‘এক কাপ কফি, না হয় আত্মহত্যা’
ক্যাফের বাইরে বসে পান করলে কফির না মেলে সুবাস, না পাওয়া যায় স্বাদ; এমনকি কফি খাওয়ার কারণও তখন খুঁজে বের করা যায় না। বিশ্বমারি করোনা ১৯ চলাকালীন নজিরহীন দীর্ঘকালীন ঘরবন্দী সময়ের দিনগুলোতে ঘরে বসে কফি পানের অভিজ্ঞতাকে এভাবেই ব্যক্ত করেন ফরাসি লেখক জোরিস-কার্ল হুইসম্যানস।
অবকাশে আড্ডা দেওয়ার বা জড়ো হওয়ার এসব স্থানের গুরুত্বের কথাও এ ফাঁকে তুলে ধরা হয়। ব্যস্ত নগরীর গণজীবনযাপন এবং ব্যক্তি জীবনের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করে নিয়েছে কফিখানা। প্রায়ই অবকাশের এমন সব জায়গাকে বলা হয় 'তৃতীয় স্থান'। বড় এবং ব্যস্ত নগরীতে মানুষের ভিড় থাকলেও পরস্পরের জানাশোনার সুযোগ কম। কিন্তু ক্যাফের মতো স্থানেই সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ গড়ে ওঠে। পাওয়া যায় মনখোলা আলাপ-আলোচনার কেন্দ্র। ভাব এবং চিন্তাধারা বিনিময় এবং আলোচনার এমন সব স্থানগুলোর বরাতে মিলেছে ইউনেসকোর সমর্থন।
ক্যাফে বললেই ভেসে ওঠে গুটিকয়েক টেবিল-চেয়ার, ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে থাকা এক ব্যক্তি, কফি বানানোর ছোট্ট একটু পরিধি, পরিবেশন করার কাউন্টার। ব্যস হয়ে গেলে কফির একটি দোকান! না, রয়েছে আরও কিছু। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-তদবির গুরুত্বপূর্ণ নানা কাজের জন্যও কেউ কেউ কফিখানাকেই বেছে নেন। কারও কাছে ক্যাফে মানে নতুন স্বপ্ন-ভাবনার স্থান। কিংবা কারও সাথে দেখা-সাক্ষাতের জায়গা। আবার কারও কারও কাছে ক্যাফে হয়ে ওঠে মুক্ত আলোচনার এক অবাধ অঞ্চল। এসব উদাহরণ নিয়েই গড়ে উঠছে ঢাকায় কফি কালচার।
আলোচনা, কথা-কাটাকাটি বা ভাব বিনিময়ে কপিমপে প্রায় অবাধই চলে। ষোড়শ শতকে প্রথম কফিখানা চালু হলো। এখানাকার মুক্ত পরিবেশের দিকে সাথে সাথেই শ্যেন চোখে সংশয় নিয়ে তাকাল রাজনীতিবিদ এবং ধর্মাধিপতিরা। এ সত্ত্বেও কফিখানা তৈরির জোয়ার বয়েই চলল। বুয়েনস এইরেস থেকে ভেনিস। ইস্তাম্বুল থেকে ভিয়েনা। আদ্দিস আবাবা থেকে সিউলের প্রান্তে যেয়ে লাগল এ ঢেউ। অনেক পরে হলেও এতে যোগ হয়েছে ঢাকা।
অপ্রচলিত জীবনবোধে আস্থাশীল শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক বা সংগীতবিদ, সাংবাদিক অর্থাৎ বোহেমিয়ান মানুষগুলোর ঘন ঘন আনাগোনা ঘটত, ঘটে কফির এ পানশালায়। এ ছাড়া লেখকদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, এবং এখনও প্রিয় সব ক্যাফে।
বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে নতুন নতুন খেলোয়াড়দের আগমন ঘটে। পরিবর্তন ঘটে ভোক্তাদের আচরণে। চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দার উদ্ভব হয়। রুপালি পর্দার পরিবর্তন ঘটে। টেলিভিশন থেকে ক্রমে ক্রমে স্মার্ট ফোন। পরিবর্তনের তরঙ্গের পর তরঙ্গে আছড়ে পড়ে। কিন্তু সমাজজীবনে ক্যাফের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই বদলায় না কেবল।
পানির পরই দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়ের নাম করতে বললে কফির নামই নেওয়া হবে। প্রতিবছর বিশ্বে ১৫ কোটির বেশি কফি ব্যাগ মানুষের ভোগে লাগে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ভিয়েতনাম এসব ব্যাগ জোগায়। পৃথিবীর প্রায় ১০ কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ আয় নির্ভর করছে কফির ওপর। জগতের কফি বাজারের মূল্যমান প্রায় ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ধারণা।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বলবর্ধক বা টনিক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে কফি। কফিস্থ ক্যাফেইনকে এ জন্য কৃতিত্ব দিতে হয়। ক্যাফেইনের তেজে কফি খাওয়ার পর 'চাঙা' হয়ে ওঠে মন। 'দেহে সতেজ' অনুভূতি আসে। 'হিস্তোরি সায়েন্তিফিক দু ক্যাফে'র (১৮৭৭) লেখক ডক্টর আমেদি লে প্লের কথায়, উদ্দীপক এ গুণেই ধর্মাবতারদের বিশেষ করে আরব ভূমির কর্তৃপক্ষদের চোখে সন্দেহজনক হয়ে ওঠে কফি। সবচেয়ে মজার কথা হলো, আরব ভূমিতেই কফি বাণিজ্যের প্রথম উদ্ভবও ঘটে।
কাহভা নামে পরিচিত কফির ছোট ছোট দোকানের সংখ্যা সে ভূমিতে ব্যাপকভাবে বাড়ে। ষোড়শ শতকে এক কায়রোতেই এই জাতীয় দোকানের সংখ্যা অন্তত ২০০০ ছিল। আজকের ইস্তাম্বুল তৎকালের কনস্টান্টিনোপলে 'কাহভেহ কানেসে' কিংবা কফিখানা ছিল অগুন্তি। কেবল পুরুষদেরই ছিল প্রবেশাধিকার সেখানে। এসব কফিখানা সাধারণত পাইকারিভাবে কফি বিক্রি করত। পাশাপাশি কফিখোরদের চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থাও এসব দোকানে থাকত। ১৭ শতকে কফিখানা গোটা ইউরোপজুড়ে; বিশেষ করে লন্ডন, মার্সেই ও প্যারিসে ছড়িয়ে পড়ল।
১৬৭৫-এর মধ্যে ইংল্যান্ডেই গড়ে উঠল তিন হাজারের বেশি কফিহাউস। কিন্তু এগুলোকে প্রতিবাদ এবং সরকারবিরোধীদের আখড়া হিসেবে ধরে নেওয়া হলো। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের (১৬৩০-১৬৮৫) ফরমানবলে এসব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়া হলো। এবারে ভিন্ন রাস্তা ধরল কফিহাউসগুলো। বদলে যাওয়ার নীতি নিল কফিহাউস। মূল তৎপরতা বা নীতি ঠিকই রইল কিন্তু রূপেরই কেবল বদল হলো। এতে আগের চেয়েও বেশি খদ্দেরকে টানতে শুরু করল বদলে যাওয়া 'কফিহাউস'।
ক্যাফে শব্দটির সূচনা হয়েছিল এক জাতের পানীয় বোঝাতে। সময়ের সাথে সাথে অর্থও বদলে গেল। এটি একটি স্থান এবং ঐতিহ্যের নাম হয়ে দাঁড়াল। ১৮ শতক থেকে এটি নগরজীবনে বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতার অঙ্গন হয়ে উঠল।
১৭ শতকের পর কফিখানাগুলোতে তেমন উল্লেখযোগ্য রদবদল কিছু ঘটেনি। ছাদের নিচে চার দেয়ালে ঘেরা, কফির গন্ধে ভরপুর একটি ঘর। প্লেট, ছোট ছোট চামচ, টেবিল, চেয়ার ছড়ানো-ছিটানো। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মোটামুটি ক্যাফের স্বাভাবিক দৃশ্য প্রায় এমনিই। জনাকীর্ণ ক্যাফেতে বসে কেউ নিঃসঙ্গ থাকতে পারে। কেউ মুক্ত আলোচনায় মেতে উঠতে পারে। কোথাও গান চলতে পারে। যোগ হতে পারে নাচও। কেবলই কফি কিনে খেতে হবে। তা হলেই মিলবে এমন স্থানে প্রবেশাধিকার।
ফরাসি লেখক লিওন-পল ফার্গু বলেন যে ফ্রান্সের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হলো ক্যাফে। এ কথার মধ্য দিয়ে ইথিওপিয়ার কফিগাছের কফির কথা বোঝাননি তিনি। বরং ফরাসি শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় গড়ে ওঠা কফিখানাগুলোকেই বোঝান তিনি। এক শতাব্দী ধরে এসব কফিখানা গড়ে উঠলেও ঐতিহ্যগত দিক থেকে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
লেখক ও শিল্পীরা এমন জায়গায় সময় কাটাতে বা এসব গড়ে তুলতে আগ্রহই দেখাবেন। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্যারিসের সেন্ট-জার্মেইন-দেস-প্রেস অঞ্চলের ফ্লোর এবং ডিউক্স ম্যাগতনের মতো এলাকাগুলো বুদ্ধিজীবীদের গুঞ্জনে ভরে উঠেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ইতালির বন্দরনগর ত্রিয়েস্টের ক্লাউদিও ম্যাগ্রিস, নিউইয়র্কের ডগলাস কেনেডি, হাভানার জো ভ্যারদেস, ভিয়েনার স্টেফান জুইগ এবং প্যারিসের এমিল জোলার মতো লেখক ছাড়া আর কেই-বা কফিখানাকে লেখনীতে তুলে আনতে পারেন? তাদের রচিত শব্দচিত্রের মধ্য দিয়ে কফিখানার অনিঃশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ এবং সর্বজনীন প্রকৃতি উঠে এসেছে।
মানুষ বিত্তহীন বা বিত্তবান যা-ই হোক না কেন, নিজের সামাজিক পরিবেশ বিনির্মাণ করতে পারে একমাত্র কফিখানায়। আইভরি কোস্টের লেখক আহমাদউ কৌরউমার ভাষায়, নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন যে মানুষটি, সমাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া রোধ করার তার একমাত্র উপায়ই হলো ক্যাফে। এমনকি কোম্পানির চাপিয়ে দেওয়া ল্যাপটপ ও মোবাইলের এ যুগেও কফিখানার পরিবেশ থেকে পুরোপুরি পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় মোটেও। আন্তর্জাতিক নতুন নতুন ব্র্যান্ড আসছে। দুনিয়াজোড়া বাজারে নতুন নতুন কফি নামছে। নতুন নতুন চাহিদার জন্ম হচ্ছে। আজকের দিনের কফিখানায় পুরোনো যেকোনো আমলের চেয়ে রকমারি স্বাদের কফি মিলবে। এসব কফিও আসছে নানা প্রান্ত থেকে। একই সাথে বাজারেরও রূপান্তর ঘটছে। সৃজনশীল ব্রান্ড গড়ে তুলছে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি। ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী এবং ভোক্তার মধ্যে ভারসাম্যের সৃষ্টি হচ্ছে।
গণতন্ত্র এবং জীবনযাপনশিল্প
১৯ শতকে ইউরোপে ক্যাফে হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব ও ব্যবসার প্রতীক। কফিখানাকে গণতন্ত্রের অংশ হিসেবেও দেখা হতে থাকে। সমাজে স্বাধীন এক নির্দিষ্ট জীবন কাটনোর প্রতিনিধিত্ব করে ক্যাফে। সকল সেন্সরশিপ বা নিষেধাজ্ঞাবর্জিত স্থান কল্পনার একটি অনানুষ্ঠানিক পরিবেশমণ্ডলীর সৃষ্টি হয় এখানে। মানুষের ইতিহাসে কফিখানা স্বাধীনতা ও সামাজিক লেনদেনের একক স্থান হয়ে ওঠে।
এরপরও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক রূপ পরিবর্তনের ধাক্কায় পড়ছে কফিখানা। অনেক কফিখানাই হারিয়ে গেছে, চিরতরে। বিশ্বমারির দিনগুলোতে এমন ঘটনা কেবল গতিশীলই হয়ে ওঠে।
বিশ্বমারির আগে ফ্রান্সে ছিল প্রায় ৩০ হাজার ক্যাফে। এখন সেখানে রয়েছে মাত্র ২০ হাজার। এমনকি ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝিতে এর চেয়ে তিন গুণ বেশি কফিখানা ছিল দেশটিতে। বড় বড় নগর বা শহরে কফিখানাগুলোর রূপ পরিবর্তন চলছে। ব্যক্তিত্ববাদ এবং বসবাসের ছোট পরিধির পাশাপাশি আশেপাশের এলাকাকে নতুন করে গড়ে তোলা হয়। গোটা এলাকা আধুনিক ধারায় গড়ে উঠতে থাকে। পছন্দসই সংগীত এবং চলচ্চিত্র ও ভিডিও ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তবে এরপরও ক্যাফের চরিত্রগত কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আর্জেন্টিনার 'ক্যাফেস ওয়াই বারস নোতেবেলস'
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসের ঐতিহাসিক কফিখানাগুলো নগরীর ঐতিহ্যের লালিত অংশ। এসব ক্যাফতে পদার্পণ করেন শিল্পজগতের ব্যক্তিত্বরা। ট্যাঙ্গো সংগীতে এসব ক্যাফের উল্লেখ পাওয়া যায়। সবচেয়ে খ্যাতনামা ক্যাফেগুলো 'ক্যাফেস ওয়াই বারস নোতেবেলস' বা 'নামকরা ক্যাফে এবং বার'-এর রাজ তিলকে ভূষিত হয়েছে। এগুলোর স্থাপত্য তাৎপর্য লক্ষণীয়। নগরীরা সাংস্কৃতিক মঞ্চেও চলমান অবদান রাখছে এগুলো।
কফির দুই স্থান বিশ্ব ঐতিহ্যেরে তালিকায়
ইউনেসকো কফিসংক্রান্ত দুটি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করেছে। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম স্থানটির নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। পূর্ব কিউবার এ স্থানটি ১৯ এবং ২০ শতকের প্রথম দিকে কফি উৎপাদনের কেন্দ্র ছিল। ফলে এখানে অনন্য সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি হয়েছে। ঐতিহাসিক কফিবাগান, রাস্তা, সরু পথ, সেতু, ঘরবাড়ি, জলাশয়, ময়দা কল, কফি গাঁজানোর ট্যাঙ্ক, শুকানোর শেড এবং ব্যারাকগুলোর কিছু কিছু অংশ এখনো টিকে রয়েছে। এসবই এলাকাটির অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিসংক্রান্ত অতীত দিনের ধারণা তৈরিতে সহায়তা করবে।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকোর এ তালিকায় যোগ করা হয় দ্বিতীয় কেন্দ্রটি। এটি হলো কলম্বিয়ার কফি সংস্কৃতির সাথে জড়িত প্রাকৃতিক দৃশ্য। বনের উঁচু এলাকায় ছোট ছোট প্লটে কফি জন্মানোর শত বছরের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে স্থানটি। কৃষকেরা তাদের চাষের পদ্ধতিগুলোকে পাহাড়ি পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে যথেষ্ট শ্রম ও মেধা দিয়েছে। দেশটির পশ্চিমে কর্ডিলেরা দে লস অ্যান্দেসের পাদদেশে অবস্থিত এই অঞ্চল। সেখানে স্প্যানিশ প্রভাবে গড়ে ওঠা অ্যান্টিওকিয়ানে উপনিবেশ যুগের স্থাপত্যের মিলন ঘটেছে।
গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় 'তৃতীয় স্থান'
ধারণাটি প্রবর্তন করা হয় ১৯৮০-এর দশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসাকোলার ওয়েস্ট ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞানী রে ওল্ডেনবার্গ এই 'তৃতীয় স্থানের' ধারণা প্রবর্তন করেন।
দ্য গ্রেট গুড প্লেস নামের বইয়ের সহলেখক হিসেবে ওল্ডেনবার্গ এই 'তৃতীয় স্থানের' কথা বলেন। পুস্তকটি বিস্ময়করভাবে জনপ্রিয়তা পায়। কফির খোশবুতে ভরপুর, আলোচনার গুঞ্জনে মুখর, হাসি এবং কাপে কাপে ঘষা খাওয়ার শব্দ-তরঙ্গের মধ্যে বন্ধুদের দেখা সাক্ষাৎ, প্রতিবেশীদের খবরের লেনদেন, বাণিজ্যিক কাজকর্ম সম্পাদন, অপরিচিত লোকটিরও নিজ মত ব্যক্ত করার যে জায়গা- ওটাই হলো সেই তৃতীয় স্থান।
গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় সমাজব্যবস্থায় অবাধে মতামত বিনিময়ের কথা এতে বলা হয়। আর সেসব শর্ত পূরণে তৃতীয় স্থানের নিখুঁত উদাহরণ হয়ে ওঠে কফিখানা।
কফিখানার সূচনা মধ্যপ্রাচ্যে। আর তৃতীয় স্থান হিসেবে এর অবস্থান তুঙ্গে ওঠে ১৭ শতকের ইংল্যান্ডে। রাজনৈতিক বিতর্ক বা বাদ-প্রতিবাদের ঝড় লেগেই থাকত এখানে। ইউরোপে এ কারণে কফিখানাকে বিপজ্জনক হিসেবেই ধরা হতো। ১৬৫০-এ জ্যাকব নামের এক ব্যক্তি অক্সফোর্ডে প্রথম কফিখানা খোলেন। তারপর পরই কেমব্রিজ ও লন্ডনেও খোলা হয় কফিখানা।
রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৭৫ রাজকীয় ফরমানে ক্যাফের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে ১০ দিনের মধ্যে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে হয়।
ঢাকায় বোধকরি এলিফ্যাট রোডে কফিখানা খোলা হয়েছিল সত্তরের দশকে। প্রেসক্লাবের সামনে সাবনুরিয়ান নামে একটা আইসক্রিমের দোকানেও মিলত কফি। অবশ্য তা অনেক পরে।
কফিহাউসকে গণতন্ত্রের পূর্বসূরি হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। অবাধে মতপ্রকাশ এবং একধরনের সাম্য বিরাজ করার গুণেই এমনটি হয়ে ওঠে। কফি বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে উসকে দেয় বলেই মনে করা হয়।
ইংল্যান্ডে কফিখানাকে পেনি ইউনিভার্সিটি বলা হতো। কফিখানায় ঢুকতে দিতে হতো এক পেনি। কফি পান করতে হলে তার দাম বাবদ দিতে হতো দুই পেনি। পাইপ বা হুক্কা টানতে হলে খরচ করতে হতো আরও এক পেনি। তবে মাগনাই মিলত খবরের কাগজ।
কফি কেবল পানীয়ই নয়, বরং সংস্কৃতির একটি অংশ
উসমানিয়া খেলাফত কফি চালু করে ১৬ শতকে। ধীরে ধীরে তুর্কি কফি সামাজিক জীবনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৫৫৪-এ ইস্তাম্বুলে প্রথম কফিখানা চালু হয়। ইউরোপে কফির প্রচলন ঘটায় তুর্কিরা। বলা হয়, ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনা অবরোধ ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পথে উসমানীয় সেনারা কফির থলিগুলো ফেলে আসে। আর এভাবেই ইউরোপে কফির বিস্তার ঘটে। ভিয়েনা থেকেই কফি ইউরোপের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো পশ্চিমা কফিখানার চেইন শপও খোলা হয়েছে ইস্তাম্বুলে। কিন্তু তারপরও তুর্কি কফির ধারা প্রবল বেগেই বহমান। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এ ধারা চালু রয়েছে।
তুর্কি কফি তৈরির অনন্য প্রক্রিয়া এবং সমাজে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে ইউনেসকো তুরস্কের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ২০১৩ সালে।
নিছক পানীয় নয়, বরং বন্ধুত্ব এবং আতিথেয়তার প্রতীক হিসেবে কফির উল্লেখ পাওয়া যাবে তুরস্কের সাহিত্য ও গানে। বাগদান অনুষ্ঠান, ছুটি উপভোগসহ সামাজিক উৎসবে তুর্কি-কফির দেখা মিলবে। কফি এখন তুর্কি জীবনের মূল অংশ হয়ে উঠেছে।
আনাতোলিয়ায় বিবাদ মেটাতে কফি ব্যবহার হয়। বিবাদমান মানুষগুলোকে বন্ধুত্বের কফি পরিবেশন করা হয়। সুযোগ করে দেওয়া হয় কথাবার্তা বলে নিজেদের কাইজ্জা-ফ্যাসাদ মেটানোর।
বিয়ের ক্ষেত্রে আজও তুর্কি কফির অনন্য ভূমিকা রয়েছে। পাত্রপক্ষ যখন পাত্রীপক্ষের বাড়িতে যায়, তাদের দেওয়া হয় সুন্দর করে বানানো তুর্কি কফি। অতীতে পাত্র-পাত্রীর পরস্পরকে চাক্ষুষ করার এটাই ছিল একমাত্র সামাজিক সুযোগ। পাত্রীর যদি পাত্র পছন্দ হতো, তবে চিনি দিয়ে দারুণ কফি বানিয়ে পরিবেশন করত। তবে পছন্দ না হলে চিনির বদলে নুন দেওয়া হতো। সময়ের আবর্তে আজকের দিনে অনেক পাত্রীই নুন দেওয়া কফি পরিবেশন করে পাত্রকে। পাত্রের ভালোবাসা যাচাই করাই এর উদ্দেশ্য। পাত্র যদি পাত্রীকে যথার্থই পছন্দ করে থাকে, তবে নুন দেওয়া কফি ওয়াক থু করে ফেলে দেবে না। বরং নির্বিকার চিত্তে পরমানন্দে সেই কফিকেই পান করবে।
তুর্কি আটপৌরে জীবনেও গুরুত্বের ভূমিকায় রয়েছে কফি। দিনের শুরু হয় 'সাবাহ্ কাহ্ভেসি বা প্রাতঃকফি দিয়ে। রয়েছে কেইফ কাহ্ভেসি বা আনন্দ কফি। এবং ক্লান্তি দূর করতে ইয়োগুনলাক কাহ্ভেসি বা শ্রান্তি দূরকরণের কফি।
গ্রিসে তুর্কি কফিখানা
জমানা বদলে গেছে। উসমানিয়া সাম্রাজ্য থেকে গ্রিস স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আজও গ্রিসের থেসালোনিকি শহরের উসমানিয়া যুগের একটি কফিখানা ভালোভাবেই টিকে আছে। ১৮৮৫-এ কফিখানার প্রথম মালিক ছিল একজন মুসলমান তুর্কি। কফিখানার ভেতরটি অপরিবর্তিত রয়েছে। যদিও মালিক বদলে গেছে বহু যুগ আগেই। কফিখানার আদি মালিক কখনো নরসুন্দরের কিংবা কখনো দন্ত চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করতেন। থেসালোনিকির এ কফিখানা, ওউজেরি সিনারিতে, এখন অবাধে ঢুকতে পারে ললনারা। পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় কেন্দ্র হয়ে বিরাজ করছে। সিনারির সামনে ছবি তুলতে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। একজাতীয় গাছের তুর্কি নাম থেকে সিনারি নামটি নেওয়া হয়েছে। শুধু কফিখানাই নয়, গোটা এলাকাই ওই গাছের নামে নামকরণ করা হয়।
কফির উৎসভূমি ইথিওপিয়া
লোককাহিনি বলছে, আবিসিনিয়ার এক রাখাল প্রথম কফির উদ্দীপনা সৃষ্টির গুণ সম্পর্কে অবহিত হয়। প্রথম দিকে কফি কেবল মুসলমানদের পান করতে দেওয়া হতো। ঐতিহাসিকভাবে দেশটির নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে কফি।
রাজধানী আদ্দিস আবাবার ৪৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কাফা অঞ্চলের অবস্থান। আরবীয় কফি প্রজাতির জন্মস্থান হিসেবে এই অঞ্চলটি পরিচিত। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো এ এলাকাকে জৈবমণ্ডলী সংরক্ষণ অঞ্চল বা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গোটা এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বুনো কফিগাছ আছে। কাফাকে যথার্থই কফির জীববৈচিত্র্যের একটি উল্লেখযোগ্য অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা যায়।
বর্তমানে ইথিওপিয়ার সব জায়গায় কফির সুগন্ধি পাওয়া যাবে। অর্থাৎ কফি উপস্থিত রয়েছে। উৎসবের দিনগুলোতে কফি পায় আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিলাসবহুল হোটেল, বিমানবন্দর থেকে রাস্তার পাশের দোকান পর্যন্তÑসব জায়গায় কফি আর কফি।
বিশেষ বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে কফি তৈরির সাথে ঘিরে থাকে শৈলী। কীভাবে চলাফেরা করল, কফি বানাতে কী ধরনের পাত্র ব্যবহার করা হলো, এমনকি কাপড়চোপড় পরল, তারও গুরুত্ব রয়েছে। বাড়ির কর্ত্রী এ সুযোগে নিজ সক্ষমতা তুলে ধরে। অন্যদিকে তরুণীরা নিজেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের অবকাশ তৈরি করে নেয়। আগরবাতি বা ধূপকাঠির সুগন্ধের সাথে কফির খোশবু মিলেমিশে উৎসবের ভিন্নতর অনন্য আমেজ তৈরি হয়ে গোটা দেশে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে বেড়ানোর ধুম পড়ে যায়। আপ্যায়নে চিনি বা মসলা দিয়ে বানানো কফির সাথে পরিবেশন করা হয় ভাজা বিচি বা নোনতা পপকর্ন।
কোরিয়ায় কফির কথা
কোরিয়া প্রজাতন্ত্র এক দশকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কফির বাজারে পরিণত হয়েছে। কোরীয়রা কফিখানা পছন্দ করে। তাদের পছন্দ সেসব কফিখানা ছবিতে বিশেষ করে ইনস্টাগ্রামে দেওয়া ছবিতে সুন্দর দেখাবে। ছবির জন্য সুন্দর কফিখানা তাদের বিশেষ পছন্দনীয়। দেশটিতে কফি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে কারণ রয়েছে দুটো। দ্রুতলয়ের নগরজীবন এবং আন্তর্জাতিক কফি বিপণনকারীদের দেশটিতে আগমনÑএই দুইয়ের যোগফলে দক্ষিণ কোরিয়া কফিভক্ত বনে যায়। এ প্রবণতাকে প্রাণ দেয় দেশটির জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানমালা। (এখানে উল্লেখ করতে হয়: কফিশপের সুন্দর গোছানো পরিবেশ, আলো- ঢাকার তরুণ-তরুণীদেরও ছবি তোলার পছন্দের জায়গা। সেলফি তোলা হবেই, তারপর তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় নিমিষেই ফেসবুক, ইনস্টায়।)
সিউলের সবচেয়ে বিলাসবহুল কফিখানায় আসন জোগাড় করতে দশ দিনও লাগতে পারে। পুরো কফিখানায় রয়েছে সোনালি রঙের চেয়ার-টেবিল। সাথে রয়েছে মানানসই কাপ-প্লেট প্রভৃতি। ব্রিটিশ এক ফ্যাশন বুটিক হাউস চালু করে এ কফিখানা। প্রথম দিন অনলাইন রিজার্ভেশন শুরু করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব আসন ভর্তি হয়ে যায়। এখানে তালিকার সবচেয়ে সস্তা কফি হলো লাতে এবং দাম সাড়ে সাত মার্কিন ডলার। দেশটির ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন শ্রম মজুরির চেয়ে একটু বেশি এ দাম।
গড়পড়তা পূর্ণ বয়সী কোরীয় বছরে ৩৫৩ কাপ কফি খায়। এটি হলো ২০১৮-এর হিসাব। এতে দেখা যায়, ২০১৫-এর তুলনায় তারা গড়ে ৬০ কাপ কফি বেশি খাচ্ছে। হুন্দাই রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানায়, বিশ্বে গড়ে যে পরিমাণ কফি পান করা হয়, তার চেয়েও তিন গুণ বেশি পান করে কোরিয়ার নাগরিকেরা। ২০২১-এর এক হিসাবে দেখা যায়, দেশটিতে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য ১৫০০ ক্যাফে রয়েছে। জাপানে রয়েছে ৫২৯টি, যুক্তরাজ্যে ৩৮৬টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ১১৭টি।
ক্যাফে সেখানে সামাজিকতার কেন্দ্র
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে-ইমানুয়েল নিদদিলস্কি কফি পানের সামাজিক দিকগুলো নিয়ে লিখেছেন সন্দর্ভ। তিনি বলেন যে কফিখানা এমন এক স্থান, সেখানে মানুষ পরস্পরের সাথে মিলিত হতে চায়। একই জায়গা নানাভাবে ব্যবহার করা হোক, তাতেও আপত্তি নেই তাদের। এভাবেই ক্যাফে ফরাসি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
ফরাসি দেশে প্রথম কফির আগমন ঘটে ১৭ শতকে। প্রথমে মার্সেই বন্দরে, পরে রাজদরবার আবির্ভূত হয় কফি। ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসের ক্যাফে লে প্রোকোপের সফলতার মধ্য দিয়ে ফরাসি জনজীবনে কফি প্রিয় পানীয় বনে যায়। ঝাড়বাতি, আয়না ও মর্মর পাথরের টেবিলে সজ্জিত মনোরম গৃহসজ্জা, আরামদায়ক স্থান এবং সবচেয়ে গুরুত্বের, অনবদ্য কফির আয়োজন ছিল এখানে। লে প্রোকোপের সাজসজ্জা পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যান্য কফিখানাও গ্রহণ করে। এদিকে দ্রুত বুদ্ধিজীবী মহলের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে লে প্রোকোপ। এরই অনুসরণে প্যারিসজুড়ে আরও কফিখানা গড়ে ওঠে।
'এক কাপ কফি, না হয় আত্মহত্যা'
ইরানে কাজার যুগে কফিকে হটিয়ে বাজারে দখল করে চা। এখনো চা-ই প্রধান পানীয়। দুধ ছাড়া চা। চিনি মেশানো হয় না। কান্দ বা কিউব সুগার কিংবা খেজুর, শুকনা আনজিরের (ডুমুর) মতো মিষ্টি কিছু মুখে পুরে রাখা হয়। তারপর চলে চায়ে চুমুক। আর জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় না। তৈরি হয় সামোভারে। তবে তেহরানে নানা ধরনের কফিখানা আছে। তেহরানের অন্যতম সুন্দর সড়ক ওয়ালি আসর দিয়ে বানাক থেকে দে হাসপাতালের নিচের দিকে নেমে গেলে ইরানের সম্প্রচার সংস্থা 'সেদা ও সিমার' মারকাজে বেহদাশত বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পথে হাতের ডানে, বাঁয়ে বিআরটি বাসকেন্দ্রের ঠিক সামনেই, একটি কফিখানায় দরজায় বড় বড় করে ইংরেজিতে লেখা ছিল আলবেয়ার কামুর বক্তব্য-'শুড আই কিল মাইসেলফ, অর হ্যাভ আই এ কাপ অব কফি'। কামু কথাটা সত্যিই বলেছেন কি না, তা খুঁজে বের করতে পারিনি। যা-ই হোক, ভেতরটা ছিল বই দিয়ে সাজানো। দু-একবার সেখানে গেছি। হঠাৎ একদিন দেখি আর নেই কফিখানাটি! বন্ধ।
'ক্যাফে সোসপেসো'
ইতালীয় শব্দগুচ্ছ বাংলা করলে মোটামুটি অর্থ হবে 'স্থগিত কফি'। নেপলসের শ্রমজীবী মানুষদের ক্যাফে থেকে গড়ে ওঠা মানবিক এক ঐতিহ্য ধারা। ক্রেতা দুই কাপ কফির মূল্য দেবেন। কিন্তু নিজে নেবেন একটা। অন্যটা স্থগিত থাকবে। অনটনে আছেন এমন কেউ এসে চাইলেই তাকে দেওয়া হবে এ কফি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে এ প্রথা খুবই জনপ্রিয়তা পায়। অভাব বেড়ে যাওয়ায় অনেকের পক্ষেই তখন পানীয় তো দূরে থাক, খাবারের কড়ি জোটানোই মুশকিল ছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক বিকাশের তোড়ে এ ঐতিহ্য প্রায় ভেসেই যায়। ২০০৮-এর মন্দা এবং সামাজিক সংহতি আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আবার তা ফিরে আসে। 'স্থগিত কফি' সমাজের প্রতি সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠে।
এখন এ প্রথা কেবল ছোট ছোট ক্যাফেতেই আটকে নেই; বরং বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কফি চেইন শপগুলোতে চালু হয়েছে। 'ক্যাফে সোসপেসো'র দেখানো রাস্তায় তৈরি হয়েছে বড় বড় বিপণিকেন্দ্রগুলোতে 'স্থগিত বাজার করা'। কোভিড ১৯ বিশ্বমারির ঘরবন্দী দিনগুলোতে এ প্রথা চালু হয়।
তুলনামূলকভাবে ছোট ছোট কাজ কীভাবে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি করে বা সুযোগ সৃষ্টি করে, তারই উদাহরণ হয়ে উঠছে এসব প্রথা।
উল্লেখ্য, উসমানিয়া শাসনামলে 'আসকাদা একমেক' বা 'ঝুলন্ত রুট' নামে ঐতিহ্য চালু ছিল গোটা সাম্রাজ্যে। ক্রেতা দুটো রুটির দাম দিলেও নিতেন একটি। কিংবা কয়েকটা রুটি কিনলেও একটা বা দুইটা নিতেন না। বাকি রুটি থাকত অভাবী ব্যক্তির জন্য। এভাবে দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই আড়ালেই থেকে যেতেন। কেউ কারও পরিচয় জানত না। ভালো কাজ সারা হতো চুপেচুপে।