যে বিতর্ক কখনও ম্যাডোনার পিছু ছাড়েনি
ম্যাডোনা লুইজ ভেরোনিকা সিকোন তখনো সুপারস্টার হননি। ছোটখাটো কাজ করে পেট চালাতেন। পাশাপাশি বাড়তি রোজগারের জন্য নাচতেন। কিন্তু শিগগিরই চাকরি খোয়ালেন তিনি।
তার কয়েক দিন পর জানতে পারলেন, নিউইয়র্কের নিউ স্কুলের আর্ট ও ফটোগ্রাফির শিক্ষার্থীদের ন্যুড ফটোগ্রাফি শেখানোর ক্লাস চলছে। সেখানে মডেল হিসেবে কাজ করলে ভালো টাকা পাবেন। কাজেই বিশ বছর বয়সী ম্যাডোনা পেট চালানোর জন্য তিন ঘণ্টা করে ন্যুড মডেল হিসেবে পোজ দিতে শুরু করলেন।
নিউ স্কুলে কাজ করার সময় প্রায়ই উদীয়মান ফটোগ্রাফাররা ম্যাডোনাকে তাঁদের ব্যক্তিগত 'স্টুডিও'তে গিয়ে পোজ দেওয়ার প্রস্তাব দিতেন। এই ব্যক্তিগত স্টুডিওগুলোর অধিকাংশই ছিল অ্যাপার্টমেন্ট অথবা অপরিচ্ছন্ন কোনো কামরা। তবে যথেষ্ট টাকা পেতেন বলে অমন পরিবেশে কাজ করতে ম্যাডোনার কোনো আপত্তি ছিল না। ১৯৯৮ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'বেশ ভালো অঙ্কের টাকা পাওয়া যেত, আর সুবিধামতো সময়ে কাজ করার সুযোগও ছিল। এ জন্যই এ কাজ বেছে নিয়েছিলাম আমি। কাপড় খুলে বসে থাকতে ভালো লাগত বলে এ কাজে নামিনি।'
১৯৭৯ সালে অভিনেত্রী চেয়ে একটা বিজ্ঞাপন দেখেন ম্যাডোনা। ছবিটির জন্য অডিশন দিয়ে ব্রুনা নামের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। ব্রুনার চরিত্র ছিল এক যৌনদাসির। ওই যৌনদাসি এক 'স্বাভাবিক' তরুণের প্রেমে পড়ে যায়। সবচেয়ে উদার সমালোচকরাও ওই ছবিকে সমালোচনার চাবুকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন।
'আ সারটেইন স্যাক্রিফাইস' ছবিতে ম্যাডোনাকে কয়েকবার নগ্ন হয়ে এমন দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে, যা সে সময় 'সফট পর্ন' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।
ম্যাডোনার বাবা ছিলেন গোঁড়া ইটালিয়ান। তাই বাবা তাঁর মডেলিং ও অভিনয়ের কথা জানুক, তা চাননি ম্যাডোনা। সত্যি বলতে কী, মেয়েকে নিউইয়র্কেই আসতে দিতে চাননি তিনি। তাই ম্যাডোনা স্থির করলেন, এ রকম খোলামেলা মডেলিং ও অভিনয়ের কথা বাবাকে জানাবেন না। তিনি আশা করেছিলেন, বাবা কখনো এ ব্যাপারে জানতে পারবেন না।
কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বজুড়ে তুমুল খ্যাতি পেয়ে যাবেন, তা কি আর ভাবতে পেরেছিলেন ম্যাডোনা?
১৯৮৫ সাল। ম্যাডোনার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। সে সময় তাঁর নগ্ন ছবি তোলা দুই ফটোগ্রাফার, মার্টিন শ্রিবার ও লি ফ্রাইডল্যান্ডার ঠিক করলেন ওই নগ্ন ছবি ও ম্যাডোনার খ্যাতিকে পুঁজি করে বেশ দু-পয়সা কামিয়ে নেবেন। নগ্ন ছবিগুলো প্লেবয় ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করে দেন দুই ফটোগ্রাফার।
ম্যাগাজিনটির ১৫ জুলাই ১৯৮৫ সংখ্যায় ছাপা হয় ম্যাডোনার নগ্ন ছবি। এর তিন দিন পরই পেন্টহাউস ম্যাগাজিনেও সতেরো পাতাজুড়ে ছাপা হয় এ তারকার নগ্ন ছবি। পেন্টহাউসে ছাপা ছবিগুলো তুলেছিলেন বিল স্টোন।
পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়ে এগুলোর সঙ্গে মুক্তি পায় 'আ সারটেইন স্যাক্রিফাইস'। ছবিটির মুক্তি আটকানোর চেষ্টা করেও আইনি লড়াইয়ে হেরে যান ম্যাডোনা। পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে এই ছবি। প্রকাশ্যে ম্যাডোনা বলেছিলেন, নগ্ন দৃশ্যের কারণে নয়, নিজের জঘন্য অভিনয়ের কারণেই 'আ সারটেইন স্যাক্রিফাইস'-এর মুক্তি আটকে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নিজের অতীতজীবন এভাবে ফিরে আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই নগ্নতা কেলেঙ্কারিতে মিশিগানে বসবাসরত ম্যাডোনার পরিবার ভীষণ অস্বস্তি ও বিড়ম্বনায় পড়ে। ভীষণ খেপে যান তাঁর বাবা। আর নাতনির নগ্ন ছবির খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ম্যাডোনার দাদি। ছবিগুলো যখন প্রকাশ পায়, সে সময়ই ফিলাডেলফিয়ায় বব গেলডলফের 'লাইভ এইড' কনসার্টে নাচার কথা ছিল ম্যাডোনার।
অনেকেরই ধারণা ছিল, এ ঘটনার পর তিনি আর ওই কনসার্টে যাবেন না। কিন্তু ম্যাডোনা তাঁর নিজস্ব ঢঙে ঘোষণা দেন, ন্যুড কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি মোটেও লজ্জিত নন। তখনকার প্রেমিক শন পেনকে সঙ্গে নিয়ে ওই কনসার্টে হাজির হন পপসম্রাজ্ঞী।
ম্যাডোনা তখন হুটহাট অন্তর্বাস পরে বাইরে বেরিয়ে পড়ার জন্য তুমুল আলোচিত চরিত্র। কিন্তু লাইভ এইড কনসার্টে সেদিন তিনি হাজির হন ট্রাউজার, শার্ট ও লম্বা জ্যাকেট পরে। উপস্থিত দর্শকেরা তাঁকে 'কোট খুলে ফেলতে বললে তিনি একবাক্যে সেই দাবি নাকচ করে দেন।
দারুণ বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধের সাহায্যে নগ্নতা কেলেঙ্কারির সময় ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছিলেন ম্যাডোনা। এই পর্ব শেষ হওয়ার পর তাঁর 'অতীত-কর্ম' নিয়ে আর কোনো ভক্তই মাথা ঘামায়নি। কিন্তু সাত বছর পর তিনি যখন সিদ্ধান্ত নিলেন, 'সেক্স' নামের একটা বই প্রকাশ করবেন, তখন আর তাঁর প্রতি কেউ অত উদার মনোভাব দেখায়নি। 'সেক্স' বইটি ছিল এই পপ তারকার বিভিন্ন যৌনাবেদনময় ছবিতে ভর্তি। সিংহভাগ ছবিতেই তিনি হয় সম্পূর্ণ নগ্ন অথবা অর্ধনগ্ন ছিলেন। সে বছরই তিনি 'ইরোটিকা' গানের জন্য এসঅ্যান্ডএম থেকে অনুপ্রাণিত একটি ভিডিও ছাড়েন। সবশেষে নাটকীয়তার ষোলোকলা পূর্ণ করে ম্যাডোনা অভিনয় করেন বডি অব এভিডেন্স ছবির মূল চরিত্রে। এই ইরোটিক থ্রিলারে তাঁকে শুধু নগ্নই হতে হয়নি, অভিনয় করতে হয়েছে বেশ কয়েকটি যৌনদৃশ্যেও।
কিন্তু এবার আর খোলামেলা শরীর প্রদর্শন ও যৌনতার প্রশ্নে ছাড় পেলেন না ম্যাডোনা। ভক্তরা মুখ ফিরিয়ে নিল তাঁর কাছ থেকে। হু হু করে কমে গেল ম্যাডোনার অ্যালবামের বিক্রি। সমালোচনার বাণে জর্জরিত হলো বডি অব এভিডেন্স। যদিও ম্যাডোনা খোলামেলা শরীর প্রদর্শনে কতটা বাড়াবাড়ি করেছেন, তা দেখার জন্য লোকে ঠিকই ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে গেছে।
খ্যাতির তুঙ্গে থাকলেও 'সেক্স' প্রকাশের পর কয়েক বছর ম্যাডোনার ক্যারিয়ার টলমল হয়ে যায়। অনেকেই তখন তাঁর শেষ দেখে ফেলেছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ফের সদর্পে ফিরে আসেন ম্যাডোনা। সে বছর মুক্তি পাওয়া ছবি ইভিটার কল্যাণে জোয়ার আসে তাঁর ক্যারিয়ারে।
ম্যাডোনা দাবি করেন, 'সেক্স' বইটি ছিল একধরনের বিদ্রোহ। তাঁর ভাষায়, এটি ছিল মানুষের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ বই প্রকাশের জন্য কোনো অনুশোচনা ছিল না ম্যাডোনার মনে। তবে তত দিনে তিনি পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েছেন। পপসম্রাজ্ঞী ভেবেছিলেন, নগ্নতার মাধ্যমে নিজের শিল্প প্রদর্শনের সময় বা আকাঙ্ক্ষা দুটোই বুঝি ফুরিয়েছে। কিন্তু কে ভাবতে পেরেছিল, ২০১২ সালে, এমডিএনএ ট্যুরের ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই, প্রায় চুয়ান্ন ছুঁই ছুঁই এই গায়িকা তুরস্কে গিয়ে ফের এমন কাজ করে বসবেন?
১৯৯৫-এর হিট গান 'হিউম্যান নেচার' গাওয়ার সময় মঞ্চের একেবারে প্রান্তে, ভক্তদের খুব কাছাকাছি চলে যান ম্যাডোনা। তারপর সহসা ভক্তদের সামনে গা থেকে কস্টিউম খুলে ফেলেন তিনি। ঊর্ধ্বাঙ্গে থাকে শুধু একটা ব্রা। খানিক পর আচমকা সেই ব্রার একপাশও খুলে ফেললে তাঁর ডান বুক সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে যায়। উল্লাসে ফেটে পড়ে ভক্তরা। এবার দর্শক-শ্রোতার দিকে পিছু ফিরে ট্রাউজার খুলে ফেলেন ম্যাডোনা, হাত চলে যায় কটিসন্ধিতে। এভাবে খানিকক্ষণ উন্মুক্ত নিতম্ব প্রদর্শন করার পর ফের কাপড় পরে নেন পপসম্রাজ্ঞী।
ম্যাডোনার এই কাজ পূর্বপরিকল্পিত ছিল, নাকি মুহূর্তের খেয়ালে হয়ে গেছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে এই ঘটনার ভিডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে, পৃথিবীজুড়ে খবরের কাগজগুলো সয়লাব হয়ে যায় এ-সংক্রান্ত খবরে। বেশির ভাগ মন্তব্যই ছিল নেতিবাচক ও অপমানজনক। কিন্তু ম্যাডোনা যা চেয়েছিলেন, তাঁর ট্যুর ও নতুন অ্যালবামের জন্য প্রচারণা, তা তিনি ঠিকই পেয়ে যান।
তুরস্ক থেকে পপসম্রাজ্ঞী যান রোমে পারফর্ম করতে। অডিটরিয়ামে দর্শক ভেঙে পড়ে, ম্যাডোনার 'কীর্তি'র প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার লোভে। কিন্তু এবার আর তুরস্কের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো না। পপসম্রাজ্ঞী 'হিউম্যান নেচার' গাইলেন ঠিকই, কিন্তু ব্রা খুলে বক্ষ প্রদর্শন করলেন না। অবশ্য সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে দর্শকদের দিকে পিছু ফিরে ট্রাউজার খুলে নিতম্ব প্রদর্শন করলেন। আবারও খবরের শিরোনাম হলো এ ঘটনা; আবারও বিনা পয়সায় প্রচারণা পেয়ে গেলেন ম্যাডোনা।
২০১২ সালে ম্যাডোনার ট্যুরের বাকি সময়টা এভাবেই চলল। অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে দুলতে দর্শক আসে তাঁর কনসার্টে। কখনো কখনো ভক্তদের সামনে শরীর দেখান ম্যাডোনা, কখনো কখনো দেখান না। তবে যখনই শরীর উন্মুক্ত করতেন, সেই দৃশ্যের ছবি ছড়িয়ে পড়ত গোটা দুনিয়ায়।
এমডিএনএ ট্যুর শেষ হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। সে বছরের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী ট্যুর ছিল এমডিএনএ। অনেকের দাবি, নগ্নতার জন্যই ওই ট্যুর থেকে এত বেশি টাকা এসেছিল। কিন্তু দাবিটা ভিত্তিহীন। কেননা তুরস্কে ওই নগ্নতা-পর্ব শুরু হওয়ার বহু আগেই সবগুলো কনসার্টের সিংহভাগ টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
এ কথা সত্যি যে ম্যাডোনার নগ্নতাপ্রীতি তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ও অসংখ্য মুখরোচক খবরের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও সত্যি যে মেধা ও স্থির সংকল্প না থাকলে স্রেফ নগ্নতা দিয়ে বেশি দিন জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ম্যাডোনাও শারীরিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি মেধা, পরিশ্রম ও সংকল্প দিয়েই পপসম্রাজ্ঞী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। সাফল্যের এই সফরে নগ্নতা কেবল তাঁকে আলোচনায় আসতে সামান্যই সাহায্য করেছে।