ভুলে যাওয়া ইতিহাস
'কফি হচ্ছে আম জনতার সোনা, সোনার মতোই সবার ভেতর বিলাসিতা আর আভিজাত্যের বোধ নিয়ে আসে।' - ১৯৫৮ সালে কফির সবচেয়ে পুরোনো ইতিহাস রচিয়িতা শেখ আব্দুল কাদির।
তারিম, ইয়েমেন। মাথার উপর উঠে আসছে সূর্য, নিচে হাদ্রামউত উপত্যকার বুকে ৪০ ডিগ্রির জ্বলন্ত তাপ বর্ষণ করছে। বিকেলের এই সময়টা বাজারে থাকার জুৎসই সময় না হলেও তপ্ত রোদেই একটা ঠেলা গাড়ির উপর ঝুঁকে পড়ে তিলের বীজের একটা ঢিবিতে হাত চালাচ্ছে নু'মান। ওর মায়ের শাদা বীজ চাই। বীজগুলোকে বাতিল করার মতো ফ্যাকাশে রংয়ের খোঁজে স্তূপ পরখ করছে নুমান।
ইয়েমেনের মোচা থেকে আসা ফেরিআলা হাবিব সকৌতুকে জরিপ করছে ওকে। নিজের ক্ষুদে তাঁবুকে ধরে রাখা একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাড়িতে হাত বোলাচ্ছে সে। নু'মানের কব্জিতে প্যাঁচানো সুগন্ধি মিসবাহা (প্রার্থনার তজবীহ) হাবিবের নজর কেড়ে নিয়েছে। মিষ্টি একটা সুবাস আসছে ওটা থেকে। নিশ্চয়ই সুফিটুফি হবে, ভাবল সে।
'এই যে ছেলে!' ওকে ডাকল সে। চোখ তুলে ফেরিআলার দিকে তাকাল নুমান।
'তোমার শেখের নাম কি?' জানতে চাইল হাবিব।
'কে জানতে চায়?' জবাবে পাল্টা প্রশ্ন নুমানের।
ওর প্রশ্নে পাত্তা না দিয়ে একটা ক্ষুদে বস্তা থেকে এক মুঠো সবুজ কফির বিচি বের করে হাতের তালু চোখ বরাবর রেখে সোজা নিজের বিক্রির জায়গার দিকে এগিয়ে গেল সে।
'এই বীজগুলো দেখেছো, বাছা...এগুলোর বিশেষ ক্ষমতা আছে...তোমাকে রাতভর জাগিয়ে রেখে মনোযোগের স্তর বাড়িয়ে দেবে। তোমার রাতের জিকিরে সাহায্য করবে।'
'আমার জিকিরের কথা কি জানো?' বিরক্তির সাথে জানতে চাইল নুমান।
নুমানের কব্জিতে প্যাঁচানো সুগন্ধি মিসবাহার দিকে ইশারা করে মৃদু হেসে পেছনে হেলান দিল হাবিব। মাথা দোলাল সে।
'বিশ্বাস করো...তোমার জিকিরের কথা আমি জানি।' হাতটা মুঠি পাকিয়ে সবুজ কফির বীজগুলো নুমানের বিস্মিত হাতে ঢেলে দিল সে। 'এগুলো নাও। আমার পক্ষ থেকে উপহার।' সাধারণ বণিক হলেও খদ্দেরদের ভালো করেই চেনে হাবিব।
জিকিরে সমস্যা হচ্ছিল নুমানের। ওর সতীর্থ মুরিদদের বিস্ময়কর দর্শন ঘটলেও নুমানের পিঠ ব্যথা হয়ে যায়, হাঁটুতে জড়তা ধরে। হয়তো এটাই ওর চূড়া টপকানোর জন্যে দরকারী জাদুর আরক। হাবিবের দিকে তাকিয়ে কোমল দৃষ্টি এবং কুচকুচে কালো চেহারায় স্থায়ীভাবে সাঁটা হাসি দেখে ওকে বিশ্বাস করা যায় কিনা বুঝতে চাইলো নুমান।
কফির বীজ পকেটে রাখল ও।
তিলের দাম মিটিয়ে দ্রুত বিদায় নিল নুমান।
'মনে রেখ,' পিছু ডেকে বলল হাবিব। 'লাগলে আমার কাছে আরও আছে।' পিছু না ফিরেই হাত নেড়ে হাঁটা অব্যাহত রাখল নুমান।
কফি, ধার্মিকের পানীয়?
এক কাপ কফি বিনা কফি পায়ীদের দিন শুরু হওয়ার জো নেই। আট শো বছর আগে ধর্মপ্রাণ মুসলিমের বেলায় এক কাপ টাটকা কফি ছাড়া রাত শুরু হওয়ার উপায় ছিল না।
কফিই ছিল ধার্মিকের শক্তিদায়ী পানীয়। কফি আবিষ্কারের পর প্রথম তিন শো বছর মুসলিম, বিশেষ করে সুফিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল এটি। বিশ্বাসীরা রাতে আল্লাহর ধ্যানে জেগে থাকতে কফি পান করতেন।
মুসলিমরাই কফি 'পানীয়' আবিষ্কার করেছে হয়তো, কিন্তু আরও আগে থেকেই ইথিপিওরা কফি বীজের শক্তিদায়ী প্রভাবের কথা জানতো।
ইথিওপিয়ার বিভিন্ন জঙ্গলে বুনো কফি গাছ জন্মায়। এই ফুল থেকে উৎপন্ন ফলেই থাকে সবুজ কফি বীজ। তেলের পর পৃথিবীর বৃহত্তম বিক্রিত পণ্য এটি। ইথিওপিওয়ায়ও এই বীজ চিবুতো। পানীয় হিসাবে কফির ধারণা ইয়েমেনের বন্দর নগরী মোকায় (আল-মুকা) দেখা দিয়েছিল।
কফি গাছ কবে লোহিত নাগর পাড়ি দিয়েছে জানা না গেলেও আনুমানিক হাজার বছর আগেই এটি মোকায় পৌঁছায়। এরপর থেকে পৃথিবীর সমস্ত কফি গাছের জন্মই ইয়েমেনে। এই গাছই জন্ম দিয়েছে বৈশ্বিক কফি শিল্পের। ইথিওপিয়ার বাইরে উৎপন্ন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কফি গাছ একই ইয়েমেনি জেনেটিক কোড বহন করছে।
তরল আকারে বানানো কফির কাহিনী উমর আল-শাধিলি নামে শাধিলি ত্বরিকার একজন গুরুর সাথে সম্পর্কিত। তার এই উদ্ভাবন সম্পর্কে অগুনতি গল্প চালু আছে।
অনেকে বলেন বুনো এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময়ই এই গাছের শক্তির কথা জানতে পারেন তিনি। আবার কেউ বলেন, ইথিওপিওদের কফি পান করতে দেখে মোকায় এই রীতির চাল করেন।
যাহোক, উমর আল-শাধিলি তার ছাত্রদের রাতের জিকিরে সাহায্য করতে কফি পানের সুচনা ঘটান। জিকির সুফিদের ভেতর জনপ্রিয়। যেকোনও সময়ই এটা করা গেলেও বহু ত্বরিকা রাতের একটা অংশ জিকিরের পেছনে কাটিয়ে থাকে। এই অভ্যাসের কারণে কফি বিভিন্ন সুফি ত্বরিকার ভেতর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ১২০০ এবং ১৫০০ সালের মাঝামাঝি সুফিরা আরবীয় পেনিনসুলায় ঘুরে বেড়াতেন এবং রাতের জিকিরের সময় কফি পান করতেন।
কফি সাধারণ মানুষের ভেতর ছড়িয়ে পড়লে ইয়েমেনিরা এই উদ্দীপক আরক উৎপাদনে সহায়তা দিতে তাদের জমিতে চাষাবাদ শুরু করে। দক্ষিণ ইয়েমেনের তিয়াজ এবং ইব্ব-এর কাছাকাছি কিংবদন্তী নাসমুরাদে পাহাড় (নাকিল সুমারা) বা কফি পর্বতে এর শুরু।
কাওয়াহ!!
উত্তপ্ত পানির পাত্রের নিচে ক্ষুদে আগুন জ্বলছে। হাবিবের দেওয়া উপাদান মেশানোর সময় হলো। সযত্নে নির্দেশনা পালন করল নুমান।
উতড়ানো পানিতে কাঁচা কফির বীজ ফেলে নাড়তে লাগলো ও। গাঢ় সবুজ, প্রায় কালচে রঙ নিলো পানি। অদ্ভুত অথচ মনকাড়া সুবাস ছড়াচ্ছে। বেশ কয়েক মিনিট নাড়ার পর আগুন থেকে পাত্রটা নামিয়ে একটা গামলায় জাদুর আরক ঢালল ও। তেতো স্বাদের মিশেলটা জিভ পোড়ানো গরম। আরকের ক্ষমতার সত্যতার ব্যাপারে
এখনও সন্দিহান নুমান...
চোখমুখ কুঁচকে দুহাতে গামলাটা তোলার সময় মিষ্টি সুবাস নাকে লাগলো। গাঢ় পানীয়র চেহারা ভয়ানক হতে পারে, কিন্তু সুবাসটা স্বর্গীয়।
কালো কফি, জাদুর আরক।
চুমুক দিল ও।
'কাওয়াহ!!!' থুতুর সাথে তেতো তরল ফেলে চেঁচিয়ে উঠল ও। বিতৃষ্ণায় গামলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সময় গোটা শরীর শিউরে উঠল।
গাঢ় তরলের দিকে তাকিয়ে রইল ও, কি করবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু হাতে সময় নেই। একটু পরই জিকির শুরু করবেন শেখ। মসজিদ বিশ মিনিটের হাঁটা পথ। মাথা নাড়তে নাড়তে শেষে জিভটাকে বাঁচিয়ে 'কাওয়াহ' নামের পানীয়টুকু ঝটপট জোর করে গিলে নিল ও।
মনে মনে ভবিষ্যতে দারুচিনি মেশানোর কথা ভেবে কোরআন শরীফ এবং মিসবাহা হাতে মসজিদের দিকে ছুটল ও। [কাওয়াহ কফির আরবী প্রতিশব্দ। প্রতিটি ভাষাই এই পানীয় বোঝাতে 'কাওয়াহ' তাদের শব্দ ভাণ্ডারে যোগ করেছে।
কাওয়াহ- আরবী
কিভাহ- তুর্কী
কাফী- জার্মান
ক্যাফে- ফরাসী
কফি- ইংরেজি।]
মধ্যযুগীয় আরব ভাষাবিদদের মতে কাওয়াহ শব্দটি সাধারণভাবে কফি ভোগের আগে থেকেই চালু ছিল। এর মানে কোনওকিছুকে কিতৃষ্ণ বা কোনও কিছুর জন্যে আকাঙ্ক্ষাকে হ্রাস করা।
গোড়ার দিকের বছরগুলোয় কফি বানাতে কাঁচা সবুজ কফি বীজ ব্যবহার করা হতো বলে কফি তেতো লাগতো। অনেক পরে পোড়ানোর রীতি দেখা দিয়েছে। পোড়া কফি বীজ অনন্য স্বাদ এবং সুবাস যোগানো তেল তৈরি করে।
জিকির পর্ব
গোধূলির পরপরই মসজিদে পৌঁছাল নুমান। তেমন কিছু লাগছে না ওর। হাবিব কি তবে ওর সাথে তামাশা করল? ভাবল নুমান। শেখের আসনের বাম দিকে আসন পেতে বসল ও। শুরুর অপেক্ষা। অন্যরাও যে যার অবস্থান নিয়েছে। প্রথম কাতারের ওরা শেখের প্রিয়পাত্র।
শেখ এসে ছাত্রদের মুখোমুখি রাখা চেয়ারে বসে দোয়া পড়ে জিকিরের তালিম দিলেন। এই ধরনের জিকির কেবল শেখের উপস্থিতিতেই করা সম্ভব বলে ছাত্রদের সতর্ক করে দিলেন শেখ। জ্ঞানী ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়া একাজ করা বিপজ্জনক। এবার শুরু করলেন তিনি।
চোখ বুজে মাথা দুলিয়ে ধীর গভীর কণ্ঠে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে লাগলেন। ছাত্ররাও আউড়াতে শুরু করল, নুমান যোগ দিল ওদের সাথে। শেখের সবক মোতাবেক এক দরজাআলা একটা ফাঁকা কামরার দিকে মনোযোগ স্থির করেছে নুমান। চোখ বুজে জোর গলায় জিকি করতে লাগলো ও। নিজের মনোযোগের মাত্রা দেখে অবাক হয়ে গেল। সাধারণ এই পর্যায়ে এসে পিঠের ব্যথা আর আড়ষ্ট পায়ের ব্যাপারে সজাগ হয়ে ওঠে ও। কিন্তু আজ রাতে ওর মনোযোগের শক্তি ওকে অবাক করেছে। মসজিদে চারপাশের পরিবেশের বদলে মনের চোখে ফাঁকা কামরায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ও। ওর সামনে কেবল চারটা নগ্ন দেয়াল এবং একটা দরজা। আগেও এই জায়গায় এলেও ওই দরজা কখনও উন্মুক্ত হয়নি। সাধারণত ঘুম ওকে দখল করে নেয়। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটল। সহসা ওর মনের চোখের কামরাটা নীরব হয়ে গেল, যেন সাউন্ডপ্রুফ রুমের কবাট আটকে দেওয়া হয়েছে। কানের ভেতর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ও। দরজার হাতল নড়ছে। আগের সভাগুলোয় কখনই এই স্তরে আসতে পারেনি ও। গোটা শরীর যেন হিম হয়ে এলো ওর। আরও গভীর হলো ওর মনোযোগ। আজ ওই ঘরে ঢুকতেই হবে!
এমনকি শেখও তৃতীয় কাতারের নুমানকে লক্ষ্য করেছেন। ধীরে ধীরে খুলে গেল পাল্লাটা, ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়েছে আলোর রেখা। হাত বাড়িয়ে জোর করে দরজাটা খুলতে চাইছে ও, পারছে না। এটা এক ধরনের মানসিক চর্চা। দরজাটা পিছলে ঢুকে পড়ার মতো যথেষ্ট ফাঁক হলেও শরীরকে সামনে বাড়ার হুকুম দিতে পারছে না। জিকির চলছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুলে যাচ্ছে দরজাটা। অবশেষে ফোকরের দিকে পা বাড়াল ও। যত কাছে যাচ্ছে ততই দ্রুত খুলে যাচ্ছে পাল্লাটা। এক সময় ভিন্ন এক বলয়ে হাজির হলো ও।
কফিই অভিশপ্ত
বিভিন্ন সুফি তরিকার ভেতর কফি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গোটা আরবীয় পেনিনসুলায় ছড়িয়ে পড়ে এই উজ্জীবক তরলটি। জিকিরের আগে আগে খাওয়া হতো বলেই মূলত মসজিদের কাছেপিঠের এলাকায় এর ব্যবহার সীমিত ছিল। তবে তুর্কীরা শিয়রে কড়া নাড়ার আগপর্যন্ত কফির বিস্তার আরবীয় পেনিনসুলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৪০০ সালের দিকে মোকা বন্দর তুর্কীরা দখল করে নেয়। ফলে কফির সাথে পরিচিত হয়ে তুর্কী সুফি তরিকাগুলো মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে।
কফির এই বিস্তার শান্তিপূর্ণ এবং বিরতিহীন মনে হতে পারে, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। প্রথম কয়েক শতকে এই উজ্জীবক পানীয় নিয়ে বিরাট বিতর্ক ছিল। বেশ কয়েকবার কফিকে নেশা দ্রব্য ঘোষণা করে ইসলামি বিধি মোতাবেক হারাম করার সমন্বিত প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। কফির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। এর সপক্ষে বেশ কিছু কারণও তুলে ধরা হয়। প্রথমত, এটা নেশা জাতীয় দ্রব্য বলে অ্যালকোহলের মতোই হারাম। দ্বিতীয়ত, চোলাই করা মদের মতো এটা কার্বোনাইজেশন পর্যায় পর্যন্ত পোড়ানো হয়। শরীয়া আইনে যা হারাম।
কিন্তু কফি চোলাই করা ফল থেকে তৈরি পানীয় নয়। এর পক্ষে যুক্তি হানাফি নীতিমালা ভিত্তিক। তাছাড়া, মনের উপর কফির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থাকলেও নেশার প্রচলিত ইসলামি সংজ্ঞা হচ্ছে, যখন কেউ নারী পুরুষ বা চাঁদ সূর্যের ভেতর তফাৎ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে; কফির কারণে এমন কিছু ঘটে না।
কিন্তু এইসব যুক্তি কর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়তে ব্যর্থ হলে কফি হারাম ঘোষিত হয়। ১৫১১ সালের ২৫ শে জুন মক্কায় প্রথম হারামের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৫২৫ সালে এই হারামাদেশ প্রত্যাহার করা হলেও ১৫৩৯ সালে ফের কায়রোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাসত্ত্বেও কফির বিস্তার অক্ষুণ্ন থাকে। কফি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সাথে সাথে সেক্যুলার বলয়েও বিস্তৃত হয়। পৃষ্ঠপোষকের জন্যে বিভিন্ন মসজিদ কফি হাউসগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
১৫৫৫ সালে দুজন সিরিয়ান হাকম এবং শামস ইস্তান্বুলে একটি কফি হাউস খোলেন। পার্সিয়ায় কফি হাউসের অস্তিত্ব থাকলেও এটাই ছিল সত্যিকার অর্থে সেক্যুলার কফি হাউস। সারা ইস্তান্বুলে এগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি সুফিরাও কফির আসরের ধর্মীয় আভার জায়গা মানুষের ঠাট্টা-রসিকতা, ধূমপান, আড্ডা কিংবা সস্তা পুতুল খেলা উপভোগ দখল করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন।
১৬০০ সালের দিকে ওটোমান সুলতান চতুর্থ মুরাদ কফিহাউসের মতো জায়গাগুলোতে সুস্থির মানুষগুলো প্রশাসনিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আলাপ আলোচনা করে এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অথবা সুলতানের নীতিমালাকে অযোগ্য বলে সমালোচনা করছে বলে বুঝতে পারেন। কফিহাউসই শেষে বিদ্রোহের সুতিকাগার হয়ে উঠবে ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। সুলতানাতের উৎখাত থেকে ষড়যন্ত্রীদের ঠেকাতে কফিহাউসই নিষিদ্ধ করে বসেন। কফিহাউসগুলো পুড়িয়ে ভস্মিভূত করা হয়। কারও কাছে কফি কাপ দেখা গেলেই তাকে নির্মম পরিণতি শিকার হতে হতো। সুলতান চতুর্থ মুরাদের মৃত্যু অবধি এই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।
পশ্চিমে বিস্তার ঘটে কফির
কফির ভোগ আরও বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত ইউরোপের সীমান্তে পৌঁছে যায়। ১৬১৫ সালে ইস্তান্বুলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবাদে ভেনিসে পৌঁছায় কফি এবং ধীরে ধীরে পশ্চিমে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। অবশ্য, ইয়েমেনের (ইথিওপিয়া বাদে) বাইরে অন্য কোথাও কিন্তু কফি উৎপাদিত হতো না।
শত শত বছর ধরে কফি ছিল ইয়েমেনি পণ্য। মোকার বন্দর যার যার দেশে কফি বীন নিয়ে যেতে বোঝাই হতে থাকা অসংখ্য জাহাজে গিজগিজ করতো। ইয়েমেনিরা তাদের এই মূল্যবান সামগ্রীটি নিবিড়ভাবে পাহারা দিয়েছে। রপ্তানির আগে সমস্ত কফি বীনই উত্তপ্ত পানিতে ভিজিয়ে নির্বীজ করে ফেলা হতো। কেউ চোরা পথে কফি বিন বিদেশে চালান করতে গিয়ে ধরা পড়লে তার শিরোশ্ছেদ করা হতো। ইয়েমেনিদের দুর্ভাগ্য, সারা বিশ্বের উদ্যোক্তরা এই ফসলটির সম্ভাবনা বুঝতে শুরু করলে লাভের ব্যাপারটা ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে তোলে।
ভারতই প্রথম অমুসলিম দেশ যেখানে একজন ভারতীয় সুফি বাবা বদন (হজরত শাহ জামেরউল্লাহ মাজারাবি) কফি গাছ রোপণ করেন। মক্কায় হজ করতে গিয়ে কাঁচা কফি বীজ নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
১৬০০ শতকের প্রথমদিকে সবুজ কফি বীজ চোরাপথে ইয়েমেন থেকে এনে নতুন বিশ্বে (উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা) রোপণ করা হয়। বেশ কয়েক শো বছর লাগলেও ইউরোপে বৃহত্তম কফি রপ্তানিকারী দেশ হিসাবে ইয়েমেনকে টপকে যেতে বিপুল পরিমাণ কফি বীজ উৎপাদন শুরু করে।
১৭ শতকের শেষ নাগাদ কফি পান গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং কফি বীজ পরিণত হয়ে অন্যতম লাভজনক পণ্যে। আজও তা অব্যাহত আছে।
আচ্ছন্নের মতো বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নুমান। আরেকটা তপ্ত দিন। কিন্তু হাবিবকে খুঁজে পেতেই হবে। গত রাতের অভিজ্ঞতার কথা কখনও ভুলবে না ও। এখন একটা বিশেষ গোত্রের অংশে পরিণত হয়েছে ও। এবার হয়তো সামনের কাতারে বসার সুযোগ মিলতেও পারে।
আগের মতোই খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছিল হাবিব। নুমানের দিকে চোখ যেতেই হাসির ঝলক দেখা দিল তার চেহারায়। মাথা দোলাল সে। চোখ ফিরিয়ে জমিনের দিকে তাকাল নুমান, যেন এখানে অস্বাভাবিক কিছু নেই। নুমান কাছাকাছি এলে কফি বীজের থলে বের করে হাবিব বলল, 'এক কিলোর দাম দুই দিনার।'
-
ভাষান্তর: শওকত হোসেন