অবন ঠাকুরের ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’
চিত্রকলার ইতিহাসে বস্তুবাদী পাশ্চাত্য শিল্পের পাশাপাশি ভারতীয় প্রাচ্য শিল্পরীতিরও ভূমিকা রয়েছে। এদেশীয় আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিদেশি গুরু ই বি হ্যাভেলের সঙ্গে শুরু করেন 'নব্য বঙ্গীয় ধারা'। ভারতীয় শিল্পীদের মাঝে ইংরেজি শিল্পকলার প্রভাব ঘুচিয়ে দেবার জন্য স্বদেশি মুঘল ও রাজপুত পেইন্টিংকে অস্ত্র হিসেবে নেন।
ভারতীয় শিল্পকলার এই 'আঁভা-গার্দে' মুভমেন্ট হয়েছিল স্বদেশিয়ানার বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে। আর এই রেনেসাঁর গুরুত্বপূর্ণ একসময়ের সিরিজ 'আরব্যরজনী' ছিল শিল্পীর জীবনের Chef-doeuvre, অর্থাৎ মাস্টারপিস।
১৯২৯ সনে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর 'Mask' সিরিজের শেষ ছবিটি আঁকলেন। বলা যায় তাঁর ছবি আঁকার যাত্রার একটি অধ্যায় শেষ হলো এ সিরিজ অব্দি এসে। এরপর যে নতুন অধ্যায়টি এল ঠিক তার পরের বছর, তা আরব্য রজনীর গল্প নিয়ে। মাত্র এক বছরে শিল্পী ৪৫টি ছবি আঁকলেন। সেসব শুধু রূপকথার গল্প হলো না বরং এতে মিশে গেল ঔপনিবেশিক দৃশ্যের ছাঁট, জীবনের এ অব্দি সমস্ত দেখার বহিঃপ্রকাশ। এই সিরিজ নিয়ে নিজেও বলে গেলেন, আমি রেখে গেলাম তোমাদের কাছে, আমার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা খুঁজে পাবে এতে।
সমালোচকরা এতদিন যেভাবে দেখে এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথকে, এবার এসে দেখলেন একজন পুনরুজ্জীবিত শিল্পীকে। শুরুতে অবন ঠাকুরের কাজকে কেবলই ইলাস্ট্রেশন বলা গেলেও পরে তা বিবর্তিত হতে লাগল শব্দ-ছবির সম্পর্কে। 'স্বপ্নপ্রয়াণ', 'চিত্রাঙ্গদা' হয়ে 'ওমর খৈয়াম', 'ফাল্গুনী' অব্দিও এই শব্দ আর ছবির মেলবন্ধন ছিল স্পষ্ট, সরল; অ্যারাবিয়ান নাইটস সিরিজে যা অভূতপূর্ব ভিন্নতা পায়। এখানে এসে ছবি কেবল চিত্রণে নয় বরং বর্ণনাধর্মীও হয়ে ওঠে নতুন আঙ্গিকে। বলা যায়, অবনীন্দ্রনাথ 'ওমর খৈয়াম' আঁকার সময় সাদির পোট্রের্টে যতটা বাস্তববাদী ছিলেন, পরবর্তী সময়ে এই বাস্তববাদ অনেকটা রূপান্তর হয় শিল্পীর মানসিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে।
'আপন কথা'তে দেখা যায় অবন ঠাকুর একটি শিশুর মতো বাইরে তাকিয়ে। দক্ষিণমুখী বারান্দার বাইরে একটা সকাল থেকে ঘুমাতে যাবার আগে অব্দি একটানা দেখলেন মানুষ, মুরগি, হাঁস, কোচগাড়ি, গাড়ির চালক, ভেতরে বসা বর, বাড়ি দেখে রাখা নন্দু, পঙ্গু গোবিন্দ, বুড়ো ঝাড়ুদার, কুমোর, মুটে, অফিসের কর্তারা, দারোয়ান, ডাকপিয়ন। সকলে বয়ে চলেছে। যেন কারও সাজিয়ে রাখা সিনেমা। অথচ এতে ভয়াবহ ট্রাজেডি কিংবা কমেডি নেই, বরং শিল্পীর কাছে এই একটানা দৃশ্য হয়ে উঠল একটি প্রহসনের মতো। কিন্তু এই রোজ দেখা প্রহসন তো শুধু 'যা দেখো, আঁকো'তে প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
অ্যারাবিয়ান নাইটসে শিল্পীর নিজের এই 'Flaneur' সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এই সিরিজে শিল্পীর নিজের জীবন, চারপাশ নানান ভাবে উঠে আসে। এমনকি এই সিরিজ পেইন্টিংয়ের অণুপ্রেরণাও এসেছিল জীবনের নানা ঘটনা থেকেই।
নব্বই শতাব্দীতে কলকাতায় হাজারো রকম উদ্ভট শখ পোষণ করতেন ধনী বাবুরা। জুয়া খেলা, রক্ষিতা রাখা, বাইজি নাচÑএ ধরনের অভ্যাসে নিজেদের ভাগ্য নষ্ট করেছেন অনেকে। এসবের উল্লেখ আছে 'নব বাবু বিলাস (১৮২৫)'-এ। এই শতাব্দীর মাঝে এই অবাধ্যতা এতটাই বাড়ে, কালীপ্রসন্ন সিনহা বলেন, এসব ভদ্র বাবুদের জন্যই কলকাতা আজ বেশ্যাদের শহর।
এরকম সময়ে ক্যাপ্টেন লেপার্ড ভন অরলিখ বেলগাছিয়ায় এসে দ্বারকানাথের ঘরে ঝোলানো একটি ছবি দেখে মুগ্ধ হন। কুশনে হেলান দেয়া এক অপরূপ সুন্দরী নারীর পোট্রের্ট। বলা হয়, এই নারীর সঙ্গে দ্বারকানাথের দ্বৈত সম্পর্ক ছিল এবং এই পোট্রের্টটি ছিল এক মুসলিম বাইজির। পরবর্তী সময়ে অবন ঠাকুর তাঁর 'মোহিনী' সম্ভবত এ সকল গল্প নিয়েই করেন। দ্বারকানাথও এসময়ের সিরিজ ছবিগুলোতে ঘুরেফিরে এসেছেন বারবার। যদিও দ্বারকানাথের বাড়ির ছেলেরা তেমনই নচ্ছার ছিলেন, তা নয়; তবে ছিলেন তো সে সময়কারই।
কলকাতার বাবুদের সেই সময়টি নব্বইয়ের শতাব্দীর শেষে আরেক রূপ নিল। ব্রিটিশ পিটিশনের মাধ্যমে সেসব 'অশ্লীলতা'র নির্বাসন করা হলো। নেয়া হলো ব্রিটিশদের সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, সংস্করণ।
এসবের মাঝে দ্বিধায় পড়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথের মতো কিছু মানুষ। অবন ঠাকুর আবার বড়ও হয়েছিল বিদেশি পড়াশোনার মাঝে। তাঁর জন্য তো এই নয়া বেঙ্গল গ্রহণ করা খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে ধারণ করতেন তাঁর আদি। বটতলার গীতিগান, যাত্রা ভালোবাসতেন তিনি। এই দ্বন্দ্ব আর নতুন সময়ের প্রভাব গিয়ে পড়ল অ্যারাবিয়ান নাইটস সিরিজে। আরব্য রজনীর গল্পে বানিয়াদের আর এ অঞ্চলের বানিয়াদের মধ্যে আদতে তফাত ছিল না। দুটোই দুই শহরের গল্প,যেখানে সামাজিক বিভেদ, নানা ধরনের লোকের সমাগম, অরাজকতা, লোক ঠকানো আর দ্বন্দ্ব আছে। অবন ঠাকুর তার এই রোজকার জীবনকে 'আরব্য রজনী'র মতো করেই দেখেছেন।
অ্যারাবিয়ান নাইটসে অবন ঠাকুর সমসাময়িক কলকাতার গল্প বলতে গিয়ে দেখলেন নানাভাবে আসা ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ গল্প বলা যাচ্ছে না। জোড়াসাঁকোতেই তিনি নানান পেশার বাঙালির পাশাপাশি দেখতে পেলেন বিহারি দারোয়ান, ওডিশার রাঁধুনি, মারওয়ারি ব্যবসায়ী, উত্তর আর পশ্চিম ভারত থেকে আসা মুসলমান ব্যবসায়ী এমনকি চীন থেকে আসা বানিয়াদেরও। পোশাকে-আশাকেও তাদের বৈচিত্র্য দেখা গেল। তাছাড়া আরব্য রজনীর চরিত্রগুলো সব তো দেখা যায় বাড়ির পশ্চিম দিকের বারান্দা থেকে। দেখা গেল আরব কাহিনির আড়ালে পরিপাটি হয়ে উঠে আসছে নিজ বাড়ির গল্পও।
মূল আরব্য রজনীর গল্পে পারস্যের রাজা শাহরিয়ারের ভাইয়ের স্ত্রীর অবিশ্বস্ততা রাজাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। পরবর্তী সময়ে তার নিজের স্ত্রীর প্রতারণায় তিনি পুরোই হতভম্ব হয়ে পড়েন এবং এই অভিজ্ঞতা তাকে নারীবিদ্বেষী করে তোলে। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অ্যারাবিয়ান নাইটসের প্রথম ছবিটিই আঁকেন ভিন্নভাবে। 'Looking into the Harem' ছবিটির মূল গল্প ছিল ভাইয়ের স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপ্রবণতা। আরব গল্পের নারীকে ঠিক যতটা ঘৃণিতভাবে দেখানো হয়েছে, অবন ঠাকুর ততটা অবদমিত করে এঁকেছেন দুই ভাইকে। সন্দেহ করাকে দেখিয়েছেন বিকৃতির রূপ হিসেবে। তাই এ ছবিতে সেই নারীই অনুপস্থিত, মূল গল্পে যিনি প্রধান অপরাধী ছিলেন। বরং দেয়ালের ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে থাকা দুই ভাইয়ের ওপর এসে পড়া নাটকীয় আলোটিই ছবির অর্থ ঘুরিয়ে দেয়। দর্শক এ ছবি দেখে মূল গল্প জানা সত্ত্বেও খুঁজে বেড়াবে আরও এক মর্মার্থ।
এই সিরিজের 'Ganeem and Lady Fatemah, the slave of the Caliph' ছবিতে সন্ধ্যার আলোতে দুজন মানব-মানবী বসে আছে, যেন এ এক মঞ্চের বেদি। মেয়েটি বস্ত্রে প্রায় আবৃত, মুখ নিচু করা, লজ্জায় মুড়ে আসা ভঙ্গি। আরব রূপকথায় এ ধরনের মেয়েদের দেখানো হয় বিশ্বাসঘাতক কিংবা উপকারী হিসেবে; কিন্তু অবনঠাকুর এই ছবিতে মূল উপজীব্য তা করেননি। বরং বসে থাকা এই দুজনের মুখের অভিব্যক্তির দিকে তাকালে বোঝা যায় এই ছবিতে মুখ্য তাদের নীরবতা। যেন কোনোরকম শব্দ ছাড়াই একে অন্যের উপস্থিতিতে ডুবে আছে। এই উপস্থিতি যে মেয়েটির জন্য বরং স্বর্গীয় পাওনার মতো, তা অবন ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছেন মেয়েটির গায়ের কাপড়ে লেখাগুলো দিয়ে।
আরব্য রজনীর গল্পে কাম, বাসনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে প্রবলভাবে। অবনীন্দ্রনাথ বরং এই মূহূর্তগুলোর প্রকাশ করেছেন ভিন্নভাবে। তিনি কামের বদলে ভালোবাসার মৌন প্রকাশ দিয়ে দাগ কেটেছেন। মানবিক প্রেমকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে এঁকেছেন।
বাহ্যিকতা থেকে অভ্যন্তরীণতা, প্রচলিত থেকে স্বতন্ত্রতা, পূর্ণতা থেকে বেদনাকে শিল্পী বেশি গ্রহণ করেছেন এই সিরিজে। এখানে প্রচলিত চিত্রশৈলীর বাইরে গিয়ে জাতীয়বাদী এবং সর্বোপরি 'ভিক্টোরিয়ান ভ্যালু' যোগ করলেন তিনি। এই সিরিজের ছবিতে দ্বিধা, দ্বৈত প্রকাশ, সহানুভূতিশীলতার সাথে মিশে গেল শিল্পীর আত্মপ্রকাশের আরও স্বাধীনতা, আরও জটিলতা।
ঔপনিবেশিক সময়ের বহিঃপ্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি ছিল এ সিরিজের 'The Hunchback of the Fishbone'. এই ছবিতে শিল্পীর নিজ শহর, বাড়ি এমনকি পরিবারের চরিত্রগুলো মেটাফোরের মতো ফুটে ওঠে। আরব্য রজনীর এই ছবি তৈরির জন্য তিনি কেবল বারান্দায় বাইরে তাকিয়েই দেখতে পেলেন সকল চরিত্র। তিনটা আলাদা গ্রুপে দেখা যায় আলাদা আলাদা জীবনবোধ। দর্শকের চোখ বরাবর অংশটিতে রাখা হয়েছে দরজি ও তার স্ত্রীকে। কুঁজো অতিথির সাথে মজা করতে গিয়ে গলায় বিঁধিয়ে দেয় মাছের কাঁটা। তাই বাঁচানোর চেষ্টাচরিত্র করছে দুজন মিলে। ডানদিকের অংশে টুপি পরা এক লোক ইঁদুর মারার কল হাতে, ওপরে একটি বিড়াল অপেক্ষারত সেই ইঁদুর খাওয়ার জন্য।
সবচে নিচে থাকা হেকিমি, তিনি শিখে নিচ্ছেন নতুন চিকিৎসাশাস্ত্র।
কিন্তু একটু দূরে, সবচে ওপরের স্তরে আঁকা হয়েছে এক ভিন্ন ছবি। জাঁকালোভাবে ইউরোপিয়ানদের আপ্যায়ন করা হচ্ছে। ঠাকুরবাড়ির রোজকার কর্ম ছিল তা। ছবিতে লেখা, 'Kerr Tagore and Co'. অর্থাৎ ঠাকুর কোম্পানির সাইনবোর্ড। আপ্যায়ন করা লোকটির টুপি, মুখমণ্ডলের আদল মিলে যায় ফরাসি আঁকিয়ে ব্যারন দ্য স্যুইটারের আঁকা দ্বারকানাথের প্রতিকৃতির সাথে।
এ ছবিতে আলাদা আলাদাভাবে সমাজের স্তর, খাদ্যশৃঙ্খল, নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ, সামাজিক বিভেদ, কলোনিয়াল প্রকাশের অন্যতম উদাহরণ।
অবন ঠাকুর স্পষ্টভাবে তা এঁকেছেন।
অ্যারাবিয়ান নাইটস সিরিজে শিল্পীর জীবনবোধ আর কাজের পরিপক্বতা প্রকাশ পেয়েছে ঠিকই, তবে যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন তিনি এই 'আরব্য রজনী'ই বেছে নিলেন? বলা হয়ে থাকে, আরব্য রজনী কেবল আরবের গল্পই না বরং আরবের সামাজিক প্রেক্ষাপট। এই শহুরে গল্প লিখেছে এই শহরের লোকেরা, লেখা হয়েছে এই শহরের লোকেদের জন্যই, এই উপাখ্যানের চরিত্রও এরাই। অবনীন্দ্রনাথও হয়তো দুটি সমাজকে মিলিয়ে দেখলেন একই ছবিতে। আরবের রাতকে মিলিয়ে নিলেন নিজ ভারতবর্ষের রাতের সাথে। রূপান্তরে সৃষ্টি হলো নব্য ধারার ছবি।