ম্যাজিক রাজিক: ইঞ্জিনিয়ারিং যার পেশা এবং ম্যাজিক যার নেশা
পাঠকগণ বিভ্রান্ত হবার আগেই বলে দেই, এই ম্যাজিক রাজিকের সঙ্গে মাহিয়া মাহি অভিনীত 'ম্যাজিক মামনি' আইটেম গানের কোন সম্পর্ক নেই।
অস্ট্রেলীয়-বাংলাদেশী নাগরিক ম্যাজিক রাজিক একজন জাদুকর, যিনি সম্প্রতি টিকটকে জাদুর দক্ষতা দেখিয়ে লাইমলাইটে এসেছেন। রাজিক একজন মানসবাদী এবং মানসবাদ হলো জাদুর এমন একটি রূপ, যেখানে নিজের জ্ঞান ও কৌশল দিয়ে দর্শকের চোখে ধোঁকা দেয়া যায়।
তবে রাজিক যে শুধুমার নেটিজেনদেরই বিনোদিত করেন তা নয়, তিনি মঞ্চেও জাদু দেখান। এই মুহূর্তে টিকটকে তার অনুসারীর সংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ জন। ২৮ বছর বয়সী রাজিক প্রত্যাশা করেন আগামী দিনগুলোতে আরো অনেক মানুষকে নিজের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে।
কীভাবে নিজের এই নাম নিলেন রাজিক?
'যখন আমি প্রথমে থিয়েটারে পারফর্ম করতাম, তখন আমি একই কারণে ম্যাজিক রাজিক নামটি বেছে নেই। আমি চাইনি একজন জাদুকর হিসেবে আমার আসল নাম প্রকাশ করতে এবং একই সাথে আমি দর্শকদের কাছে সহজ, কিন্তু আকর্ষণীয় একটি নাম তুলে ধরতে চেয়েছিলাম', বললেন রাজিক।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, রাজিক পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং তিনি জাদু চর্চা করেন একটা শখ হিসেবে। কিন্তু এখন তিনি তার এই শখ এবং পেশা দুটোই চালিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কের মত আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি জাদু দেখিয়েছেন। এগুলো তাকে আরো কঠোর পরিশ্রম করতে ও জাদুকর হিসেবে যাত্রা অব্যহত রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে।
রাজিকের জাদুতে নিশ্চিতভাবেই এমন কিছু মোহনীয় ব্যাপার রয়েছে যা দর্শকের চোখে বিস্ময় এনে দেয়। কিন্তু তার এই মায়াজালের পেছনের উৎস কী?
জবাবটা পাওয়া গেল রাজিকের কাছ থেকেই, 'আমি যখন ছোট ছিলাম তখনই এটা শুরু হয়। আমার বাবা বিভিন্ন জিনিসপত্র এনে আমাকে ছোটখাটো জাদু দেখাতেন। শুধু তাই নয়, বাবা যখন ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তিনি কিছু না কিছু জাদুর কৌশল শিখে আসতেন। কারণ বাবা জানতেন আমি জাদু দেখে ভীষণ আনন্দ পাবো। আর এখান থেকেই আমার বড় হয়ে জাদু শেখার ও জাদুর নানা জিনিস সংগ্রহ করার নেশা তৈরি হয়।'
'সেই বয়স থেকেই আমি আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সামনে জাদু দেখিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে শুরু করলাম। এখান থেকে আমি বুঝতে পারি যে আমি জাদু দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারবো', আরও জানালেন রাজিক।
বিনোদনের এই বিশেষ শাখার প্রতি তার আগ্রহের কথা শুনে যখন জানতে চাওয়া হলো, তিনি কি ঠিক করেই রেখেছিলেন কিনা যে জাদুকরই হবেন কিংবা ইন্টারনেটে মানসবিদ্যা দেখাবেন?
উত্তরে রাজিক বললেন, 'হ্যাঁ, আমি আগেও বলেছি যে আমি ইন্টারনেটে যাত্রার একদম শুরু থেকেই মানসবিদ্যার পাশাপাশি জাদুবিদ্যার নানা কৌশল শিখতে আগ্রহী ছিলাম। আমি আসলে সামাজিক যোগাযগ মাধ্যমে বেশ দেরি করেই প্রবেশ করি এবং এর ক্ষমতা বুঝতে পারিনি প্রথমে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝে যাই যে বহু মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য ও নিজের মেধা দেখানোর জন্য এটা চমৎকার একটা জায়গা, তাই পরে আমি এই প্ল্যাটফর্মে মনোযোগী হই।'
এখনো পর্যন্ত রাজিক নিজেকে টিকটকে একজন জনপ্রিয় তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন তিনি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও নিজের দক্ষতা প্রকাশ করে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছেন।
বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন রাজিক, 'আমি দেখেছি অন্যান্য ইনফ্লুয়েন্সাররা কিভাবে একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই বেশ সক্রিয় থাকে। কিন্তু আমি চাচ্ছি টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব সবখানেই আমার উপস্থিতি প্রচার করতে।'
সময়ের সাথে সাথে আমরা দেখেছি তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক ও ইউটিউবের বাইরে এসে এখন টিকটককে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে সেখানের অদ্ভুত অদ্ভুত-অতিরঞ্জিত কনটেন্টের জন্য। কিন্তু রাজিক এর উত্তর দিলেন বেশ কৌশলীভাবে।
'আমি মনে করি এটা যার যার নিজের উপর নির্ভরশীল যে কে কিভাবে কোনো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করবে। এটা অনেকটা হাতে একটা ছুরি থাকার মত। কেউ চাইলে ফল-সব্জিও কাটতে পারে, কেউ চাইলে মানুষও খুন করে ফেলতে পারে। তাই দিনশেষে, লোকের নেতিবাচক কথাকে আমি পাত্তা দেইনা, কারণ আমি জানি আমি যা শেয়ার করছি সেই কনটেন্ট ক্ষতিকর নয়', বললেন রাজিক।
একজন জাদুকর হিসেবে রাজিকের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা আছে যা তিনি সারাজীবন মনে রাখবেন। তারই কিছু আমাদের জানালেন তিনি।
'কিছু অভিজ্ঞতার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। একদম প্রথম যেদিন আমি অস্ট্রেলিয়ার একটি টিভি শো 'টেইক মি আউট'-এ আমার জাদু দেখানোর সুযোগ পেলাম এবং অন্যটি হলো যেদিন বাংলাদেশের বিখ্যাত শো, হানিফ সংকেতের 'ইত্যাদি'তে জাদু দেখানোর সুযোগ পেলাম। ইত্যাদিতে আমি ৫০ হাজার মানুষের সামনে জাদু দেখিয়েছি এবং মানুষ গাছে উঠেও আমার পারফরমেন্স দেখছিল সেদিন', বললেন রাজিক।
ম্যাজিক রাজিক তার জীবনের সিংহ ভাগ সময় পার করেছেন অস্ট্রেলিয়ায় এবং তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশি মানুষের সংস্পর্শে এলে যে আপন টান অনুভব করেন তাও জানাতে ভুললেন না তিনি।
'বিদেশে আমি 'দ্য ম্যাজিশিয়ানস ক্যাবারনেট'-এ প্রতি সপ্তাহান্তে পারফর্ম করতাম। সেটা মজার ছিল কিন্তু বাংলাদেশে দর্শকের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি, তাই সবার সাথে সংযুক্ত হওয়া যায়। মানুষ এখানে মানুষকে সম্মান দেয় ও বন্ধুসুলভ। তারা সবসময় আমাকে ভালোবাসা, সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
অনুসারীদের বাইরেও রাজিক নিজের পরিবার থেকেও বেশ সমর্থন পেয়েছেন। সেই কারণে জাদুবিদ্যা ও নিজের পড়াশোনার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পেরেছেন তিনি। তবে রাজিকের ইচ্ছা, বাংলাদেশের জাদু শিল্পকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নেয়ার।
'অতীতে আমাদের জুয়েল আইচের মত কিংবদন্তী জাদুকর ছিল, যিনি দর্শকদের উচ্চমাত্রায় বিনোদন দিতে পারতেন। কিন্তু এরপর আমাদের জাদু শিল্প আর এগোয়নি। আমার মনে হয় তারা একটু গোপনীয়তা রক্ষা করতেন এবং কাউকে জাদুর কৌশলগুলো শেখাতে চাইতেন না। কিন্তু আমি সবার সাথে সবকিছু শেয়ার করতে চাই। যখন দেখি যে কেউ আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে জাদু শিখতে চাইছে তখন আমার ভীষণ আনন্দ হয়', বললেন রাজিক।