মারি ও মড়ক
'কল্যাণীয়েষু, শরৎ, রুগ্ন, দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে। ইতি ৩১/১২/৩৭'
অতিক্ষুদ্র এই পত্রটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন। শরৎচন্দ্র সে সময় সামতাবেড়ে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চিকিৎসা করাতে কলকাতার বাড়িতে এসেছেন। কলকাতায় ডাক্তাররা এক্স-রে করে দেখলেন, শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার হয়েছে, এমনকি এই অসুখ তাঁর পাকস্থলীও আক্রমণ করেছে। ডাক্তাররা ১২ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে তাঁর পেটে অস্ত্রোপচার করেন। এর চার দিন পর তিনি মারা যান।
জীবনের শেষ সময়টায় একটা-না-একটা রোগে কাবু হচ্ছিলেন শরৎচন্দ্র। ১৯৩৭ সালের গোড়ার দিকে কিছুদিন জ্বর, তারপর ডাক্তারের উপদেশে দেওঘর বেড়াতে যান। সেখানে তিন-চার মাস থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে সেপ্টেম্বর মাসে আবার অসুখে পড়েন। তারপরই শরীরে ওই ক্যানসার ধরা পড়ে।
'আমাদের শহরে তখন শীত পড়েছে, হঠাৎ কলেরা দেখা দিলে। তখনকার দিনে ওলাউঠার নামে মানুষে ভয়ে হতজ্ঞান হতো। কারও কলেরা হয়েছে শুনতে পেলে সে-পাড়ায় মানুষ থাকতো না। মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা দুর্ঘট হতো। কিন্তু সে দুর্দিনেও আমাদের ওখানে একজন ছিলেন যাঁর কখনো আপত্তি ছিল না। গোপালখুড়ো তাঁর নাম, জীবনের ব্রত ছিল মড়া-পোড়ানো। কারও অসুখ শক্ত হয়ে উঠলে তিনি ডাক্তারের কাছে প্রত্যহ সংবাদ নিতেন। আশা নেই শুনলে খালি পায়ে গামছা কাঁধে তিনি ঘণ্টা-দুই পূর্বেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন।…
তিনি কিন্তু মনে মনে তাকে ক্ষমা করলেন। বুঝলেন, এতবড় ভয়শূন্যতা তাঁর পক্ষেও অসম্ভব। এই রাতে একাকী শ্মশানে কলেরার মড়া, কলেরার বিছানা—এ-সব সে গ্রাহ্যই করলে না!'
উদ্ধৃতিটুকু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'লালু' গল্পের। সাহসী ও পরোপকারী গোপালখুড়ো নামের এই চরিত্রটির মতে, কলেরা রোগীর সেবা করার চেয়ে 'পুণ্যকর্ম সংসারে নেই'।
গোপালখুড়োর মতোই অমন সাহসী ও পরোপকারী আরেকটি চরিত্র ১৯১৮ সালে প্রকাশিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ। গোপালখুড়োর তুলনায় তার খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবশ্য বাঙালি পাঠকের কাছে অনেকটাই বেশি। কলেরা কিংবা এমন কোনো মহামারির নাম শুনলেই ইন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়ত।শ্রীকান্ত থেকেই উদ্ধৃত করা যাক—
'ইন্দ্র কহিল, ঐ যে বটগাছ, ওর পাশেতেই একটা সরু ঘাট আছে।...কিছুক্ষণ হইতে কেমন একটা দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে হাওয়ার সঙ্গে নাকে আসিয়া লাগিতেছিল। যত অগ্রসর হইতেছিলাম, ততই সেটা বাড়িতেছিল। এখন হঠাৎ একটা দমকা বাতাসের সঙ্গে সেই দুর্গন্ধটা এমন বিকট হইয়া নাকে লাগিল যে, অসহ্য বোধ হইল। নাকে কাপড় চাপা দিয়া বলিলাম, নিশ্চয় কিছু পচেছে, ইন্দ্র!
ইন্দ্র বলিল, মড়া। আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা! সবাই ত পোড়াতে পারে না...মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে ফেলে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে খায় আর পচে। তারই অত গন্ধ।...
ঘাটের কাঁকরে ডিঙি ধাক্কা না খায়, এইজন্য ইন্দ্র পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত হইয়া মুখের কাছে সরিয়া আসিল এবং লাগিতে না লাগিতে লাফাইয়া পড়িয়াই একটা ভয়জড়িত স্বরে 'ইস্' করিয়া উঠিল। আমিও তাহার পশ্চাতে ছিলাম, সুতরাং উভয়েই প্রায় একসময়েই সেই বস্তুটির উপর দৃষ্টিপাত করিলাম। তবে সে নীচে, আমি নৌকার উপরে।...
অকালমৃত্যু বোধ করি আর কখনও তেমন করুণভাবে আমার চোখে পড়ে নাই। ইহা যে কত বড় হৃদয়ভেদী ব্যথার আধার, তাহা তেমন করিয়া না দেখিলে বোধ করি দেখাই হয় না! গভীর নিশীথে চারিদিক নিবিড় স্তব্ধতায় পরিপূর্ণ—শুধু মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের অন্তরালে শ্মশানচারী শৃগালের ক্ষুধার্ত কলহ-চিৎকার, কখন বা বৃক্ষোপবিষ্ট অর্ধসুপ্ত বৃহৎকায় পক্ষীর পক্ষতাড়নশব্দ, আর বহুদূরাগত তীব্র জলপ্রবাহের অবিশ্রাম হু-হু-হু আর্তনাদ—ইহার মধ্যে দাঁড়াইয়া উভয়েই নির্বাক্, নিস্তব্ধ হইয়া, এই মহাকরুণ দৃশ্যটির পানে চাহিয়া রহিলাম। একটি গৌরবর্ণ ছয়-সাত বৎসরের হৃষ্টপুষ্ট বালক?—তাহার সর্বাঙ্গ জলে ভাসিতেছে, শুধু মাথাটি ঘাটের উপর। শৃগালেরা বোধ করি জল হইতে তাহাকে এইমাত্র তুলিতেছিল, শুধু আমাদের আকস্মিক আগমনে নিকটে কোথাও গিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। খুব সম্ভব তিন-চারি ঘণ্টার অধিক তাহার মৃত্যু হয় নাই। ঠিক যেন বিসূচিকার নিদারুণ যাতনা ভোগ করিয়া সে বেচারা মা-গঙ্গার কোলের উপরেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। মা অতি সন্তর্পণে তাহার সুকুমার নধর দেহটিকে এইমাত্র কোল হইতে বিছানায় শোয়াইয়া দিতেছিলেন।...মুখ তুলিয়া দেখি, ইন্দ্রের দুই চোখ বাহিয়া বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ঝরিয়া পড়িতেছে। সে কহিল, তুই একটু সরে দাঁড়া শ্রীকান্ত, আমি এ বেচারাকে ডিঙিতে তুলে ঐ চড়ার ঝাউবনের মধ্যে জলে রেখে আসি!...'
শ্রীকান্ত উপন্যাসে মহামারি হিসেবে এসেছে প্লেগের কথাও। এ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব থেকে উদ্ধৃত করছি—
'পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফূট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন্। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশ দিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে, এবং সে Port Health Officer-এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে অবশ্য আলাদা কথা।…'
শ্রীকান্ত–এর দ্বিতীয় পর্বে যখন 'quarantine' বলে একটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয় বাংলা সাহিত্য, সে কি জানত, একদিন পৃথিবীজুড়ে চর্চিত হবে এই বিশেষ শব্দটি। কেই-বা জানত, বাংলা ভাষায় যেকোনো বাংলা শব্দের চেয়ে একদিন বেশি উচ্চারিত হবে এমন কঠিন একটি শব্দ। বার্মায় জাহাজঘাটায় নেমেই রেঙ্গুনে প্লেগের মড়ক ছড়ানোর খবরটি জানতে পেরেছিল শ্রীকান্ত, 'বর্মায় এখনও প্লেগ যায় নাই, তাই এই সতর্কতা। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া পাশ করিলে তবেই সে জাহাজে উঠিতে পাইবে।' মড়কের জন্য সমস্ত ডেকের যাত্রীদের দশ দিনের কোয়ারেন্টিনের বিবরণ পাওয়া যায়। আজও সে চিত্রের খুব ব্যত্যয় নেই, ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়াটি ১৪ দিন হয়েছে মাত্র।
শ্রীকান্ত উপন্যাসে কোয়ারেন্টিনের কথা অবশ্য পরেও পাওয়া যায়—
'ডাক্তারবাবু আমাকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, শ্রীকান্তবাবু, একখানা চিঠি যোগাড় না ক'রে আপনার আসা উচিত ছিল না; Quarantine-এ নিয়ে যেতে এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে কসাইখানায় গরু-ছাগল-ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না। তবে ছোটলোকেরা কোন রকমে সইতে পারে, শুধু ভদ্রলোকদেরই মর্মান্তিক ব্যাপার। একে ত মুটে নেই, নিজের সমস্ত জিনিস নিজে কাঁধে করে একটা সরু সিঁড়ি দিয়ে নামাতে ওঠাতে হয়- ততদূর বয়ে নিয়ে যেতে হয়; তার পরে সমস্ত জিনিসপত্র সেখানে খুলে ছাড়িয়ে স্টিমে ফুটিয়ে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে-মশাই এই রোদের মধ্যে কষ্টের আর অবধি থাকে না।'
বরাবরের মতো ছোটলোক-ভদ্রলোকের পার্থক্য দেখাতে দেখাতে শরৎচন্দ্র সে সময়ের সেই ভয়ংকর চিত্র এতটা স্পষ্ট করে এঁকেছেন যে আমাদের খুব সহজেই মনে পড়ে যায় করোনার এই ভয়াবহ সময়টিতে ইতালি ফেরত কয়েকজন প্রবাসীর হুংকার…।
প্লেগ, কলেরা ছাড়াও শ্রীকান্ত উপন্যাসে মহামারি হিসেবে উল্লেখ আছে বসন্ত ও ম্যালেরিয়ার। পাঠকের সামনে পরিচয় করানোর সময় রাজলক্ষ্মী সম্পর্কে শ্রীকান্তের বর্ণনাটি পাঠ করা যাক—
'স্বামী-পরিত্যক্তা মা সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মী দুই মেয়ে লইয়া বাপের বাড়ি চলিয়া আসে। ইহার বয়স তখন আট-নয় বৎসর, সুরলক্ষ্মীর বারো-তেরো। ইহার রঙটা বরাবর ফর্সা; কিন্তু ম্যালেরিয়া ও প্লীহায় পেটটা ধামার মত, হাত-পা কাঠির মত, মাথার চুলগুলো তামার শলার মত-কতগুলি তাহা গুনিয়া বলা যাইত।'
অন্যের শুশ্রূষা করতে গিয়ে শ্রীকান্ত নিজে বসন্তের কবলে পড়েছিল। পিয়ারী বাইজীরূপী রাজলক্ষ্মীর সেবা-যত্নে শ্রীকান্ত ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠে।
'সকালবেলা শোনা গেল, এই ছোটা-বড়া বাঘিয়া ত বটেই, আরও পাঁচ-সাতখানি গ্রামের মধ্যে তখন বসন্ত মহামারীরূপে দেখা দিয়াছে। দেখা গিয়াছে যে, গ্রামের এই-সকল দুঃসময়ের মধ্যেই সাধু-সন্ন্যাসীর সেবা বেশ সন্তোষজনক হয়।'
১৯২৬ সালে প্রকাশিত পথের দাবী উপন্যাসেও প্রচ্ছন্নভাবে মহামারির বর্ণনা আছে। এ উপন্যাসেও মহামারি হিসেবে এসেছে বসন্ত রোগ।
'ভারতী তেমনিই মৃদুকণ্ঠে বলিল, এদিকে অনেকের বসন্ত হচ্চে, তারও হয়েচে। কিন্তু আপনি ত এখন এত পরিশ্রমের পরে এ ঘরে ঢুকতে পারেন না। উপরের ঘরে চলুন, ঐখানে বরঞ্চ স্নান করে একটু জিরিয়ে নীচে আসবেন। তা ছাড়া ও ঘুমোচ্চে, জাগলে আপনাকে খবর দেব।…
ভারতী চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিতে লাগিল, কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলুন। এদিকে আরও দশজনের বসন্ত হচ্চে, তেওয়ারীরও হয়েচে—এ পর্যন্ত খুব সোজা।…
ভারতী কহিল, বাবা বেঁচে নেই, তিনি হাসপাতালেই মারা গেছেন।
মারা গেছেন? অপূর্ব অনেকক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া থাকিয়া বলিল, আপনার কালো কাপড় দেখে এমনি কোন একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা আমার পূর্বেই অনুমান করা উচিত ছিল।
ভারতী কহিল, তার চেয়েও বড় দুর্ঘটনা ঘটলো হঠাৎ মা যখন মারা গেলেন—
মা মারা গেছেন? অপূর্ব স্তব্ধ অসাড় হইয়া বসিয়া রহিল।…
দিন-চারেক পূর্বে সুমুখের বাড়ির নীচের ঘর থেকে বসন্ত-রোগী জন-দুই তেলেগু কুলীকে পুলিশের লোকে হাসপাতালে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের কান্না আর অনুনয়-বিনয় তেওয়ারী নিজের চোখে দেখেছে,—আমার পা-দুটো সে দু হাতে চেপে ধরে একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বললে, মাইজী, আমাকে পেলেগ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ো না তাহলে আমি আর বাঁচব না।...
হাতের কাজ শেষ করিয়া সে এই কথাগুলিই মনে মনে আবৃত্তি করিয়া এ ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল অপূর্ব অচেতন তেওয়ারীর অতি-বিকৃত মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া যেন পাথরের মূর্তির মত বসিয়া আছে, তাহার নিজের মুখ একেবারে ছাইয়ের মত সাদা। বসন্ত রোগ সে জীবনে দেখে নাই, ইহার ভীষণতা তাহার কল্পনার অগম্য।…
হঠাৎ অসুখের কথায় এ লইয়া যত আলোচনা সে রাত্রে হইয়াছিল সমস্ত এক নিমিষে মনে পড়িয়া অপূর্ব বসন্ত ছাড়া আর কিছু ভাবিতেই পারিল না। তাহার নূতন বাসায় দেখিবার কেহ নাই, হয়ত হাসপাতালে লইয়া গেছে, হয়ত এতদিনে বাঁচিয়াও নাই, মনে মনে সে একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল।'
৯২০ সালে প্রকাশিত গৃহদাহ উপন্যাসেও মহামারি হিসেবে আছে প্লেগের কথা। প্লেগ মানেই যেন মৃত্যু।মাঝুলি গ্রামে প্লেগের ভয়াবহতার মর্মান্তিক ও করুণ চিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।বন্ধুপত্নী অচলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং তার ধারাবাহিকতায় নিজের পাপবোধ থেকে রক্ষা পেতেইএ উপন্যাসের চরিত্র সুরেশ প্লেগাক্রান্ত এলাকায় চিকিৎসা সেবা দিতে যায়। প্লেগ নামের ভয়াবহ মহামারিতে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে গিয়ে নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় ভীষণ উদাসীন এই চরিত্রটি। প্লেগসংশ্লিষ্ট অংশবিশেষ পাঠ করা যাক—
'সুরেশ অভিনয়ের ভঙ্গিতে হাত-দুটো বাড়াইয়া দিয়া বলিল, না, না, এ ভুলের মার্জনা নেই। আমার অন্তরঙ্গ সুহৃদ আজ প্লেগে মৃতকল্প, আর আমি কিনা সমস্ত ভুলে গিয়ে, এখানে বসে বৃথা সময় নষ্ট করচি!
কেদারবাবু শশব্যস্ত হইয়া কহিলেন, বল কি সুরেশ, প্লেগ? যাবে নাকি সেখানে?
সুরেশ একটু হাসিয়া বলিল, নিশ্চয়! অনেক পূর্বেই আমার সেখানে যাওয়া উচিত ছিল।
কেদারবাবু অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, কিন্তু প্লেগ যে! তিনি কি তোমার এমন বিশেষ কোন আত্মীয়—
সুরেশ কহিল, আত্মীয়! আত্মীয়ের অনেক বড়, কেদারবাবু!...
অচলা স্থির হইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে নিজেও কিছু কিছু সংবাদ জানিত; সাত-আট ক্রোশ দূরে কতকগুলা গ্রাম যে সত্যই এ বৎসরে প্লেগে শ্মশান হইয়া যাইতেছে, এ খবর সে শুনিয়াছিল। শহর হইতে এতদূরে এই ভীষণ মহামারীতে দরিদ্রের চিকিৎসা করিতে যে চিকিৎসকের অভাব ঘটিবে, ইহাও বিচিত্র নয়। সুরেশ বহু টাকার ঔষধ-পথ্য যে গোপনে দিকে দিকে প্রেরণ করিতেছে, ইহাও সে টের পাইয়াছিল; এবং নিজেও প্রায় ভোরে উঠিয়া কোথাও-না-কোথাও চলিয়া যায়। ফিরিতে কখনো সন্ধ্যা, কখনো রাত্রি হয়—পরশু ত আসিতে পারে নাই, কিন্তু সে যে বাড়ি ছাড়িয়া, তাহাকে ছাড়িয়া, একেবারে কিছুদিনের মত সেই মরণের মাঝখানে গিয়া বাস করিবার সঙ্কল্প করিবে, ইহা সে কল্পনাও করে নাই। তাই কথাটা শুনিয়া ক্ষণকালের জন্য সে কেবল নিঃশব্দে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। এই যে মহাপাপিষ্ঠ, যে ভগবান মানে না, পাপ-পুণ্য মানে না, যে কেবলমাত্র বন্ধু ও তাহার নিরপরাধা স্ত্রীর এত বড় সর্বনাশ অবলীলাক্রমে সাধিয়া বসিল, কোন বাধা মানিল না—তাহার মুখের প্রতি সে যখনই চাহিয়াছে, তখনই সমস্ত মন বিতৃষ্ণায় বিষ হইয়া গিয়াছে—কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তাহারই পানে চাহিয়া সমস্ত অন্তর তাহার বিষে নয়, অকস্মাৎ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।'
১৯১৪ সালের উপন্যাসপণ্ডিতমশাই-এ মহামারি হিসেবে কলেরা বা ভেদবমির উল্লেখ পাই আমরা। গ্রামের একটিমাত্র পুকুরে কলেরা-আক্রান্ত রোগীর কাপড়চোপড় ধোয়া হয়। সেই পানি পান করে গ্রামে মড়ক লাগে। কলেরা দূর করতে পণ্ডিতমশাই বৃন্দাবন নলকূপের ব্যবস্থা করেন। পরে পণ্ডিতমশাইয়ের মা ও সন্তানও ভেদবমিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না।মিস্ত্রীপল্লীতে থাকার সময় বাসার নিচেই চক্রবর্তী উপাধিধারী এক মিস্ত্রীর কন্যা শান্তি দেবীকে বিয়ে করেন শরৎচন্দ্র। পিতা এক প্রৌঢ় ও মাতাল মিস্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলে সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে একদিন শরৎচন্দ্রের পায়ে পড়ে তাঁকে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন শান্তি দেবী। রক্ষা করতে গিয়ে শরৎচন্দ্র নিজেই বিয়ে করেছিলেন তাঁকে। সে সংসার সুখের ছিল। তাঁদের একটি পুত্রও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বছর, সে সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও শিশুপুত্র উভয়ের মৃত্যু হয়।
পণ্ডিতমশাই থেকে উদ্ধৃত করা যাক—
'বাঙ্গলাদেশের প্রায় প্রতি গ্রামেই যেমন আপনা-আপনি শিক্ষিত এক-আধজন ডাক্তার বাস করেন, এ গ্রামেও গোপাল ডাক্তার ছিলেন। কাল রাত্রে তাঁহাকে ডাকিতে যাওয়া হয়। কলেরা শুনিয়া তিনি দু ভিজিট নগদ প্রার্থনা করেন। কারণ, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে তিনি ঠিক জানিতেন, ধারে কারবার করিলে, এসব রোগে তাঁহার ঔষধ খাইয়া ছোটলোকগুলা পরদিন ভিজিট বুঝাইয়া দিবার জন্য বাঁচিয়া থাকে না।...
মা দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে আসিয়া বলিলেন, আমি ত চিনিনে বাছা, তোর পাঠশালার একটি ছাত্তর বাইরে বসে বড় কাঁদচে–তার বাপ নাকি ভেদবমি হয়ে আর উঠতে পারচে না।
বৃন্দাবন ঊর্দ্ধশ্বাসে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইতেই শিবু গোয়ালার ছেলে কাঁদিয়া উঠিল। পণ্ডিতমশাই, বাবা আর চেয়েও দেখচে না, কথাও বলচে না।…
আজ ছ'দিন হয়ে গেল, বৃন্দাবনের মা মরেচে—তা সে যা হবার হয়েচে, এখন মহাপ্রভু ছেলেটিকে বাঁচিয়ে দিন। কি নাম বাছা তার? চরণ না? আহা! রাজপুত্তর ছেলে, আজ সকালে তারও দু'বার ভেদবমি হয়েচে।…
মায়ের শ্রাদ্ধের আর দুইদিন বাকি আছে; সকালে বৃন্দাবন চণ্ডীমণ্ডপে কাজে ব্যস্ত ছিল, খবর পাইল, ভিতরে চরণের ভেদবমি হইতেছে। ছুটিয়া গিয়া দেখিল, সে নির্জীবের মত বিছানায় শুইয়া পড়িয়াছে এবং তাহার ভেদবমির চেহারায় বিসূচিকা মূর্তি ধরিয়া রহিয়াছে।
বৃন্দাবনের চোখের সুমুখে সমস্ত জগৎ নিবিড় অন্ধকারে ঢাকিয়া গেল, হাত-পা দুমড়াইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, একবার কেশবকে খবর দাও, বলিয়া সে সন্তানের শয্যার নীচে মড়ার মত শুইয়া পড়িল।'
জাত-পাতের দ্বন্দ্ব, দলাদলি, গ্রাম্য রাজনীতি—এত সব ঘিরে লতার মতো বেয়ে বেয়ে ওঠে মহামারির বিভীষিকা। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাসপল্লী সমাজ-এ কখনো প্রকাশ্যে, কখনো আড়ালে হলেও পাওয়া যায় ম্যালেরিয়ার উপস্থিতি—
'প্রভুর আদেশ মত ভিতর হইতে গোটা-তিনেক রেকাবি ও জলের গেলাস আসিল এবং দেখিতে দেখিতে এই বৃহৎ থালার অর্ধেক মিষ্টান্ন এই তিন প্রাচীন ম্যালেরিয়া ক্লিষ্ট সদ্ব্রাহ্মণের জলযোগে নিঃশেষিত হইয়া গেল।…
বর্ষা শেষ হইয়া আগামী পূজার আনন্দ এবং ম্যালেরিয়া ভীতি বাঙ্গালার পল্লী-জননীর আকাশে, বাতাসে এবং আলোকে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল, রমেশও জ্বরে পড়িল। গত বৎসর এই রাক্ষসীর আক্রমণকে সে উপেক্ষা করিয়াছিল; কিন্তু এ বৎসর আর পারিল না।...তিন দিন জ্বরভোগের পর আজ সকালে উঠিয়া খুব খানিকটা কুইনিন্ গিলিয়া লইয়া ভাবিতেছিল, গ্রামের এই সমস্ত অনাবশ্যক ডোবা ও জঙ্গলের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীকে সচেতন করা সম্ভব কি না। এই তিন দিন মাত্র জ্বরভোগ করিয়াই সে স্পষ্ট বুঝিয়াছিল, যা হউক কিছু একটা করিতেই হইবে।...
রমেশ সন্ধান লইয়া জানিয়াছিল, এমন অনেক গ্রাম পাশাপাশি আছে যেখানে একটা গ্রাম ম্যালেরিয়ায় উজাড় হইতেছে, অথচ আর একটায় ইহার প্রকোপ নাই বলিলেই হয়।...
বিশ্বেশ্বরী তার শিয়রে আসিয়া বসিলেন এবং মাথায় মুখে হাত বুলাইতে লাগিলেন। আজ তিন মাসকাল রমা শয্যাগত। বুক জুড়িয়া কাসি এবং ম্যালেরিয়ার বিষে সর্বাঙ্গ সমাচ্ছন্ন। গ্রামের প্রাচীন কবিরাজ প্রাণপণে ইহার বৃথা চিকিৎসা করিয়া মরিতেছে। সে বুড়া ত জানে না কিসের অবিশ্রাম আক্রমণে তাহার সমস্ত স্নায়ুশিরা অহর্নিশি পুড়িয়া খাক হইয়া যাইতেছে। শুধু বিশ্বেশ্বরীর মনের মধ্যে একটা সংশয়ের ছায়া ধীরে ধীরে গাঢ় হইয়া উঠিতেছিল। রমাকে তিনি কন্যার মতই স্নেহ করিতেন, সেখানে কোন ফাঁকি ছিল না; তাই সে অত্যন্ত স্নেহই রমার সম্বন্ধে তাঁহার সত্যদৃষ্টিকে অসামান্যরূপে তীক্ষ্ণ করিয়া দিতেছিল। অপরে যখন ভুল বুঝিয়া, ভুল আশা করিয়া, ভুল ব্যবস্থা করিতে লাগিল, তাঁহার তখন বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তিনি দেখিতেছিলেন রমার চোখ-দুটি গভীর কোটরপ্রবিষ্ট, কিন্তু দৃষ্টি অতিশয় তীব্র। যেন বহুদূরের কিছু-একটা অত্যন্ত কাছে করিয়া দেখিবার একাগ্র বাসনায় এরূপ অসাধারণ তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে।'
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেনাপাওনা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। এ উপন্যাসের একটি চরিত্র পরাক্রান্ত এক ভূস্বামী জীবানন্দ। দীন গৃহহীন উমাচরণের বিসূচিকা বা কলেরায় মৃত স্ত্রীর কথা জেনে তিনি কাঁদেন, 'এই ফাল্গুনের শেষে বিসূচিকা রোগে তাহার স্ত্রী মরিয়াছে, উপযুক্ত দুই পুত্র একে একে চোখের উপর বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে, সে কোন উপায় করিতে পারে নাই; অবশেষে জীর্ণ ঘরখানি সে তাহার বিধবা ভ্রাতুষ্কন্যাকে দান করিয়া চিরদিনের মত গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছে। এ জীবনে আর তাহার ফিরিবার আশা নাই, ইচ্ছা নাই; এই বলিয়া সে ছেলেমানুষের মত হাউহাউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল।'
১৯৩১ সালের উপন্যাস শেষ প্রশ্ন–এর শুরুর পরিচ্ছদটি পাঠ করা যাক—
'বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন কর্মোপলক্ষে আসিয়া অনেকগুলি বাঙালী পরিবার পশ্চিমের বহুখ্যাত আগ্রা শহরে বসবাস করিয়াছিলেন। কেহ-বা কয়েক পুরুষের বাসিন্দা, কেহ-বা এখনও বাসাড়ে। বসন্তের মহামারী ও প্লেগের তাড়াহুড়া ছাড়া ইঁহাদের অতিশয় নির্বিঘ্ন জীবন।'
১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র একবার দুরারোগ্য পা-ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি অফিসে এক বছরের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসে কবিরাজি চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। হরিদাস চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'এ শুনি বর্মা দেশের ব্যারাম। দেশ না ছাড়িলে কোনদিন এও ছাড়ে না। তাই দুয়ের এক বোধ করি অনিবার্য হইয়া উঠিতেছে। কি জানি, ভগবানই জানেন। ভয় হয়, হয়ত বা চিরজীবন পঙ্গু হইয়াই যাইব।... ডান পায়ের হাঁটুর নীচ হইতে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত সে এক প্রকাণ্ড কাণ্ড।' পরে তিনি চাকরিতেই ইস্তফা দিয়ে রেঙ্গুন ছেড়ে দেশে চলে আসেন।
শেষ প্রশ্ন উপন্যাসটির শুরুর ওই অংশটুকুর মতোই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অজস্র গল্প-উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে মহামারির কথা, যেভাবে গত দুই শতকে অজস্রবার বাংলা কথাসাহিত্যে এসেছে মহামারি-প্রসঙ্গ। শরতের উপন্যাসে কখনো কখনো এই মহামারি ভূতের মতো সওয়ার হয়েছে বসন্ত হয়ে, কখনো কলেরা, বিসূচিকা বা ভেদবমি হয়ে, আবার কখনো প্লেগ হয়ে। কখনো লালু, কখনো শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ, বৃন্দাবন, গোপালখুড়োর মতো অনেক চরিত্র ঘুরেফিরে মহামারির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত অন্য কোনো সাহিত্যিকই এত এত লেখা লেখেননি মহামারিকে উপজীব্য করে।
একের পর এক অসুখবিসুখকে সঙ্গী করা শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যে অসুখ ও মহামারি বা মড়ক যেভাবে এসেছে, তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আজ এই কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতাও নির্মোহভাবে চিত্রিত হতো শরৎচন্দ্রের কলমে। কে জানে, তখন কোন চরিত্রটি আমাদের কাঁদাত, হাসাত, সাহস জোগাত; আমরাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম, পিঠ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতাম মহামারির বিরুদ্ধে।