বনের বাঘও যাকে সমঝে চলে, রাতে যার লেজ বাজে ঝুমঝুম শব্দে!
ছোটবেলায় দেখতাম বাড়ির পাশের চৌহান এবং রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকজন সজারু শিকার করত। তখন প্রতি গ্রামেই কমবেশি সজারু ছিল। আনারস, গাঁজর, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ নানা জাতের সবজি এদের প্রিয় খাদ্য। তাই মাঝেমধ্যে কৃষকের ফসলের খেতে ঢুকে পড়ত ওরা। তাতেই অনেকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে প্রাণীগুলো। কেউ কলার সঙ্গে বিষ মিশিয়ে সজারুদের হত্যা করে, কেউ শিকারিদের খবর দিয়ে নিয়ে যায় সজারু মারার জন্য।
সজারু-শিকারিদের তখন ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। নরসিংদী ও গাজীপুরের নানা জায়গায় ছুটে যেত ওরা সজারু শিকারের জন্য। তারপর সন্ধ্যার দিকে মৃত সজারুর দেহ কলাপাতায় মুড়ে মাথায় তুলে গ্রামে ফিরত। আর কৌতূহলী আমি তখন তাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতাম।
প্রথমে ওরা একটা একটা করে সজারুর দেহের সমস্ত কাঁটা তুলে ফেলত, তখন ওটাকে একটা অদ্ভুত রকমের সাদা প্রাণী মনে হতো। এরপর পেট চিড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ওরা সেটাকে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে রান্নার জন্য প্রস্তুত করত।
কৈশোরে বহুবার সজারু শিকার দেখতে ওদের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়েছি। খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছি ওদের শিকারকৌশল। শিকারিরা প্রথমে সজারুর গর্ত খুঁজে বের করত। গর্ত খুঁজে পেলে তারা দেখত সেটা নতুন নাকি পুরাতন। নতুন গর্তের সামনের মাটিগুলো থাকত তাজা, নিয়মিত চলাচলের কিছু চিহ্নও থাকত। শিকারিরা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য গর্তের ভেতর লম্বা কাঠি ঢুকিয়ে দিত। তারপর সেই কাঠি বের করে নাকের কাছে এনে শুঁকে দেখত। কাঠির ডগায় সজারুর গন্ধ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেত ওদের কার্যক্রম।
সজারুরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে তাদের গর্তের আশ্রয় তৈরি করে। নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত গর্তের বেশ কয়েকটি মুখ থাকে, যাতে একদিক দিয়ে কেউ আক্রমণ করলে অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়। শিকারিরা এসব ভালো করেই জানত।
একটিমাত্র মুখ খোলা রেখে বাকি মুখগুলো ওরা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিত। আর সেই একমাত্র খোলা মুখটির সামনে শুকনো খড় বিছিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতো। সেই আগুনের ওপর ফেলা হতো গাছের কাঁচা ডালপালা। তাতে ব্যাপক ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে, ওরা ঝাঁকড়া ডাল দিয়ে বাতাস করে গর্তের ভেতর ধোঁয়া প্রবেশ করাত। আর শিকারিরা দেশীয় অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে থাকত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে গর্তের বাইরে বেরিয়ে আসত সজারু। আর সাথে সাথেই মারা পড়ত শিকারিদের হাতে।
মাঝেমধ্যে বড় সজারুদের সঙ্গে বেরিয়ে আসত বাচ্চারা। শিকারিরা ওদের বাড়িতে এনে খাঁচাবন্দী করে রাখত। খাঁচায় ঝুলিয়ে দেওয়া হতো তালা। সেই তালা খোলা হতো ওদের মৃত্যুর দিন। বাইরে থেকে খাবার দেওয়া হতো বছর দুয়েক পর্যন্ত। তারপর ওরা ১০ থেকে ১২ কেজি ওজনের হওয়ার পর কোনো এক অনুষ্ঠানের দিন বাইরে থেকেই খুঁচিয়ে ওদের হত্যা করা হতো।
সজারু শিকার করত মূলত রবিদাস আর চৌহান সম্প্রদায়ের লোকেরা। বহুকাল আগে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা ভারতের বালিয়া জেলার রুক্ষ প্রান্তর ছেড়ে সোনার বাংলাদেশে ঠাঁই নিয়েছিল জীবিকার সন্ধানে। রবিদাসেরা তখন সম্ভ্রান্ত পরিবারের পালকি বহন করত। পাশাপাশি জুতা সেলাইয়ের কাজ করত। আর চৌহানদের কাজ ছিল রাজা-জমিদারদের পুকুর এবং দিঘি খনন। পাশাপাশি হাটবাজারে বালুভাজা বুট-বাদাম বিক্রি করা। তখন ওরা ছিল বাংলার নিদারুণ দরিদ্র সম্প্রদায়।
কৃষকেরা পাকা ধান কেটে নেওয়ার পর ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ত ক্ষেতে। ছোট্ট ঝাড়ু দিয়ে ক্ষেতের বুকে আর মাটির ফাটলে জমে থাকা ধান সংগ্রহ করত। কেউ কেউ কোদাল হাতে নিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে বের করে আনত মোটা মোটা ধানের শীষ। তখন ওদের অন্নের সংস্থান ঘটত ক্ষেতের উচ্ছিষ্ট আর ইঁদুরের গর্ত থেকে লুট করে আনা ধানের মাধ্যমে। এমন হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে বাজার থেকে মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই একটা সময় সজারুর মাংস ওদের আমিষের চাহিদা পূরণ করত।
তবে এখন দিন পাল্টেছে। চৌহান এবং রবিদাসদের জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। সমাজের নানা ধরনের পেশায় এখন ওরা জড়িত। অর্থনৈতিকভাবেও অনেকটা সচ্ছল। তাই যৌক্তিকভাবেও এখন ওদের সজারুর মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
যা হোক, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের এক দিন চরসিন্দুরের চৌহানপাড়ার শিকারিরা দুটো সজারু শিকার করে এনেছে- এমন খবরের ভিত্তিতে বিশিষ্ট পক্ষীবিশারদ ও বন্য প্রাণীপ্রেমী শ্রদ্ধেয় শরীফ খান এবং বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী শিহাব উদ্দিন (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী) আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হন। শিকারিরা তখন নিজেদের মধ্যে সজারুর মাংস ভাগ-বাঁটোয়ারা করছিল।
আমরা তাদের সজারু শিকার থেকে বিরত থাকার কথা বলি। আমাদের কথা শুনে সেদিন যেন আকাশ থেকে পড়েছিল তারা। তবুও আমরা তাদের যতটুকু পারি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন কাজ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ কাজ নয়। আসলে তখনই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যে হারে নরসিংদী ও গাজীপুর অঞ্চলে সজারু শিকার চলছে, তাতে ওদের বিলীন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
মূলত শরীফ খানের উদ্যোগে কিছু উদ্যমী যুবককে সঙ্গে নিয়ে চরসিন্দুর অঞ্চলের সজারু-শিকারিদের শিকার থেকে বিরত রাখার কার্যক্রম শুরু হয়। শিকার ছেড়ে যে মানুষটি প্রথমে আমাদের সঙ্গে সংরক্ষণের কাজে যোগদান করেন, তিনি প্রদীপ চৌহান। একসময় চৌকস শিকারি ছিলেন, নানা জায়গায় ছুটে যেতেন শিকারের উদ্দেশ্যে। বলতে গেলে এভাবেই হয়ে উঠেছেন একজন সজারু বিশেষজ্ঞ, সজারুর নানা জানা-অজানা তথ্যের এক ভাণ্ডার।
এই সাবেক শিকারি আমাকে দিয়েছেন সজারু-সম্পর্কিত নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এর মধ্যে বিশেষ যে তথ্যটি রয়েছে, তা কোনো প্রাণীবিজ্ঞানের বইয়ে না থাকলেও স্থানীয় শিকারিরা যুগের পর যুগ ধরে বিশ্বাস করে আসছে। তথ্যটি সজারুর লেজবিষয়ক। এদের লেজ ১ থেকে ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। রাতের বেলা যখন সজারুরা ঘোরাফেরা করে, তখন তাদের লেজ ঝুমঝুম শব্দে বেজে ওঠে। অনেক মানুষই রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে এই অদ্ভুত শব্দ শুনে ভয় পায়।
প্রদীপ আমাকে জানিয়েছেন অন্য আরেক বিষয়। তারা বিশ্বাস করেন, সজারু তার লেজের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়। আসলে সজারুর লেজ দেখতে অনেকটা মেয়েদের কানের ঝুমকোর মতো, যেন ছোট ছোট গ্লাস উপুড় করে রাখা হয়েছে। সজারুরা জলে নেমে লেজ খাড়া করে দেয়, আর তখনই ছোট্ট গ্লাসের মতো জিনিসগুলো পানিতে ভরে যায়। তারপর তারা লেজ খাড়া অবস্থায় গর্তের কাছে চলে আসে এবং বাচ্চাদের মুখের কাছে উপুড় করে দেয়। প্রদীপের মুখ থেকে যতবারই এই বর্ণনা শুনি, বিস্ময়ে ভরে যায় মন।
প্রদীপ আমাকে বলেছেন, সজারুর দেহে অতিরিক্ত চর্বি জন্মালে তারা রয়না গাছের ছাল খেয়ে থাকে। তাই বনাঞ্চলে প্রায়ই রয়না গাছের নিচের অংশ ছালশূন্য অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আরও জানিয়েছেন, একসময় কিছু ইউনানি ওষুধ কোম্পানি তাদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে সাজারুর কাঁটা কিনে নিয়ে যেত। কিছু বিনোদন পার্কের মানুষও আসত তাদের কাছ থেকে সজারুর বাচ্চা কিনে নেওয়ার জন্য।
এসব ছাড়াও মানুষটি আমাকে দিয়েছেন আরও এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তিনি বহুবার সজারু আর বড় বাগডাশদের একই গর্তে বসবাস করতে দেখেছেন। সজারুরা গর্তের ভেতর মাটির দেয়াল তুলে বাগডাশদের আলাদা করে রাখত। দুটি আলাদা প্রজাতির প্রাণীর একই গর্তে বসবাসের বিষয়টা আসলেই বেশ চমকপ্রদ; একজন নিরামিষভোজী, অপরজন সর্বভুক।
সজারু মূলত একটি গর্তজীবী নিশাচর প্রাণী। সন্ধ্যার আঁধার নামলেই এরা গর্তের নিবিড় আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। নানা রকম সবজির পাশাপাশি ধানও এদের প্রিয় খাদ্য। ওদের শরীরজুড়ে রয়েছে ছোট-বড় কাঁটার সমষ্টি। এই কাঁটা ওদের শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে রক্ষার বর্ম হিসেবে কাজ করে। এই তীক্ষ্ণ কাঁটার কারণে বনের বাঘও এদের সমীহ করে চলে। আর ভুলে যারা এদের আক্রমণ করে বসে, তাদের ভাগ্যে ঘটে নির্মম পরিণতি।
বিশ্ববিখ্যাত শিকারি জিম করবেট এবং কেনেথ অ্যান্ডারসনের বিভিন্ন শিকারকাহিনিতে দেখা যায়, বাঘ কিংবা চিতাবাঘ মানুষখেকো হয়ে ওঠার পেছনে সাজারু কাঁটার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তবে এ জন্য সজারু কিন্তু মোটেও দায়ী নয়। সজারুদের আক্রমণ করতে গিয়ে ওদের থাবা আর চোয়ালে সজারুর কাঁটা বিদ্ধ হয়। পরে সেসব জায়গায় পচন ধরলে বাঘ কিংবা চিতাবাঘ স্বাভাবিক শিকার ধরতে ব্যর্থ হয়ে মানুষ শিকারে বাধ্য হয়।
সজারু পরিবেশবান্ধব প্রাণী। অনেকের কাছে এরা জঙ্গলের পরিষ্কারক নামেও পরিচিত। প্রতিবছর সজারুর দেহের বেশ কিছু কাঁটা পড়ে গিয়ে আবার নতুন কাঁটা গজিয়ে ওঠে। নতুন কাঁটা গজানো এবং কাঁটার নিয়ত বর্ধনের জন্য এদের দেহে দরকার প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়ামের। তাই দেহের ক্যালসিয়াম বৃদ্ধির জন্য এরা জঙ্গলের নানা জায়গায় পড়ে থাকা মৃত জীবজন্তুর হাড় এবং শিং চিবিয়ে খায়।
একসময় দেশের পুরো পাহাড়ি বন-জঙ্গল থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গ্রামে সজারু দেখতে পাওয়া যেত। ক্রমাগত শিকার এবং বন-জঙ্গল ধ্বংসের ফলে এদের অস্তিত্ব আজ মহাবিপন্ন। তবে খুবই সুখের বিষয়, সজারু শিকার বর্তমানে অনেকটাই কমে এসেছে। যদিও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
দেশে বন্য প্রাণী সুরক্ষা আইন আছে, এর প্রয়োগও আছে। তবে কখনোই কোনো অপরাধ আইনের মাধ্যমে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনের পাশাপাশি এ জন্য দরকার জনসচেতনতা। সজারুসহ সমস্ত বন্য প্রাণী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সচেতন নাগরিকদের।
প্রকৃতির সন্তানকে কখনোই প্রকৃতির কোল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, তাহলে এর দায় মানুষকেই বয়ে বেড়াতে হবে। চিড়িয়াখানা কিংবা সাফারি পার্ক যেন এদের শেষ ঠিকানা না হয়। 'বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'।