ববি ফিশার: দাবার জগৎ কাঁপিয়ে দেওয়া বিস্মরণের কিংবদন্তি
জন্মেছিলেন শিকাগোতে, বেড়ে ওঠা আরেক শহর ব্রুকলিনে। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবা খেলোয়াড়দের মধ্যে ববি ফিশারের আসন সবসময় সামনের সারিতেই থাকবে। ২০০৮ সালে আইসল্যান্ডের রেইকাভিকে ৬৪ বছর বয়সে মারা যান এ কিংবদন্তিতুল্য দাবাড়ু। তাকে নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় এই অবিচুয়ারি।
বেশ কয়েকদশক রহস্যময় জীবনযাপন করেছিলেন ফিশার। শেষ পর্যন্ত থিতু হন রেইকাভিকে। মার্কিন নাগরিকত্বও পরিত্যাগ করেছিলেন। কিডনিজটিলতা নিয়ে রেইকাভিকের বাড়িতে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
ববি ফিশারকে বিবেচনা করা হয় মার্কিন দাবার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষুরধার দাবাড়ু হিসেবে। তার চালের রহস্য বুঝতে যারপরনাই বেগ পেতে হতো প্রতিপক্ষকে। খ্যাতির শিখরে আরোহণের পর দাবা থেকে প্রায় দূরেই সরে যান ফিশার। অর্থকড়িও কমে আসে, সেইসঙ্গে হারান বন্ধুদেরও। স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়ে ছিলেন বুদাপেস্ট, জাপান এবং খুব সম্ভবত ফিলিপাইন ও সুইজারল্যান্ডে।
অবশেষে ২০০৫ সালে আইসল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই বাস করতে শুরু করেন। মাঝেমধ্যে তাকে পাওয়া যেত রেডিওতে। রেডিওতে এসে যুক্তরাষ্ট্র আর ইহুদিদের বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথা বলতেন। তার বিচারবুদ্ধি নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠেছিল।
১৯৯২ সালে দীর্ঘদিনের আড়াল ছেড়ে পুনরায় রঙ্গমঞ্চে ফিরেছিলেন পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ান বংশোদ্ভূত গ্র্যান্ডমাস্টার বরিস স্পাসকির বিরুদ্ধে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের রিম্যাচ খেলার জন্য। সে ম্যাচ অনায়াসে জেতেন ফিশার। এর আগে ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে তারা দুজন খেলেছিলেন রেইকাভিকে। 'ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি' খ্যাতি পাওয়া ওই ম্যাচটিতে আমেরিকায় জন্ম নেওয়া প্রথম মার্কিনি হিসেবে সোভিয়েত স্পাসকিকে হারিয়ে ওয়ার্ল্ড টাইটেল জিতেছিলেন ফিশার। ২০ বছর পরে যুগোস্লাভিয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো।
ফিশারের আগে ৩৫ বছর ধরে চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলোয়াড়েরা। ফিশার আর স্পাসকি সে বছর দাবার বোর্ডে তাদের নিজস্ব স্নায়ুযুদ্ধে নেমেছিলেন।
'ববি ফিশারই বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন, দাবার সর্বোচ্চ স্তরে এটি ফুটবলের মতোই প্রতিযোগিতামূলক, দ্বন্দ্বযুদ্ধের মতোই রোমাঞ্চকর, আর শিল্পের মতোই নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ,' দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের জন্য রেইকাভিকের সে বিখ্যাত ম্যাচ কাভার করা সাংবাদিক হ্যারল্ড সি শনবার্গ তার ১৯৭৩ সালের 'গ্র্যান্ডমাস্টার অব চেজ' বইয়ে এমনটাই লিখেছেন।
২০ বছর বাদের সেই রিম্যাচ অবশ্য অত তারিফ পায়নি। বসনিয়ার ওপর যুদ্ধ চালানোয় যুগোস্লাভিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে দাবা খেলে সেই নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখালেন ফিশার। সেই ম্যাচের পর আবারও অন্তরালে চলে যান তিনি। তার কিছুটা কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেপ্তারি এড়াতে। অবশ্য তখনো দেশে থাকা অল্পকিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার।
২০০৪ সালে ম্যানিলার বিমানে চড়ে অবৈধ পাসপোর্টে জাপান ছাড়ার চেষ্টার অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় ৯ মাস জেল খাটেন তিনি।
১৯৯৯ সালে ফিলিপাইনের একটি রেডিও স্টেশনের সঙ্গে কয়েক দফা সাক্ষাৎকারে ফিশার অসংলগ্নভাবে ও অবজ্ঞারসুরে একটি আন্তর্জাতিক ইহুদি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিষয়ে কথা বলেন। ৯/১১ হামলার ঘটনাকে তিনি ফিলিপাইনের একটি রেডিওর টকশো উপস্থাপককে 'দারুণ খবর' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। মার্কিন সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সব সিনাগগ বন্ধ করে দেবে, সকল ইহুদিদের গ্রেপ্তার ও অসংখ্য ইহুদি নেতাদের হত্যা করবে—একসময় এমন কিছুর আশা করতেন বলেও জানান ফিশার।
নিজের ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময়তেও ফিশার ছিলেন অস্থিরচিত্ত ও খামখেয়ালি। ১৯৭২ সালের স্পাসকির বিরুদ্ধে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাচেও ফিশারের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অভব্যতা বৈশ্বিক গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল। খেলার ঘরে টেলিভিশন ক্যামেরার আওয়াজে তিনি বিরক্ত হতেন। প্রথম ম্যাচ হেরে গিয়েছিলেন, দ্বিতীয় ম্যাচ বাতিল করেন নিজেই। পরে দাবি করেছিলেন, বাকি ম্যাচগুলো যেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে আয়োজন করা হয়।
এরপরের ম্যাচগুলোতে ঘুরে দাঁড়ালেন ফিশার। সেবার স্পাসকির বিরুদ্ধে ১২.৫-৮.৫ পয়েন্টে জয় পেয়েছিলেন ফিশার। সবমিলিয়ে তিনি জিতেছিলেন ৭টি ম্যাচ, হেরেছিলেন মাত্র ৩টি (বাতিল করা ম্যাচটিসহ), আর ড্র করেছিলেন ১১টিতে। সে বছরের পুরো জুলাই আর আগস্ট মাসের বেশিরভাগ সময় বিশ্বের নজর নিবদ্ধ ছিল এ দুই দাবাড়ুর খেলার মধ্যে।
ববি ফিশার ছিলেন একজন বিদ্রোহী। দাবার বোর্ডে তাকে দেখা যেত বুনো রূপে। তার ক্যারিশমার কল্যাণে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবা খেলা ভিন্নমাত্রার মর্যাদা পেল। স্পাসকি যখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, তখন তার প্রাইজমানি ছিল ১,৪০০ মার্কিন ডলার। আর বাহাত্তরের সেই ম্যাচে বিজয়ী ফিশার আড়াই লাখ ডলার প্রাইজমানি নিয়ে বেরিয়েছিলেন।
সেলিব্রিটির যন্ত্রণা
ফিশারের বিজয়কে দেখা হলো কমিউনিজমের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয় হিসেবে। রাতারাতি তিনি হয়ে উঠলেন আমেরিকান হিরো। তাকে হোয়াইট হাউসে ডেকে নিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। টেলিভিশনে অহরহ তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতে থাকল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের দাবাসেটের দাম আর দাবাশিক্ষার ফি, দুটোই আকাশ ছুঁয়েছিল।
কিন্তু লাইমলাইটে বেশিদিন থাকতে পারেননি ফিশার। ১৯৭৩ সালের শুরু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া শুরু করেন তিনি। খেলার জন্য বিশাল অঙ্কের আর্থিক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফিশার। এসব অঙ্ক মিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছিল। ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক ফার্ডিনান্ড মার্কোস ও ইরানের শাহ তাদের নিজেদের দেশে তাকে খেলানোর জন্য আরও বড় অঙ্কের প্রস্তাব জানালেও ফিরিয়ে দেন ফিশার। তার মনে হয়েছিল, অর্থের পরিমাণটা যথেষ্ট ছিল না।
কিছুদিন ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় ছিলেন ফিশার। শোনা যায় সেখানে পুরোনো দাবা ম্যাচগুলো পুনরায় খেলে আর নাৎসি সাহিত্য পড়ে সময় কাটত তার। ফিশার নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন বলেও কথা উঠেছিলে, যদিও তার আর্থিক অবস্থার বিষয়ে কখনোই পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।
দাবার দুনিয়ায় মাঝেমধ্যে গুজব উঠত, ফিশার নাকি আবার খেলায় ফিরবেন। শোনা যায়, ফিশারের আইকিউ ছিল ১৮১। নিজের পরাক্রমে নিজেই গর্বিত ছিলেন তিনি। ভক্তদের কাছ থেকে আনুগত্য, প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে ছাড়, আর খেলার আয়োজকদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা দাবি করতেন ফিশার।
দাবার সঙ্গে পরিচয়
১৯৪৩ সালের ৯ মার্চ শিকাগোতে রবার্ট জেইমস ফিশার হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন ববি ফিশার। কাগজপত্রে তার বাবা ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত পদার্থবিদ জেরার্ড ফিশার। তবে বিভিন্ন প্রমাণে জানা গেছে, তার জন্মদাতা পিতা ছিলেন জনৈক হাঙ্গেরিয়ান।
ফিশারের দুই বছর বয়সে, জেরার্ড ও তার স্ত্রী রেজিনার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বাবা জেরার্ড চিরতরে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন। ফিশারের বড় বোন জোয়ানসহ দুই সন্তানকে লালন-পালন করেন রেজিনা ফিশার। সুইস বংশোদ্ভূত রেজিনা ছিলেন নার্স ও স্কুলশিক্ষক।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অ্যারিজোনা হয়ে ব্রুকলিনে পরিবার নিয়ে থিতু হন রেজিনা। ছোটবেলা থেকে দাবার প্রতি তীব্র আসক্তি ছিল ফিশারের। মা রেজিনা চেয়েছিলেন কিশোর ফিশার কেবল দাবার ওপর পুরো মনোযোগ না দিয়ে একটু পড়ালেখাও করুক। কিন্তু তিনিই আবার ফিশারকে টুর্নামেন্টগুলোতে লড়ার খরচের ব্যবস্থা করে দিতেন।
রেজিনা ছিলেন ইহুদি। অথচ ইহুদি পরিবারে জন্ম হয়েও পরে মারাত্মক ইহুদিবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন ফিশার। তবে মা ও ছেলের মধ্যে সবসময় যোগাযোগ ছিল। ১৯৭৭ সালে মা রেজিনা মারা গেলে শোনা যায়, ফিশার উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পরে বোনেরও মৃত্যু হয়। কাছের মানুষদের পরপর মৃত্যুশোক ফিশারের বিচারবুদ্ধির ওপর আরও বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে করতেন তার কাছের মানুষেরা। নিজে কখনো বিয়ে করেননি তিনি। তবে ম্যানিলায় জাস্টিন ওং-এর গর্ভে তার এক কন্যাসন্তান জিংকি ওং জন্ম নেয় ২০০০ সালে।
বোন জোয়ান ছয় বছর বয়সী ভাইকে প্রথমবারের মতো দাবাসেট কিনে দিয়ে খেলার মৌলিক নিয়মগুলো শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আট বছর বয়স থেকেই ব্রুকলিন চেজ ক্লাবে ক্লাস নিতে শুরু করেন ফিশার। ১২ বছর বয়সে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুদের কাতারে পৌঁছে যান তিনি।
১৩ বছর বয়সে, ১৯৫৬ সালে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটস জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন ফিশার। একই বছর আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার ডোনাল্ড বার্নকে হারিয়ে দাবায় নিজের প্রথম মাস্টারপিস তৈরি করেন তিনি। সেই ম্যাচটিকে দ্য চেজ রিভিউ 'দ্য গেম অব দ্য সেঞ্চুরি' খেতাব দেয়।
পরের বছর মার্কিন জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ তো জেতেনই, তার সঙ্গে প্রথমবারের মতো ইউনাইটেড স্টেটস চ্যাম্পিয়নশিপও ঝুলিতে পোরেন। মোট আটবার এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে এ টাইটেল জিতে সবচেয়ে কমবয়সী চ্যাম্পিয়ন হন। আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ুদের বিরুদ্ধে তিনি ১৩টি ম্যাচ খেলে ৮টিতে জয় পান ও ৫টি ড্র করেন। কোনো ম্যাচ হারতে হয়নি তাকে।
১৫ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন ফিশার। তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি। দাবার পেছনে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়ার জন্য ১৬ বছর বয়সে স্কুল ছাড়েন ফিশার।
আগ্রাসী এবং ব্রিলিয়ান্ট
খেলার বেলায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন ফিশার। 'ওদের গা মোচড়ানো দেখতে আমার ভালো লাগে,' নিজের প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এমনটাই মন্তব্য করেছেন তিনি।
কিংস গ্যাম্বিটের মতো কৌশল ব্যবহার করতেন ফিশার। এটি একটি সূচনা-চাল, যেখানে সাদাপক্ষের খেলোয়াড় রাজার পণ ছেড়ে দেয় দ্রুত আক্রমণ করার জন্য। এ কৌশলটি দীর্ঘসময় ধরে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ আর আবেগতাড়িত বলে বিবেচনা করা হতো।
কিন্তু ১৯৬৪ সালের মার্কিন চ্যাম্পিয়নশিপের সময় নিদারুণ দক্ষতার সঙ্গে গ্র্যান্ডমাস্টার ল্যারি ইভান্সের বিরুদ্ধে কিংস গ্যাম্বিট ব্যবহার করে দাবার দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেন ফিশার। ওই টুর্নামেন্টেই গ্র্যান্ডমাস্টার রবার্ট বার্নের বিরুদ্ধে আরেকটি কিংবদন্তিতুল্য ম্যাচ খেলেন ফিশার। ওই ম্যাচ সম্পর্কে পরে বার্ন বলেছিলেন, তিনি ফিশারের চাল ধরতেই পারেননি।
প্রথাবিরোধিতা ছাড়িয়ে
ববি ফিশার আজীবন ঔদ্ধত্যস্বভাব ছিলেন। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে নিজেকে নিয়ে তার গর্ব দ্রুতই বেড়ে যায়। হার্পারস ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছিলেন, নারীরা ভালো দাবাড়ু হতে পারে না। পুরোনো একটি ঘটনা প্রসঙ্গে বার্ন জানান, ১৯৬২ সালে বুলগেরিয়ায় বার্ন ফিশারকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিশার উত্তর দিয়েছিলেন, তার মাথা নিয়ে কাজ করার সৌভাগ্য পেতে হলে সাইকিয়াট্রিস্টকে উল্টো ফিশারকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
টুর্নামেন্ট পরিচালকদের কাছে বিশেষ আলো, আসন বা নীরবতার ব্যবস্থা করা ইত্যাদির মতো অস্বাভাবিক সব দাবি করে বসতেন ফিশার। তিনি অভিযোগ করতেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী তার খাবারে বিষ মেশানোর চেষ্টা করছে, তার হোটেলকক্ষে আড়ি পাতার যন্ত্র বসানো হয়েছে বা রাশিয়ানরা আগে থেকে আঁতাত করে খেলা ড্র করে দিচ্ছে। রাশিয়ানরা বিমানে বুবিট্র্যাপ রেখেছে, এমন ভয়ে বিমানে চড়তেও ভয় পেতে শুরু করেন ফিশার।
ধীরে ধীরে খেলার সংখ্যা কমিয়ে দেন ফিশার। টানা কয়েকমাস ধরে কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলতেন না তিনি। গুজব ছড়াত, তিনি হারার ভয়ে খেলতেন না। কিন্তু যখন খেলতে ফিরে আসতেন, তখন কেউ তার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারত না।
রেইকাভিকে স্পাসকির বিরুদ্ধে খেলার আগে গ্র্যান্ডমাস্টারদের বিরুদ্ধে একটানা ২০টি ম্যাচ জিতেছিলেন ফিশার। 'মাই ৬০ মেমোরেবল চেজ গেমস' শীর্ষক একটি বইও লিখেছিলেন তিনি।
১৯৭২-এ ম্যাচের আগে উপস্থিত না হওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ফিশার। নিউইয়র্ক থেকে রেইকাভিক যেতেও দেরি করেছিলেন। নিজেই চেয়েছিলেন টেলিভিশনে খেলা দেখানো হোক, অথচ আবার ক্যামেরার শব্দের অস্বস্তির কথা বলে খেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তালগোল পাকিয়ে ফেলে প্রথম ম্যাচ হেরেছিলেন, দ্বিতীয় ম্যাচ বাতিল করেছিলেন। শেষে হুমকি দিয়েছিলেন, যদি স্পাসকি দর্শকের আড়ালে ছোট কক্ষে খেলতে রাজি না হন, তাহলে তিনি টুর্নামেন্ট থেকে চলে যাবেন।
১৯৭৫ সালে খোদ দাবার দুনিয়া থেকে বড় একটি ধাক্কা খান ফিশার। ফেডারেশনের নিয়ম মেনে ন্যায়সম্মত চ্যালেঞ্জার আনাতোলি কারপভের সঙ্গে খেলতে অপারগতা জানালে তার টাইটেল কেড়ে নেয় দ্য ইন্টারন্যাশনাল চেজ ফেডারেশন। এরপর থেকে ফিশারের জীবনে পতন শুরু হয়। ওয়ার্ল্ডওয়াইড চার্চের সদস্যদের বিরুদ্ধে এক মামলায় হেরে গিয়ে দেউলিয়া ও গৃহহীন হয়ে পড়েন ফিশার।
দাবা খেলোয়াড়েরা সাধারণত মনে করেন, ১৯৯২ সালে স্পাসকির সঙ্গে অর্থের জন্যই খেলতে রাজি হয়েছিলেন ফিশার। তবে নিজের প্রাধান্য আবার অর্জনের সুযোগটাও তার জন্য আকর্ষণীয় ছিল। ওই ম্যাচটা অননুমোদিত হলেও ওয়ার্ল্ড চেজ চ্যাম্পিয়নশিপের একটি ব্যানার টাঙানো হয়েছিল। এক সংবাদ সম্মেলনে ফিশার মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের একটি সতর্কতামূলক চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। সে চিঠিতে ফিশারের এ ম্যাচটিকে একটি 'অর্থনৈতিক প্রকল্প' হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছিল—এর ফলে তিনি জরিমানা ও গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হবেন। প্রায় দেড় শর বেশি সাংবাদিকের সামনে ফিশার ওই চিঠিতে থুতু ছুড়ে মারেন।
বিস্মরণের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার পর ফিশারকে মাঝেমধ্যে দেখার গল্প দাবা খেলোয়াড়েরা নিজেদের মধ্যে বেশ রসিয়ে বলতেন। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে দাবার সেরা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভের বিরুদ্ধে ফিশার কেমন খেলতেন—এমন বিতর্ক দাবার টুর্নামেন্ট আর খেলাটি সংশ্লিষ্ট প্রকাশনাগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।
চেজ শিক্ষক ও লেখক ব্রুস প্যান্ডলফিনি বলেন, 'ফিশার যদি প্রকৃতিস্থ থাকতে পারতেন, তাহলে তার কাছ থেকে আরও শতশত মাস্টারপিস ম্যাচ পেতাম আমরা। এ ক্ষতির গুরুত্ব আমরা অনুভব করি, প্রতিটা দাবা খেলোয়াড় অনুভব করেন।'