের বাচ্চাকাচ্চাও আছে (তাউসের সঙ্গে ছিল না); এতগুলো বছর পর তার কেন মনে হলো, তাউসের একটা অপ্রকাশিত গল্প ছাপানোর দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে? এই প্রশ্নটা আমার মনে বেশ ভালোভাবেই জাগল। কিন্তু এ নিয়ে সাবিনাকে কিছু না বলে আমার ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে মেসেজ করলাম, গল্পটা পাঠান, চেষ্টা করে দেখি। সঙ্গে সঙ্গে সাবিনার পালটা মেসেজ চলে এল: চেষ্টা না ভাই, গল্পটা কিন্তু ছাপাতেই হবে। আমি জানি, এটা আপনার জন্যে কঠিন কিছু না।
যাই হোক, দিলবর তাউসের গল্পটা সাবিনা আমাকে পাঠাল, আমি পড়লাম। কেমন লাগল, তা আর না বলি। যাঁরা পড়বেন, নিজের মতো করে বুঝে নেবেন। প্রিয় পাঠক, আপনাদের জন্য নিচে গল্পটা হুবহু তুলে দিলাম। ধন্যবাদ।
বাংলা কলা
দিলবর তাউস
আধা গল্পকার আধা সাংবাদিক নীলকমল চৌধুরীর সাড়ে পাঁচ বছর বয়েসী ধ্যাদ্ধ্যারা মারুতি সুজুকি এইট হানড্রেড যখন তারে নিয়া শেরাটন হুটালের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের জাজ্বল্যমান সবুজ বাত্তি অথচ ট্রাফিক পুলিশের এক হাতের বেরিকেডের কারণে খাড়াইতে বাধ্য হয়, তখন তার মুখের ভিত্রে চারটা কলার আটখানা বিচি। তার একখান জিব্বা ওই আটখানা কলার বিচির লগে খেলা করতেছিল, কারণ সেখানে ওই মুহূর্তে তার করার কিছু ছিল না। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের চতুর্থ দিনের সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পার হইয়া গেছে; গাড়ির ভিত্রে যে সামান্য আলো সামান্য আন্ধার ভাব, তা বই বা পত্রিকা পড়ার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না।
তাই নীলকমলের একখানা জিব্বার লগে খেলা করতেছিল কলার আটখানা বিচি: ওই মুহূর্তে টাইম পাস করনের একমাত্র রাস্তা। আধঘণ্টা আগে সে চারটা কলা কিনছিল কারানবাজারে তার অফিসের গেটের সামনের ফুটপাতে ডালিভর্তি-কলা-লইয়া-বইস্যা-থাকা এক লোকের কাছে। লোকটা কইছিল যে এই কলার নাম বাংলা কলা। খাইতে খুব মিডা, তাই এক হালির দাম 'ষুল্ল ট্যাকা'।
বাংলা কলা নীলকমলের পূর্বপরিচিত ফল। খালি তাই না, বঙ্গদেশের লোকেরা পরস্পরকে ব্যঙ্গ করার কাজে যে ফলের কমন নাম ব্যবহার করে, তার একটা জাতের এই ধারার নামকরণ নিয়া সে মনে মনে গবেষণাও কম করে নাই। বাংলা কলার বৈশিষ্ট্য হইল, এই জাতের কলা কাঁচা ও পাকা উভয় বয়সে সবুজ বর্ণের হয়া থাকে। অন্য সব জাতের কলা কাঁচা অবস্থায় সবুজ আর পাকার পরে হলুদ, কোনোটা-বা লালচে বর্ণ প্রাপ্ত হয়, কিন্তু বাংলা কলা পাকার পরেও কাঁচার মতনই সবুজ থাইক্যা যায়। তাই নীলকমল এ রকম একখান হাইপোথিসিস খাড়া করছে যে, যে-ব্যক্তি এই জাতের কলার নামকরণ করছিল বাংলা কলা, সে নিচ্চয়ই একজন গভীর বাঙালি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক ছিল। বাংলাদেশ যেহেতু এভারগ্রিন কান্ট্রি, অতএব যে জাতের কলা কাঁচা ও পাকা সকল বয়সে সবুজ বর্ণ অটুট রাখে, তার নাম বাংলা কলা হওয়াই সুসমীচীন।
কলার মালিক এক হালির দাম 'ষুল্ল ট্যাকা' হাঁকলে নীলকমল কোনো মুলামুলির দিকে না গিয়া পকেট থিকা দশ ট্যাকার একখানা আর দুই ট্যাকার তিনখানা নোট বার কইরা তার হাতে দেয়, বিনিময়ে চারখানা বাংলা কলা নিজের হাতে লইয়া হাঁইট্ট্যা গিয়া গাড়িতে উইঠ্যা বসে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে, নীলকমল হেরে শাহবাগের দিকে আগাইতে কয়। গাড়ি কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে উইঠ্যা শাহবাগের দিকে ঘাড় ঘুরায়, কিন্তু বেড়াছেড়া জ্যাম লাইগ্যা রইছে বইল্যা তৎক্ষণে সেই দিকে অগ্রসর হইতে পারে না, না পাইর্যা ঘাড় কাত কইর্যা খাড়ায়া থাকে আর জগৎসংসারের কিত্তিকলাপ অবলোকন করে।
কারানবাজার আন্ডারপাসের আগে থিকা সোনারগাঁও হুটালের মোড়ের ইটিভি ভবন পর্যন্ত বিতিকিচ্ছিরি জ্যাম দেইখা নীলকমলের খিদা লাগে। সে একখান কলা ছিল্যা খাইতে আরম্ভ করে, আর ডাইনে-বাঁয়ে চায়। কলাডা অচিরেই তার প্যাডের ভিত্রে ভ্যানিশ হয়া যায়, কিন্তু মুখের মধ্যে রয়্যা যায় নুড়ি-কাঁকরের মতন শক্ত দুইখান বিচি। নীলকমল অবগত যে প্রত্যেকটা বাংলা কলার মধ্যে বিচি থাকে দুইটা করে। তার কমও না, তার বেশিও না। একটাও না, তিনটাও না: বাংলা কলা দুই বিচিবিশিষ্ট ফল। এই আবিষ্কার লইয়া নীলকমলের মনে একটুখানি হাসাহাসির উদ্রেক হইতে চায়, কিন্তু তৎক্ষণেই তার মনে হয়, বিষয়ডা ভালগার। এ নিয়া হাস্যরস বোধ করা তার মতন ব্যক্তির পক্ষে শোভা পায় না। কারণ, সে বড় লেখক হইতে চায়।
নীলকমল চৌধুরী বড় সাহিত্যিক হইতে চায়। আমি কই, ছোট জাতের মধ্যে বড় সাহিত্যিক পয়দা হয় না। সে প্রতিবাদ কইরা কয় বাঙালি ছোট জাত না। আমি হাসি। নীলকমল আমার হাসির কারণ ধরতে পারে না। সিরিয়াস বেকুব; নিজে হাসতে জানে না, অন্যরেও হাসাইতে পারে না। সব সময় সিরিয়াস ভাব ধইর্যা থাকে, যেন কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভুগতেছে। কিন্তু সে যতই সিরিয়াস ভাব ধরে, ততই তারে হাস্যকর দেখায়। হাস্যকর মানে রিডিকুলাস, ফানি না কিন্তু। আগে ফানি বললে হাস্যকর বুঝাইত। ইদানীংকালে ফানি হইল মজাদার। নীলকমল মোটেও মজা-উৎপাদক ব্যক্তি না, বরঞ্চ মাঝে মাঝে রিডিকুলাসলি ইরিটেটিং, বিশেষ কইর্যা যখন দেশ-জাতির কথা কয়, নীতি-নৈতিকতার লেকচার ঝাড়ে।
জরুরি অবস্থার পুরা দুইটা বচ্ছর নীলকমল আমাগো লেকচার শুনাইছে। কয় যে, চোরেরা বেশি বাইড়া গেলে বাটপারের আবির্ভাব ঘটে। এইটা নাকি স্বাভাবিক নিয়ম। দ্যাশ ধ্বংস হইয়া গেল বইল্যা যারা দ্যাশ-জাতি ও রাজনীতিরে উদ্ধার করার ঘোষণা দিয়া আইসা পড়ছে, তারা খালি বাটপার না, বাটপারগো বাপ-জ্যাঠা। নির্বাচিত চোরেরা পাঁচ বছর ধইরা যা চুরি করছে, অখন হেরা আইছে খাবলা দিয়া তার সবটি লইয়া লইতে। দুর্নীতি দমনের অভিযান সম্বন্ধে নীলকমল কয়, দুদুকের চিয়ারম্যান হেলিকপ্টারে চইড়্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গইড়্যা তুলতে যায়; এই হতদরিদ্র দেশে এহেন আয়েশ উচিত কি না, হেলিকপ্টারের ত্যালের ট্যাকা কই থিকা আসে, ইত্যাদি কোনো জিজ্ঞাসাই উনার মনে জাগে না, যতক্ষণ না খবরের কাগজে উনার হেলিকপ্টার-ভ্রমণের সমালোচনা (মৃদু) ছাপা হয়। জেলায় জেলায় ডিসি-এসপিরা চোর-বাটবার-কালোবাজারি-মাদকব্যবসায়ী, মজুতদারগো ডাইক্যা কয়, দুর্নীতিবিরোধী মিছিল-সমাবেশ হইব, চান্দা দেও। চোরেরা চান্দা দেয়, সেই চান্দার টেকায় দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের ব্যানার-ফেস্টুন লেখা হয়, চা-বিস্কুট খাওয়া হয়। খবরের কাগজে মিছিলের ছবি ছাপা হয়; মিছিলের আগে দুদুকের সংগ্রামী চিয়ারম্যান বীরদর্পে হাঁটে...
নীলকমল আরও বহুত বড় বড় বাসি কথা কয়। সেগুলা দেশের সব লোকেই জানে। তাই আমরা নীলকমলরে কই: প্রাথমিক কথাবাত্রা কইয়া আমাগো বিরক্তি উৎপাদন কইরো না, তোমার চোপা বন্ধ করো। সে সিরিয়াসলি আক্ষেপ কইর্যা কয়, দেশ-জাতির ঘোরসংকটে যাগোরে কুনো চ্যাতভ্যাদ নাই তারা কি মানুষ? আমরা কই, আমরা বান্দর, আর খল খল কইর্যা হাসি। আমাগো হাসি দেইখ্যা নীলকমলের পিত্তি জ্বইল্যা যায়। সে সিগ্রেট ধরায়া তিরিক্ষি বদনে ধুঁয়া খায় আর কয় যে সবটি নাকি পাগল হইয়া যাইতাছে।
কারানবাজারের আন্ডারপাসটা পার না হইতেই নীলকমল তার এক হালি কলার প্রথমটা সাবাড় করে, কিন্তু কলার বিচি দুইডা ফালায় না, একবার ডান গালে লয়, একবার বাম গালে লয় আর চিন্তা করে: কলার ক্যান বিচি হয়। বিচি কথাটার সত্যকারের মানে বীজ; ফলফলান্তির বিচি দরকার হয় নতুন গাছের জন্মের লেইগ্যা। কলার গাছ তো কলার বিচি থিকা জন্মে না, তাইলে কলায় কেন বিচি হয়? আর যেসব জাতের কলায় বিচি থাকে না, সেগুলার মধ্যে কেন বিচি থাকে না? যদি বিচি থেইক্যাই কলার গাছ জন্মাইত, তাইলে যেসব জাতের কলায় বিচি থাকে না, সেগুলার প্রজাতিরক্ষা কী প্রকারে সম্ভবপর হইত?
নীলকমল মুখের ভিত্রে দুইখান কলার বিচি লইয়া এইসব ভাবনা করতেছিল, ইতিমধ্যে তার গাড়ি কচ্ছপের মতন গতিশীল হইয়া সোনারগাঁও হুটালের মোড়ে পৌঁছে। সেইখানে ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাত্তি জ্বলন্ত দেখা যায়, কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ কাকতাড়ুয়ার মতন মাটির সমান্তরালে দুই হাত দুই দিকে বাড়াইয়া বেরিকেড দিয়া রাখে।
এই পদ্ধতিতে সময় যায়, কিন্তু গাড়ি যাইতে পারে না। ফলে নীলকমলের প্যাডে আবার খিদা চাগাড় দিয়া উঠে। সে দ্বিতীয় কলা খাইতে আরম্ভ করে। খাইতে খাইতে ট্রাফিক সিগন্যালে প্রথমে হলুদ, তারপরে লাল বাত্তি জ্বইল্যা উঠে, ট্রাফিক পুলিশ হাত নামাইয়া বাঁশিতে ফুঁক মারে; গাড়িগুলান উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটতে আরম্ভ করে। নীলকমলের গাড়ি একখান হেঁচকি তুইল্যা এক দৌড়ে বাংলামোটরের আগপর্যন্ত যায়। সেইখানকার ট্রাফিক পুলিশ হাত তুইল্যা বেরিকেড সৃষ্টি করে, সিগন্যালবাত্তির রঙের তোয়াক্কা করে না, কারণ সবুজ বাত্তি জ্বলন্ত দেখা যায়।
এইখানে খাড়ায়া নীলকমলের দ্বিতীয় কলা সাবাড় হয়া যায়; তার মুখের গহ্বরে জমা হয় চারখানা বিচি। তার জিব্বা বিচিগুলান লইয়া খেলা করতে থাকে, আর নীলকমল চিন্তা করে, কোটি কোটি ট্যাকা খরচ কইর্যা যে অটোম্যাটিক ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম বিদ্যাশ থিকা আনা হইছে, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই সেইগুলারে অর্থহীন কইর্যা রাখছে; তারা হাত তুইল্যা, বাঁশি বাজাইয়া, লাঠি উঁচাইয়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, এই কিসিমের শয়তানি দুনিয়ায় আর কোন দেশে থাকবার পারে। নীলকমলের মনে প্রথম যে দেশটা আসে, তার নাম পাকিস্তান; কারণ, তার বিশ্বাস পূর্ব বাংলার বাঙালিরা অনেক খাসলত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হইছে পশ্চিম পাকিস্তানিগো কাছ থিকা।
নীলকমল এইসব ভাবনা করতে করতে দেখে যে গাড়িগুলা আবার চলতে আরম্ভ করছে। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরে সামনের সবগুলা যানবাহন আবার কী কারণে খাড়ায়া পড়লে সে দেখে, কাছেকুলে কোনো ট্রাফিক পুলিশের ছায়ামাত্র নাই। গাড়িরা স্বাধীনতা পাইছে মনে কইর্যা যে যার মতন আগাবাইবার চেষ্টা করতেছে। তার ফলে কিছুক্ষণের মদ্যেই সড়কে সাংঘাতিক বেড়াছেড়া লাইগ্যা গেল আর এক অনিবার্য স্থবিরতা কায়েম হইল।
তখন নীলকমলের খিদা আবার চাগাড় দিল। সে মুখের চারখানা বিচি ফালায়া না দিয়াই তৃতীয় কলাডা ভক্ষণ আরম্ভ করে এবং লক্ষ করে যে আগের দুইটা কলা তার বিপাকপ্রক্রিয়ায় খিদাবর্ধকের ভূমিকা পালন করছে; ফলে তৃতীয় কলাডা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে সাবাড় হয়া যায়, কিন্তু সে থামে না, চতুর্থ কলাটাও ভক্ষণ করতে লাগে।
অচিরেই চারখানা বাংলা কলা তার উদরস্থ হয়, আটখানা বিচি তার মুখের গহ্বরে সেই ইতিহাস লইয়া অবস্থান করতে থাকে।
এই প্রকারে তার গাড়ি শেরাটন হুটালের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের একদম কাছে গিয়া থামতে বাধ্য হয়; কারণ, ওইখানে একজন ট্রাফিক পুলিশ হাত উঁচা কইর্যা বেরিকেড দিয়া দ-ায়মান। সোজা সামনের দিকে চাইয়া শাহবাগের পিজি ও বারডেম মোড় পর্যন্ত এবং বাম দিকে শেরাটনের পাশ দিয়া মন্ত্রিপাড়ার দিকে রাস্তা বাঁক নিয়া যেখানে অদৃশ্য হইয়া গেছে, সেই পর্যন্ত বেশুমার যানবাহনের দৃশ্য দেইখ্যা নীলকমলের মনে হয়, বিপরীতমুখী যানবাহনের স্রোত বুঝি শেষ হওয়ার না। তার ঠিক সামনের গাড়িটা পার হইয়া গেছে, এক মুহূর্তের দুর্ভাগ্যে তার গাড়িটার সামনেই ট্রাফিক পুলিশটা হাত তুইল্যা বেরিকেড সৃষ্টি করছে।
কিন্তু এখন নীলকমল সৌভাগ্যবান, কারণ এবার তার গাড়িটা পড়ছে একদম সামনের সারিতে, এরপরে ট্রাফিক পুলিশটা হাত নামানোর লগে লগেই তার গাড়িটা রেসের প্রথম ঘোড়ার মতন ছুটতে পারব সক্কলটির আগে।
কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আর কোনো প্রকারেই আসে না। সিগন্যালের বাত্তি পর্যায়ক্রমে রং বদলাইতে থাকে, বদলাইতেই থাকে, তবু ট্রাফিক পুলিশটার মর্জির কোনো হেরফের ঘটে না। সে যেন পণ কইর্যা খাড়ায়া পড়ছে যে এই দিককার গাড়িগুলারে আর কস্মিনকালেও সামনের দিকে আগাইতে দিবে না।
মুখের ভিত্রে চারখানা বাংলা কলার আটটা বিচি লইয়া খেলা করতে করতে অপেক্ষার প্রহর গণনা করে নীলকমল চৌধুরী। কিন্তু অপেক্ষার মেজাজে সে আছিল না, কারণ শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে তার জন্যে ওয়েট করতেছিল এক তরুণী, যার লগে সম্প্রতি মোবাইলফোনে তার যোগাযোগ ও পিরিতের ভাব হইছে, সাক্ষাৎ অখনো ঘটে নাই। ওই দিনই তাদের প্রথম সাক্ষাতের তারিখ ধার্য হইছিল। অতএব কারণে নীলকমলের ধৈর্য ক্রমে ফুরায়া আসতেছিল।
এই টাইমে তার মোবাইল বাইজ্যা উঠে, সেই তরুণীর কণ্ঠস্বর ঝংকার নীলকমলের কানে প্রীতি ঢালে:
'আপনি কোথায়?'
'এই তো পথে। চইল্যা আসছি, আর পাঁচ মিনিট।'
'এইটুকু রাস্তা, এতক্ষণ লাগে?'
'না, না! এই তো আসলাম বলেৃ।'
'আমি তো ওয়েট করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গেলাম।'
নীলকমল খালি 'এই তো, এই তো, আর পাঁচ মিনিট, আর তিন মিনিট' ইত্যাদি কয়, তার জিব্বা কলার বিচিগুলারে ঘাঁটাইতে থাকে।
নীলকমল বেকুব, সে যদি ওইখানে গাড়ির মধ্যে বসে না থাইক্যা লাফ দিয়া নাইম্যা পড়ত, তারপর সাকুরার পাশের গলি দিয়া হাঁটা আরম্ভ করত, তাইলে আজিজ সুপারমার্কেটে অপেক্ষমাণ তরুণীর কাছে পৌঁছাইতে পাঁচ মিনিটও লাগত না। কিন্তু এই বুদ্ধি তার মাথায় খেলে নাই; সে দুশ্চিন্তা করতেছিল আর দেখতেছিল গাড়ির সিলিন্ডারে গ্যাস রইছে আর কয় বাত্তি। দেখে যে মাত্র একখান বাত্তিই জ্বলতেছে, আর অকটেনের কাঁটাও গিয়া ঠেইক্যা রইছে তলানিতে।
তখন সে কী মনে কইর্যা বা কিছু মনে না কইর্যাই, হঠাৎ ফ্রু কইর্যা কলার বিচিগুলা মুখ থিকা সজোরে ছুইড়্যা ফালায়া দিল। দুই-তিনখান বিচি বুলেটের মতন গিয়া লাগল ট্রাফিক পুলিশের মুখম-লে। লগে লগে তার দুই চক্ষে ধাঁই কইর্যা আগুন জ্বইল্যা উঠল। ডিউটি ফালায়া সে নীলকমলের ড্রাইভারের পাশের জানালায় গিয়া খাড়াইল, গাড়ির ছাদে জোরে এক ঘুষি মাইরা কইল, 'ওই বেটা, দরজা খুল্।'
ড্রাইভার দেখে নাই তার মালিক কত্ত বড় ক্রাইম কইর্যা সারছে। সে পিছন দিকে ঘাড় ঘুরায়া নীলকমলের দিকে চায়া পারমিশান চাওয়ার ঢঙে কয়, 'ছার, টেরাফিকে কী কয়?'
'দরজা খুল্ ব্যাটা!' মারুতির বডিতে সজোরে থাবা মারতে মারতে চিৎকার ছাড়ে ট্রাফিক পুলিশ।
কিন্তু ড্রাইভার দরজা খোলে না। ট্রাফিক পুলিশটা তখন ড্রাইভারের খোলা জানলার ভিত্রে এক হাত হান্দাইয়া দিয়া তার ঘেটি ধইরা একখান মোচড় লাগায়, অন্য হাত দিয়া দরজা খুইল্যা তারে ঘেটি ধইর্যাই টাইন্যা নামায়, এমনে ধাক্কা দিয়া সরায়া দেয় যে ড্রাইভারের মনে হয় তারে ফিক্যা ফালাইল। তারপর ট্রাফিক পুলিশ নীলকমলের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বইস্যা গাড়ি স্টার্ট করে। পিছনের সিটে বসা নীলকমলের চক্ষু ছানাবড়া হইয়া যায়। সেই ছানাবড়া চক্ষুসুদ্ধাই ট্রাফিক পুলিশ তারে থানায় নিয়া হাজির করে।
মাগরিবের ওয়াক্তে লোডশেডিং-কবলিত থানা চত্বরে নীরব আবছায়ার সাথে মিশে আছে অনির্দিষ্ট নৈঃশব্দ। নীলকমল ভূতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই পরিবেশটারে তার ভুতুড়ে লাগে। সেই যে তখন তার স্বাভাবিক চক্ষুর চাহনি অস্বাভাবিক ছানাবড়া হইয়া গেছে, তা আর স্বাভাবিক অবস্থা ফেরত পায় নাই। অখন এই ভুতুড়ে পরিবেশে তার সেই বিস্ফারিত দুই চক্ষের মণিতে এক প্রকারের অনিবার্য অসহাত্বের ভাব পরিস্ফুট হয়্যা উঠে।
নীরব থানার চত্বরের পাতলা আবছায়ায় ট্রাফিক পুলিশ নীলকমলরে গাড়ি থিকা নামাইতেছে, এমন সময় থানার বারান্দার দিক থিকা একখান গলার আওয়াজ ভাইস্যা আসে, যার ফলে নৈঃশব্দ ভঙ্গ হয়: 'উনারে এইখানে না, টিএফআই সেলে...' বাক্যের বাকি অংশটা নৈঃশব্দের মধ্যে হারায়া যায়। নীলকমলের মনে পড়ে, টিএফআর সেল হইল গুরুতর অপরাধবিষয়ক টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল।
ইট্টু-আগে-ডুইব্যা-যাওয়া সূরে্যর প্রস্থানপথে নাইমা-আসা সন্ধ্যাকালের নীরব আবছায়ায় খাড়ায়া রইছে পাহাড়ের মতন ধ্যানমগ্ন একখানা অতিকায় মোটর ভ্যান। ট্রাফিক পুলিশটা নীলকমলরে নিয়া সেই প্রিজন ভ্যানের দিকে হাঁইট্যা যাইতে লাগে, তখন তিন দিক থিকা তিনজন মানুষ অথবা তিনখানা ছায়া ধীরে আগায়া আসে।
নৈঃশব্দ টোল খায়, নীলকমল শুনবার পায় 'সিবিল সোসাইটি'। তিন ছায়া আরও আগায়া আসতে থাকলে নীলকমলের কানে বাজে 'পাট্টি', 'না, পাট্টি না'। আওয়াজটা হয় ঠিক সেই রকম, ভুট্টাদানা তাপের ঠেলায় যেমুন শব্দে ফুইট্ট্যা গিয়া খৈ হয়।
তারপরে 'মে লে টা রি'। পরপর চারখানা ভুট্টাদানা ফুইট্ট্যা খৈ হইল।
তারপরে খালি খৈ ফুটতেই থাকে: এজেন্সি, বুদ্দিজীবী, দেশপ্রেমিক, বান্দির পো, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি...।
হঠাৎ হুংকার: 'ওই, কেডা রে?'
থানা চত্বরের হাওয়ায় কাঁপ লাগে, নীলকমল সংবিৎ ফির্যা পাইলে এমনে তাকায়; দেখে যে এক লোক মাথায় ডালি নিয়া খাড়ায়া দোনামোনা করতেছে।
'কলা লইবেন ছার, চিনির মতন মিডা কলা...'
'ওই, তর কলা তো ব্যাকটি কাঁচা...'
'এই, হালারে বান্দ, হোগায় বাড়ি লাগা দুইখান...কাঁচকলা বেচতে আইছে আমগো দারে...!'
'ও ছার, কাঁচা না! একখান কলাও কাঁচা না, এইডা বাংলা কলা, চিনির মতন মিডাৃখাইয়া টেকা দিবেন ছার, চিনির মতন মিডা না হইলে টেকা লইতাম না না...'
নীরবতা মিলায়া যায়, থানা চত্বরে চপচপ মসমস শব্দ হইতে লাগে, আর পাতলা আবছায়ায় নীলকমল দেখে যে থানার সব পুলিশ কলা খাইতে আরম্ভ করছে...
'ওই, তর কলার মধ্যে তো বিচিৃ' একজন কয়; বুঝা যায় সে কলা চাবাইতে চাবাইতে এই কমপ্লেন করল।
'মাত্র দুইডা কইরা বিচি,' কলাআলার উত্তর শোনা যায়, 'বাংলা কলা ছার এই রকমই, পিত্যেক কলার মদ্যে দুইখান কইর্যা বিচি থাকে। তিনডা না, একখানও না। বাংলা কলার বিচি দুইখান...।'