স্বাস্থ্যসেবার জগৎকে বদলে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রকে নির্ভুলতম করবে। কমিয়ে আনবে রোগ নির্ণয়ের সময়কে। পাশাপাশি চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ককে করবে উন্নত। স্বাস্থ্য সেবা খাতে এআইয়ের ভূমিকা নিয়ে সাপ্তাহিক টাইমের বিশেষ সংখ্যায় নিবন্ধ লিখেছেন ইন্ডিয়ানার ফোর্ড ওয়েনের পুরস্কার বিজয়ী ফ্রিল্যান্স রাইটার কারেন আসপ।
রোগবিজ্ঞান বা প্যাথলজির প্রতিবেদন থেকে ক্যানসার খুঁজে বের করতে এআই সময় নেয় এক সেকেন্ডের চার ভাগের এক ভাগ সময়। শুনে কী মনে হলো? না, তেমন অগ্রগতি হয়নি। আচ্ছা, তাহলে মানুষের সাথে তুলনা হয়ে যাক। গড়ে একজন বিশেষজ্ঞ মানুষের এ প্রতিবেদন ঘেঁটে ক্যানসার শনাক্ত করতে লাগতে পারে ৯০ সেকেন্ড থেকে তিন মিনিট। এ আইয়েয়র যে সময়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা নেয় আজরা এআই। এবার হিসাবটা আরেকটু বিস্তৃতভাবে দেখা যাক। হ্যাঁ, তিন মাসে এই প্রযুক্তি মানুষের কাজের সময় বাঁচিয়েছে ১১,১৪১ ঘণ্টা। ৮ কর্মঘণ্টা ধরে হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৩৯২ দিন। ক্যানসারবিষয়ক সাময়িকী জার্নাল অব অনকোলজিতে প্রকাশিত হিসাবে আরও বলা হয়েছে, এতে রোগীরা চিকিৎসা পেয়েছেন সাত দিন আগে।
এআই কীভাবে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে, এটি তারই একটা মাত্র উদাহরণ। ভবিষ্যতে এটি আরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। একই সাথে নিয়ে আসবে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও।
ভেতরে রয়েছে যে মস্তিষ্ক
প্রথমে কারও কারও কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেকেই আইফোনের সিরি, রোবটচালিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করেছেন। কিংবা আলেক্সাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। মানে দাঁড়াল, এইআইয়ের সাথে এরই মধ্যে আপনার প্রাথমিক মোলাকাত হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, সত্যিকার অর্থে এআই বলতে কী বোঝানো হয়? কেউ কেউ অতি প্রচলিত মজাও এখানে করতে পারেন। এআই কী খায় না মাথায় দেয়! পাঠ্য বইয়ে দেওয়া সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মানুষের ঠিক করে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা যে বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে পারে, তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। অ্যানোসেন্স নামে জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও লুরং প্যান পিএইচডি এ কথা বলেন। এআই-চালিত ওষুধের নকশা খাটিয়ে নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে অ্যানোসেন্স। তিনি আরও বলেন, একটি বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থা হিসেবে কমপক্ষে এআইকে নির্দিষ্ট পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের স্থলাভিষিক্ত হতে হবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের যেসব উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করার সক্ষমতা নেই, তা অর্জন করবে অত্যাধুনিক এআই।
এমন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে এইআই প্রযুক্তিকে শিক্ষণের পর্যায় পাড়ি দিতে হয়। এটি মানুষের শিক্ষণ প্রক্রিয়ারই অন্য রূপ। একো নামের সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা কনোর ল্যান্ডগ্রাফ বলেন, ব্যাখ্যা এবং বারবার একই কাজ করতে করতে শিক্ষা লাভ করে শিশুরা। একইভাবে শিক্ষণ পর্ব পার হতে হয় কম্পিউটারকেও। এআই চালিত প্রথম স্টেথোস্কোপ বানিয়েছে একো।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এআই যন্ত্রকে একোর পক্ষ থেকে হাজার হাজার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনানো হয়েছে। হৃদ্রোগ থাকলে হৃৎপিণ্ডের শব্দে যে ধ্বনি শোনা যায় বা হৃৎপিণ্ডের যে শব্দধ্বনি, তা থেকে স্বাভাবিক ধ্বনি আলাদা করতে হয়েছে এ যন্ত্রকে। বারবার একই কাজ করার মধ্য দিয়ে কম্পিউটারের অ্যালগরিদম নিজে নিজেই এবারে হৃৎপিণ্ডের শব্দধ্বনি আলাদা করার মতো দক্ষতা অর্জন করেছে। (কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় কোনো সমস্যা সমাধান বা কাজ সম্পাদনের জন্য যে একগুচ্ছ নির্দেশ দেওয়া হয়, তাকেই অ্যালগরিদম বলা হয়।) এখন এআই স্টোথো মাত্র ১৫ সেকেন্ডেই হৃদ্রোগ ধরতে পারে। তিনি আরও বলেন, এআই দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ কাজটি করছে, তা কেবল নয়। বরং মানুষের চেয়ে নির্ভুলভাবেই করছে নিজ কাজ। এআই-চালিত এই স্টোথো সারা দুনিয়ার হাজার হাজার চিকিৎসক ব্যবহার করছেন। কম সম্পদশালী দেশগুলোতেও এর ব্যবহার চলছে। সেখানে দিনে দুই হাজার রোগী দেখার কাজ করতে পারছে এ চৌকস যন্ত্র। (প্রসঙ্গত, যতটুকু খোঁজ নিয়েছি জানতে পেরেছি যে বাংলাদেশে এখনো এর ব্যবহার শুরু হয়নি)
এআইয়ের মানুষের মতো চিন্তা করার এবং শেখার ক্ষমতায় প্যান অবাক নন। তিনি বিস্মিত হন এর নতুন জিনিস কল্পনা করার ব্যাপক সক্ষমতা দেখে। গবেষক এ নারী বলেন, এআইয়ের কল্পশক্তির ব্যাপকতা মানুষের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। বিজ্ঞানী বিশেষ করে ওষুধবিজ্ঞানীরা ছোট এবং সহজে গ্রহণযোগ্য নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করছেন। অ্যাসপিরিন এবং অ্যান্টিহিস্টামাইন ডিফেনহাইড্রামাইন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নাম বেনাড্রিল, (বাংলাদেশে অ্যারিল, বেনা-ফ্লু, ডিডরিল, ডিফিন বা ডোরেনটার) নামের এই ওষুধগুলো অনেকের ঘরেই আছে।
কেবল মানুষকেই এককভাবে এমন ওষুধ খুঁজে বের করার জন্য পরীক্ষা চালাতে হলে একজন বিজ্ঞানী বা রসায়নবিদকে ক্লিনিক্যাল বা মানুষের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপযোগী একটি অণুকে পাওয়ার জন্য মোটামুটি ৬০ হাজার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। একই কাজে এআইকে নামানো হলে ক্লিনিকাল পর্যায়ে নেওয়ার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় প্রায় দেড় শতে। এতে কমে খরচ এবং সময় উভয়ই। সব মিলিয়ে ওষুধটি রোগীর কাছে তুলনামূলকভাবে দ্রুত পৌঁছে যায়। দামেও পড়ে সস্তা।
সুপ্রভাবের কথামালা
গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা শিল্প এআইকে খাটাচ্ছে। ওষুধ আবিষ্কারের কাজে আরও আগে থেকেই এআইকে লাগানো হচ্ছে। পর্দার আড়ালে এআই ব্যবহারের বিষয়টি গড়পড়তা রোগী বা ভোক্তা বা সাধারণ পর্যায়ের মানুষজন তেমন কিছুই জানেন না। কথাটি বলেন আজরা এআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ক্রিস ক্যাশওয়েল। তার এ প্রযুক্তি আমেরিকার দুই শ হাসপাতাল ব্যবহার করছে। এআইয়ের প্রয়োগক্ষেত্র সুবিশাল হতে পারে। কিন্তু জার্নাল অব ফ্যামিলি মেডিসিন অ্যান্ড প্রাইমারি কেয়ারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার হচ্ছে। এসব ক্ষেত্র হচ্ছে, ওষুধ তৈরি, রোগ নির্ণয়, স্বাস্থ্য পরিকল্পনা বিশ্লেষণ, স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিবীক্ষণ, ডিজিটাল পরামর্শ, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা, চিকিৎসা উপাত্ত ব্যবস্থাপনা এবং ব্যক্তি উপযোগী সুনির্দিষ্ট ওষুধ তৈরি করা।
অদূর ভবিষ্যতে হাসপাতাল রোবটে রোবটে ভরে যাবে—ওপরের সমীক্ষায় তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে! আপনি কি তা-ই ভাবলেন? তাহলে, 'ভুল সবই ভুল'। কারণ, এ ধারণা ঠিক নয়। ২০২০ সালে ১ লাখ ৭০ হাজার রোগীর ওপর চালানো এক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় উঠে আসে, ২০১৮ থেকেই সব ধরনের সাধারণ শল্যচিকিৎসার ১৫.১ শতাংশই রোবটের মাধ্যমে করা হচ্ছে। তারপরও এআইয়ের শল্যচিকিৎসাবিষয়ক প্রযুক্তি দেখাশোনা বা তদারকির জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে মানুষেরই ওপর। এ সমীক্ষা প্রকাশ করেছে জামা (জেএএমএ বা জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়শন) নেটওয়ার্ক ওপেন। এ থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে, মানুষকে আরও উৎপাদনমুখী হতে এবং দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে সহায়তা করতে পারে এআই। সব মিলিয়ে এআই এবং মানুষের সম্মিলনে খরচ নিয়ে উৎকণ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা, চিকিৎসক এবং সর্বোপরি রোগী-সাধারণের ঘরেই যাচ্ছে লাভের 'গুড়'। ক্যাশওয়েল ব্যাখ্যা দেন, এআইকে কাজে খাটানোয় চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত মানুষগুলোকে এখন উপাত্তের পেছনে কম সময় দিতে হচ্ছে। তারা এখন বেশি সময় দিতে পারছেন রোগীকে।
ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ডস বা ইএইচআর থেকে রোগীসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে সত্যিই এআই সহায়তা করে কি না—তা জানার জন্য জামা নেটওয়ার্ক ওপেন সম্প্রতি এক স্বাস্থ্য সমীক্ষা চালায়। এতে উঠে আসে, এ ক্ষেত্রে কেবল উচ্চ মাত্রায় নির্ভুলতা বজায় রাখতে এআই সহায়তাই করে না, বরং রোগীর কাগজপত্র পর্যালোচনা করতে চিকিৎসককে যে সময় খরচ করতে হয়, তা-ও ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। কোনো রোগী চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় ঠিক করার পর তার চিকিৎসাবিষয়ক কাগজপত্র চিকিৎসক পর্যালোচনা করেন। বেঁচে যাওয়া সময় একজন সৎ চিকিৎসক এবারে রোগীর পেছনেই খরচ করবেন।
চট করে এ বক্তব্য নাটকীয় না-ও মনে হতে পারে। এভাবে বেঁচে যাওয়া সময়ের ভাগ শেষ পর্যন্ত পাবেন প্রত্যেক রোগীই। জামা সমীক্ষার সহপ্রধান এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক স্নাতক ইথান এ চি বলেন, এআই পরিচালিত ইএইচআর কেবল চিকিৎসকদের ভুল করার আশঙ্কা কমাবে না; বরং রোগীদের আরও সেবা দিতে সহায়তা করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা হলো, সম্ভাব্য ক্ষতিকারক ওষুধের প্রতিক্রিয়া নিয়ে এএই আগেভাগেই চিকিৎসককে অবহিত করতে পারবে। এ ছাড়া মনোযোগ এড়িয়ে গেছে এমন বিরল কোনো রোগ-লক্ষণের কথাও চিকিৎসকের কাছে তুলে ধরতে পারবে।
ভবিষ্যতের সোনারঙের দিনগুলো
স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ উদ্ভাবন ও বিকাশের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাবের ডানা বিস্তার করেছে এআই। আসছে যত আসবে তত বলে গ্রামবাংলায় কিছু শ্লোক বলা হয়। সেই একই ঢঙে বলা যায়, বিশেষজ্ঞরা জানান, এআইয়ের ভবিষ্যৎ আরও প্রতিশ্রুতিশীল। প্যানের ধারণা, মোটামুটি ১০ হাজার রোগবালাইয়ের বেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এআই। এর মধ্যে আট হাজারই হলো জেনেটিক বিরল অসুখ-বিসুখ। আজও এসব রোগের কোনো চিকিৎসা বের করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, এআইয়ের সহায়তায় এসব অসুখ-বিসুখ দ্রুত এবং সহজে নির্ণয় করা যাবে। এতে চিকিৎসাও সম্ভব হবে। আশা করা হচ্ছে, এ ধরনের প্রতি রোগের ওষুধ উদ্ভাবন করার সময় এবং খরচ উভয়ই ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ বাঁচবে। আর চিকিৎসার খরচ নেমে আসবে সহনীয় স্তরে।
এ কথায় সুর মেলান আজরা এআইয়ের ক্যাশওয়েল। তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিবিশেষের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উপাত্ত অধিক হারে পাওয়া যাবে। এতে ব্যক্তিবিশেষের স্বকীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং উপসর্গ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য মিলবে। শেষে চিকিৎসাপদ্ধতিও ব্যক্তিবিশেষের আরও উপযোগী হয়ে উঠবে। ঘটনাক্রমে রোগ-উপসর্গ পাওয়ার বিষয়ে আজরার তৎপরতাকে আরও উন্নত করা হচ্ছে। চিকিৎসক যে রোগের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশপত্র দিয়েছেন, তার সাথে এই রোগ-লক্ষণের কোনো মিলই নেই এমন রোগ-লক্ষণও ধরা পড়ছে। এই যেমন এক রোগীর তলপেটের সিটি স্ক্যান করার সময় তার ফুসফুসে এক ধরনের ফুসকুড়ির খোঁজ পাওয়া যায়।
এআইয়ের সহায়তা নিয়ে এ ধরনের রোগ বের করা যাবে। রোগের গতিবিধির ওপর নজর রাখা যাবে। রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। এসবই গভীরভাবে করা যাবে। তার বক্তব্যের মর্মার্থ হলো, ক্যানসারকে আগেভাগে শনাক্ত করতে চাই, প্রথম দিকে ক্যানসারের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে সহজ। পরবর্তীতে জটিল অবস্থা নিয়ে যেন রোগীকে ফিরে আর আসতে না হয়। এ ছাড়া ঘটনাক্রমে পাওয়া রোগ-লক্ষণ নিয়ে কখন আদৌ মাথা ঘামাতে হবে না, সে বিষয়েও দিকনির্দেশনা দিতে পারবে এআই। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি রকমের মাত্রাছাড়া চিকিৎসার মতো ভুল করার প্রয়োজনও পড়বে না।
বাড়িতে ব্যবহারযোগ্য এআই-চালিত যন্ত্রপাতির সহায়তায় হৃদ্ বা ফুসফুসের রোগাক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা আরও সহজ হবে।
বর্তমানে এমন রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হয়। ভবিষ্যতে তারা ঘরে বসেই এআই-চালিত যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে পারবেন। এগুলো তাদের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ এবং অক্সিজেনের মাত্রার মতো বিষয়গুলো পরিমাপ করতে পারবে। রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ব্যবহারে যতটা দক্ষতা লাগে, এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারেও লাগবে ততটা বা তারচেয়েও কম। রোগীর কাছ থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর কাজ করবে যন্ত্র মহোদয়।
এতে হৃদ্ বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেখাশোনা ও চিকিৎসা সহজ করে তুলবে। পাশাপাশি এসব রোগীর পক্ষে সুস্থ ও মানসম্পন্ন জীবন যাপন করাও সহজ হবে। আর সময়, ঝক্কি এবং অর্থও বাঁচবে। সব মিলিয়ে রোগবলাই নিয়ে মানুষের অনেকাংশে কমে আসবে।
তবে এইআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই—পাশাপাশি এ কথা ভাবাও ঠিক হবে না। প্যান জানান, এর মধ্যে অন্যতম হলো, এআইকে প্রধানত উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। উপাত্তের মানের ওপর এআইয়ের সক্ষমতা নির্ভর করে। অন্যভাবে বলা যায়, উপাত্ত খারাপ দিলে ফলাফলও খারাপ হবে।
এ ছাড়া এআই এমন এক প্রযুক্তি, যা সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। বা আস্থাও রাখা যায় না। এ কারণে অনেকেই উদ্বেগে পড়েছেন। প্যান বলেন, এআই হলো জ্ঞানের কৃষ্ণবাক্স। প্রচলিত রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের নিয়মকানুন দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। ফলে বিশেষজ্ঞরা সহজে এর ওপর আস্থাও রাখতে চান না বলে প্যান জানান।
এআইয়ের সম্ভাবনা অনেক প্রতিশ্রুতির জন্ম দিয়েছে; তবে প্রকৃত অর্থে এআইয়ের তৎপরতা মাত্র শুরু হয়েছে। হয়তো একমাত্র এআই কেবল জানে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে সে কীভাবে সাজাবে।
রোবটকে দেখছে কে?
কুইনাইন নিয়ে যে প্রশ্ন করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, এবারে প্রায় সে রকম প্রশ্ন উঠেছে রোবট এবং এআইকে নিয়ে। কুইনাইন জ্বর সারাবে কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? প্রশ্ন করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। একইভাবে হলিউডের কল্যাণে রোবটের দুর্বৃত্ত স্বরূপ আমরা দেখতে পাই, এআই-চালিত যন্ত্র, যা দুনিয়া দখল করে নিচ্ছে। আর এ থেকেই প্রশ্নটা উঠেছে, হ্যাঁ, চৌকসভাবে কাজ করছে রোবট। এবারে রোবট কী সত্যিই দুনিয়া দখলে নেওয়ার মতো চৌকস হয়ে উঠতে পারবে? তাহলে কে ঠেকাবে?
কুইনাইন কে সারাবে, সে প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। কিন্তু রোবট নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার সহজ এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো—না। রোবট দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নিতে পারবে না। এর কারণও সহজ। এআইকে চৌকস করে তোলার পেছনে কাজ করছেন উপাত্ত বিজ্ঞানী বা ডেটা সায়েন্টিস্টরা। আজরা এআইয়ের ক্যাশওয়েল বলেন, এসব বিজ্ঞানী নিরলস এবং অবিরামভাবে এআইয়ের তৎপরতার ওপর চোখ রাখছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে সাঁতারখানা বা সুইমিং পুলের উদাহরণ দেন। পানির রাসায়নিক পরিস্থিতি সঠিক আছে কি না, তা দেখার জন্য প্রতি সাঁতারখানায় কেউ না কেউ পানি পরীক্ষা করছেন। একই কাজ করছেন উপাত্ত বিজ্ঞানীরা। চাবি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এখন বাকি জীবন চলতে থাকবে— বিষয়টা এমন না, এ আইয়ের জগৎ মোটেও এমন না। এ ক্ষেত্রে প্রোগ্রাম করার মধ্য দিয়ে উপাত্ত বিজ্ঞানীর কাজ শেষ হয়নি। বরং প্রতি সপ্তাহ, দিন বা ঘণ্টায় ঘণ্টায় এআইয়ের তৈরি উপাত্ত পরীক্ষা করে দেখছেন তারা। উপাত্ত সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে কি না, তার ওপর নজর রাখছেন।
একপেশে কোনো উপাত্ত এআইকে দেওয়া হচ্ছে কি না বা এআইয়ের কাজে কেউ আড়াল থেকে নাক গলাচ্ছে কি না, তা-ও ধরার সুনির্দিষ্ট কলাকৌশল আছে। এর মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসে—যথার্থ তথ্য এআইকে জোগান দেওয়া হয়েছে কি না বা কোথাও নাক গলানোর মতো ঘটনা ঘটেছে কি না।
কোনো ফলাফলকে গোলমেলে মনে হলে কী করা হবে? ফলাফলের সীমানা কী হতে পারে, তা আগেই ঠিক করা থাকে। এই পরিসীমার বাইরে চলে গেলে ওই যন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করার প্রশিক্ষণ আবার দেওয়া হয়।
হাঁটুর চাকতি অপারেশন করছে যে রোবট-সার্জন, সে কি হঠাৎ করেই হাঁটু কেটে বাদ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? না, পারবে না। কারণ, তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন একজন বিশেষজ্ঞ।
কাজেই এআই-চালিত রোবটের দখলে চলে যাবে বিশ্ব—এমন দুঃস্বপ্ন দেখার কোনো দরকার আপাতত নেই। মানুষই এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে—এটা যেন মনে থাকে। উপাত্ত বিজ্ঞানীরা এখনো এআই পরিচালিত রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কাজেই এগুলো নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য।
এআই-চালিত রোবট এখনো কুইনাইনের পর্যায়ে যায়নি, তাই সারাবার প্রশ্নই আসে না।