জাদুবাস্তবতার দিন
১
কোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রায় বৃত্তাকার পথ আজ লুপ্ত। যে জায়গাটায় দাঁড়ালে অনেকটাই চট্টগ্রাম দেখা যেত, সেখানে বেশ কয়েকটা ছোট চায়ের দোকান। সস্তা বিস্কিট-চা।
অক্টোবরের শেষ দিকে, পুজোর পর শীত আসি আসি গন্ধ যে ভোরের শীতল বাতাসে, তেমনই এক ভোরে আমি লোকটাকে প্রথম দেখেছিলাম, কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওঠার পথে পুরোনো বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের ফুটপাথে।
চোখে পড়ার মতো লম্বা নয় আবার খাটোও নয়, সব মিলে মনে হয় অন্য কোনো সময় বা সভ্যতা থেকে উঠে আসা মানুষ। একবার তাকিয়েছিল, বাসাভাঙা পাখিদের মতো বিপন্ন দৃষ্টি। তাকে আবার দেখলাম, স্কুল থেকে ফিরে ফুটপাথে বই দেখতে গিয়ে।
সেই সুদূর কৈশোরে আমাকে কেউ খেলায় নিত না তাই বইপত্র নিয়েই থাকতাম সব সময়। দেখি, লোকটার চারপাশে বেশ ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে সামনের দিকে গেলাম।
দেখি চিত্রবিচিত্র ছবির অ্যালবাম খুলে রেখেছে, পচন ধরা এক মাংসপিণ্ড, পরে যাকে জানলাম পুরুষ প্রজননযন্ত্র, সঙ্গে চার-পাঁচ রকম কাচের জারে নানা ধরনের পোকা, শিকড়বাকড়, একদিকে তাবিজের স্তূপ, শ-খানেক তরলভর্তি হোমিওপ্যাথির শিশি।
আসর জমেছে অনেকক্ষণ, কথার মাঝখান থেকে শুনলাম, একদিন ন থিয়াইবো হেত্তে কিরিবা?
সবাই ইতস্তত, আমাকে ধমক দিল একটা, বেরিয়ে যেতে বলল, গুরা ফোয়া, মানে ছোট ছেলে।
আমি চিৎকার করে বলি, আঁই ব্যাজ্ঞিন বুজি (আমি সব বুঝি)।
আমার জবাবে কেউ কেউ হেসে ফেলল।
এবার সে একজনকে চিহ্নিত করে তার মধ্যমায় শিশির তরল লাগিয়ে দিল। 'দেখি, আঙুল ব্যাঁকা করেন তো।'
আমরা চমৎকৃত হয়ে দেখলাম, আঙুল বাঁকা হচ্ছে না। 'জিনিসও এইল্লাত থাইব (এই রকম থাকবে), কেউ ব্যাঁকা করিত ফাইত্ত ন।'
এরপর দেখলাম হুড়মুড় করে শিশিগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আমিও নিতে যাচ্ছিলাম, ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।
শিশির তরল বেচা শেষে লোকটা এবার একটা ফটো অ্যালবাম দেখিয়ে বলল, 'এই এত্তর (এত বড়) জিনিস ইবে অইলদে নবাব আলিবর্দি খানের'—একটু থেমে দুঃখের ভান করে বলল, 'পচি গেইয়ে' (পচে গেছে)।
এরপর একগোছা তাস বের করে বলল একটা বেছে নিতে, আবার তাসটা ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে ভালমতো শাফল করে নিল।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জমায়েত দেখল একবার হাসিমুখে, এক বুড়োমতোন মানুষকে বলল পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতে দেখা গেল, সেই তাসটাই।
কিন্তু বিস্ময়ের বাকি ছিল তখনো। 'এই যে ফোঁটাগুলো তাসের ওপর, এদের কি সব সময় ভালো লাগে তাসের মধ্যে থাকতে?'
আঞ্চলিক টানসহ খানিকটা প্রমিততেই বলার চেষ্টা করে। 'ইতারার কি সিবিক্সে যাইত মনে ন কয়!' (এদের কি সি-বিচে যেতে ইচ্ছে করে না!)
কী যে হলো তারপর, আজও মনে লেগে আছে, দেখি তাসের ফোটারা ঘুরছে-নড়ছে চক্রাকারে সারিবদ্ধ, একপর্যায়ে তাসের চার কোনা থেকে বেরিয়ে মানুষটার রোমশ হাতের কবজিতে মোটা পোকার মতো চলছে-ফিরছে, দূরে তখন আলো ডুবছিল আস্তে আস্তে, রাস্তার জাদুকরের চোখে-মুখে তখন পরাবাস্তব মনোযোগ।
২
আমাদের বিভাগীয় গ্রন্থাগার ভবন, শৈশব-কৈশোর-যৌবনের পড়াশোনা-প্রেম-বিপ্লব-চুমুর চাক্ষুষ দর্শক সে ভবন আজ আর নেই।
নতুন ভবনটি জীবদ্দশায় দেখব, সে আশা করি না। তার উল্টো দিকে শহীদ মিনারের নিচে নানা রকম পসরা নিয়ে প্রায় ছিন্নমূল, কোনোমতে নাক তুলে ভেসে থাকা মানুষেরা বসতেন। সেইখানেই একদিন দেখেছি টাক মাথা বয়স্ক জাদুকরকে। পরনে সস্তা শার্ট, হয়তো কাছের হকার মার্কেট থেকে কেনা, যাকে আমরা আদর করে বলতাম ল্যান্ডা বাজার (নগ্নবাজার)।
জাদুকরের সঙ্গে ছোট এক ছেলে, দশ-এগারো বছর বড়জোর, ভয়ে কাঁপছে, চোখের জলে নাকের জলে একাকার।
জাদুকর দাবি করলেন, এটি তাঁর শেষ বয়সের সন্তান। কিন্তু অভাবে একেও আর খাওয়াতে পারছেন না, এখন এখানেই সবার সামনে তার মাথা কেটে ফেলবেন তিনি। জাদুকরের এ কথা শুনে ছেলেটি চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল।
দুজন লোক ভিড় থেকে এসে ছেলেটাকে চেপে ধরল। দ্রুত একটা সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া হলো কিশোরকে আর তারপরেই এক নারকীয় চিৎকার, ভরদুপুরে সবার চোখের সামনে—অনেকক্ষণ গ্রন্থাগারে পড়ে একটু চা খেতে নেমে এসে দেখি এই কাণ্ড—কিশোরের ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যেন ফোয়ারা!
তারপর সব শান্ত।
সমবেত দর্শক পাথরের মতো স্থির।
কেউ কেউ পুলিশে খবর দেবে কি না, ভাবছে, তখনো সেলফোন বাংলাদেশে আসতে দেরি। চাদরের আড়াল থেকে দাবি এল, যার যা আছে সামনে রাখতে নইলে অণ্ডকোষ উবে যাবে।
ঘোষণা শেষ না হতেই এক কম বয়সী কান্নাভেজা গলায় বলে উঠল, 'আঁর গুন দি ফেল' (আমারগুলো দিয়ে দাও)! মনে আছে, ভীতসন্ত্রস্ত আমি পকেটের সবুজ বিশ টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু আর খানিক বাদেই হাসিখুশি বালক বাপের হাত ধরে বেরিয়ে এল।
আর কেঁদে ওঠা কম বয়সী সেই ছেলেটি আনন্দিত কণ্ঠে চারদিক কাঁপিয়ে দিল:
'দুনোয়া ফিরি আইস্যে' (দুটোই ফিরে এসেছে)। প্যান্টের সামনে তার হাত।
৩
কোর্ট বিল্ডিংয়ের নিচে বই বিক্রি করত এছাক ভাই, একধরনের সখ্য ছিল আমাদের। একদিন দেখি, আলীবর্দির প্রাইভেট পার্ট দেখানো বিশেষ তরল বিক্রি করা জাদুকর তার সাথে গল্প জুড়েছে। আমার সাথেও পরিচয় হলো ক্রমে। একটা খুপরি মতো ঘরে বউ নিয়ে থাকত। অনেক দিন বাচ্চাকাচ্চা হয় না।
আমাকে খুব দুঃখী স্বরে বলেছিল একদিন, 'আমার ক্ষমতা নাই রে ভাই।' এ কথার পর তার সেই চেহারা, এখনো আমি দেখতে পাই।
একদিন আরেক জাদুকর ওই বয়স্ক বাবা আর তার ছেলেকে দেখলাম। চায়ে ডুবিয়ে পরোটা খাচ্ছে, গভীর মমতায় ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
তারা সবাই রাস্তার জাদুকর! কোনো পরাবাস্তব জগতে তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল!