মিম!
একবিংশ শতকের প্রথম দিকটা কেমন ছিল, দ্বাবিংশ শতকে কেউ এই প্রশ্ন করলে খুব সহজে উত্তর দেওয়া যাবে: তখনকার মিমগুলো রিট্রিভ করে একবার দেখে নিন।
দৃশ্যটি ভাবুন (কিংবা দেখুন), হিলারি ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের আগক্ষণে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছেন তার স্বামী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। খুশিতে আটখানা হয়ে তিনি বলছেন 'Just Realized if Hillary wins I get interns,' হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে হোয়াইট হাউসে কজন ইনটার্ন তো আসছেই, হয়ত তার মধ্যে ক্লিনটনের জন্য একজন মনিকা লিউনস্কি থাকতেন।
বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউনস্কি
একটি হাস্যোজ্জল ছবি এবং একটি বাক্য আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল স্ক্যান্ডালের একটি অধ্যায় তুলে ধরল। উঠে এসেছে ক্লিনটনের লাগাতার কেলেঙ্কারি- মনিকা লিউনস্কিকে নিয়ে জিপারগেট, মনিকার নীল স্কার্ট উপাখ্যান, শপথ নিয়ে ক্লিনটনের মিথ্যাচার এবং ইমপিচমেন্ট থেকে বেঁচে যাবার কাহিনী, কিন্তু হিলারি যদি জিতে যান হিলারি বিজয়ে তার যতনা আনন্দ তার চেয়ে বেশি আনন্দ হোয়াইট হাউসে ইনটার্নদের পাওয়া।
বব অ্যান্ড স্যালি মিম
বব ও তার বান্ধবী স্যালিকে নিয়ে হাজারটা মিম হয়েছে। তার মধ্যে দুটো তুলে ধরছি:
১. কার্টুন ধরনের ছবিতে বব ও স্যালি হাত ধরাধরি করে আছে, নিচে লেখা আছে: এই হচ্ছে বব, সে রিপাবলিকান, এই হচ্ছে ববের বান্ধবী স্যালি, সে ডেমোক্র্যাট। তারপরও বব ও স্যালি অন্তরঙ্গ বন্ধু কারণ দু'জনই বোমা মেরে ইরানকে ধ্বংস করতে চায়।
২. অন্যটিতে বব আর স্যালি হাত ধরাধরি করে আছে। বব ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে, স্যালি জো বাইডেনকে। তারপরও দুজন এক বিছানায় ঘুমায়, কারণ দুজনই প্রাপ্ত বয়ষ্ক।
জীববৈজ্ঞানিক মিম
মিম শব্দটি মিমেম থেকে একটুখানি সংক্ষেপকৃত, মূল শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ মিমেমা থেকে; মিমেমা মানে অনুকরণকৃত কিছু। আমার মতে, আমরা সাধারণভাবে যাকে ভেংচি কাটা বা ভেঙ্গানো বলি- এমন একটি কিছু।
রিচার্ড ডাউকিন্স
ব্রিটিশ অভিব্যক্তিবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডাউকিন্স ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তার দ্য সেলফিশ জিন আলোচিত গ্রন্থে অভিব্যক্তির এই ধারণটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তিনিই এই নতুন ধারনার উদ্ভাবক এমন দাবি করেন নি। তিনি টি এইচ হাক্সলি, রিচার্ড সেমন প্রমুখের কাজ এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। রিচার্ড ডাউকিন্স নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রাণী-আচরণ বিজ্ঞানী নিকোলাস টিনবার্জেনের সরাসরি ছাত্র এবং তার গবেষণাও বৃহদার্থে আচরণের কার্যকারণ নিয়ে। ডাউকিন্স তার কাজের প্রেরণাদাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সুপ্রজনন বিজ্ঞানী এল এল কাভালি স্ফ্রোজা, নৃবিজ্ঞানী এফ টি ক্লক এবং আচরণ বিজ্ঞানী জে এম কালেনকে।
দ্য সেলফিশ জিন
জীবতাত্ত্বিক ও আচরনগত গুণাগুণ জিনই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তর করে। ডাউকিন্স মিমকে ব্যাখ্যা করেছেন সাংস্কৃতিক গুণাগুণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরের একক হিসেবে, যা পূর্বগুণ অনুকরণ করতে পারে এবং তার বিস্তার ঘটাতে পারে। ডিএনএ-ও জীবতাত্ত্বিক কার্যক্রমের মাধ্যমে যেমন জেনেটিক্স বা সুপ্রজনন বিজ্ঞানের প্রমাণ আহরণ করা যায় মিমের ক্ষেত্রে সে ধরণের বৈজ্ঞানিক আকাট্যতা প্রতিষ্ঠিত নয়। মিমের ক্ষেত্রে প্রয়োজন দেহ মাধ্যম- ফোটন (Photon), শব্দ তরঙ্গ, স্পর্শ, স্বাদ, ঘ্রাণ- কেবল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে স্থানান্তরণ ঘটে। ডাউকিন্স মিমকে বলছেন সেলফিশ জিন বা স্বার্থপর জিন। জিনের উপর মিম নির্ভরশীল নয়; মিমের বিস্তার সাফল্য একই রকম নয়। সফল মিম রয়ে যায় এবং বিস্তার লাভ করে। ডাউকিন্স মনে করেন জীবনের সম্প্রসার উলম্বও হতে পারে- যেমন বাবামা থেকে সন্তান, আবার আনুভূমিকও হতে পারে যেমন ভাইরাস কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে।
সৃজনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সক্রেটিসের জিন আজকের বিশ্বে থাকতে পারে, বিলীন হয়েও যেতে পারে- তাতে কার কি এসে যায়। কিন্তু সক্রেটিন্স, লিওনার্দো, কিংবা কোপার্নিকাসের মিম কমপ্লেক্স বহমান। কারণ তাদের সৃস্টিশীল কীর্তির কথা আমরা হামেশাই বলি।
সহজভাবে বলা যায় সাংস্কৃতিক গুণাগুণ বহণকারী ইউনিট হচ্ছে মিম। মিমের আকার কেমন, সংখ্যা কতো এগুলো বিবেচনায় আসেনি। ডাউকিন্স অভিব্যক্তি সংগঠনের জন্য ভ্যারিয়েশনও হেরেডিটি-র কথা বলেছেন এবং মিম এককের ফিটনেস- বিভিন্ন পরিবেশে ভালোভাবে বা মন্দভাবে টিকে থাকার উপর জোর দিয়েছেন।
১৯৮০-র দশকে ব্যক্তির সাংস্কৃতিক তথ্য সম্প্রচার ও সম্প্রসারের অভিব্যক্তিবাদী মডেল পাঠের বিদ্যা- মিমিটিক্স চালু হয়েছে। অবশ্য বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একে ছদ্মবৈজ্ঞানিক পাঠও বলে থাকেন এবং বিজ্ঞানের জন্য একে বিপদজনক ধারণাও মনে করেন। ব্রিটিশ দর্শনিক জন গ্রে ডাউকিন্স এবং মিমিট্রিক্স পাঠ সবই 'ননসেন্স' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
জ্যাক বালকান 'কালচারাল সফটওয়ার' তত্ত্ব দিয়ে বর্ণবাদকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করেন যে মিমের কারণ মানুষের সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং শিল্পমন। যে মানুষ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলে সেই মানুষই আবার বর্ণবাদী আচরণ করে।
মিম কেন্দ্রিক নতুন শব্দপুঞ্জ: মিমপ্লেক্স, মিম পুল, মিমেটিক ইজ্ঞিনিয়ারিং, মিমেটিক এলগরিদমস, মিমোটাইপ, মিমোইড, মিমেটিক ইকুইলিব্রিয়াম, মেটাসিমোটিক থিঙ্কিং; ইউমিমিক্স এবং মিমোসাইড।
যেমন মিমোসাইড শব্দটি বিবেচনা করা যাক। সাইড তো অবশ্য হত্যা, এটি হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্গত মিম এবং মিমপ্লেক্স বহণকারী সত্ত্বাকে হত্যা করা অথবা তার প্রচারণার উপর সেন্সর আরোপ করা কিংবা তার বাহক বা প্রচারককে শাস্তির আওতায় আনা। বিশেষ করে স্বৈরাচারী শাসকের আমলে তা বেশি করে দৃশ্যমান হয়।
ইন্টারনেট মিম
ডাউকিন্স বলেন ইন্টারনেটে মিম জীববিজ্ঞানের মিম ধারণা হাইজাক করে সম্প্রচার করা হচ্ছে। অবশ্য তাতে তেমন সমস্যা নেই। উভয় ক্ষেত্রেই আচরণগত বিষয় প্রাধাণ্য পায়।
ব্যক্তি বা গোষ্ঠির আচরণ, শৈলী, ধারণা ইত্যাদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যখন প্রচারিত হয়, তা বিভিন্ন ভাবে বিস্তার লাভ করে- তখন তা ইন্টারনেট মিম বা মিম নামে চিহ্নিত হয়। একে দু'ভাবে দেখা হয়: একটি হচ্ছে সৃষ্টিশীল পূণর্জন্ম, তাতে প্যারোডি রিমিক্স ইত্যাদি থাকে; অন্যটি হচ্ছে ইন্টারটেক্সুয়ালিটি।
মিম সম্প্রচারের ধরাবাধা কোনো পদ্ধতি কেউ আরোপ করেনি- এটা মিমিক্রি হতে পারে। রিমিক্সও হতে পারে। মানুষ, জন্তু, আঁকা ছবি ব্যবহার করে কখনো একটি বা দুটো শব্দ বসিয়ে কখনো বাক্য কিংবা ডায়লগ কিংবা মন্তব্য বসিয়ে প্রেরণ উপযোগী করা হয়।
মাস্কড মোনালিসা
কেবল মোনালিসার মুখের উপর মাস্ক বসিয়ে কোনো শব্দ বাক্য মন্তব্য যোগ না করে করোনাকালের অনেক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, ব্যক্তিক যৌন হরেক ধরনের বিষয় নিয়ে মিম প্রচার হচ্ছে।
সাহিত্য শিল্পের অ্যাবসার্ডিজম, সুররিয়েলিজম কিংবা ম্যাজিক রিয়েলিজমের আলোকেও অনেক মিমকে বিশ্লেষণ করা যাবে। মিম কেবল ইমেজে সীমাবন্ধ নয়, ছোট্ট ভিডিও ক্লিপেও সম্প্রচারিত হচ্ছে। মিম পণ্যের বাজারে বিপননে ভূমিকা রাখছে দুভাবে- ভাইরাল মার্কেটিং এবং গেরিলা মার্কেটিং। বিপননের নতুন একটি ধারাই সৃষ্টি হয়েছে মিমেটিক মার্কেটিং। মিম বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে কস্ট এফেক্টিভ মাধ্যম।
রাজনীতিরও অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠছে- দলীয় প্রচারণা এবং বিরুদ্ধ প্রচারণা দুটোতে মিম রাজত্ব করছে। ২০১০ থেকে প্রায় সব দেশেই নির্বাচনের হাতিয়ার মিম। সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টিতে এবং আন্দোলনে ঢেউ তুলতে দক্ষ ও আবেদন সৃষ্টিকারী মিমের জুড়ি নেই। তবে মিমের অপব্যবহারও হচ্ছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠির অনুভূতিতে আঘাত বিশেষ করে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। পশ্চিমের দেশগুলোতে মিম কপিরাইট আওতায় চলে এসেছে। মিম অনুধাবন ও উপভোগ করার ক্ষেত্রে ডাউকিন্স সেভাবে দেখেছেন ব্যক্তি ও সমষ্টির সাংস্কৃতিক বিকাশ খুবই জরুরী আর সে কাজটিই করে থাকে জীবতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সীমাবদ্ধতার বাইরের মিম- সেলফিশ জিন।
এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না- এমনই বিশাল ছিল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। অসীম ক্ষমতাধর ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর ক্ষমতা বোঝাতে তাতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে দেখা যাচ্ছে একটি সাগরে ডলফিনের পাশে। ছবিটিতে লেখা হয়েছে: ইংল্যান্ডের রানি ব্রিটিশ জলসীমার সকল ডলফিনের মালিক।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টি-বয় জীবনের কথা সবারই জানা। তাকে নিয়ে চমৎকার একটি মিম: এই চা বিক্রোতাই জাতিকে দিতে পারে Uni-tea, Equali-tea, Safe-tea Gi Prosperi-tea.
ভাষার নিজস্বতা যৌন বিষয় চমৎকার ভাবে প্রকাশ করে। ভায়াগ্রার চালান চুরি হয়ে গেছে। এর পর পুলিশের কাজ কি?
COPS LOOKING FOR GANG OF HARDENFD CRIMINALS
মার্ক জাকার্কবার্গের মাকুন্দা চেহারটি মনে করুন। তার ছবির উপরে লেখা: ২১ বছর পর্যন্ত যার দাঁড়ি গজায় না, তিনি বিলিয়নিয়ার হবেন।
কুকুর ওয়াল স্ট্রিট গ্রিড বন্ধ করার আহবান জানাচ্ছে: আমার ভাগের হাড় চুরি থামাও।