আয়নার ভয়!
আব্রাহাম লিংকনকে কে না চেনে! যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত সাবেক রাষ্ট্রপতিদের একজন তিনি। তবে তার ব্যাপারে একটি অদ্ভুত তথ্য হয়তো অনেকেরই অজানা। তিনি যখন মারা গেলেন, হোয়াইট হাউজের সকল আয়নাই পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
কেন এ কাজ করা হয়? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই কাজটি করা হয় এমন বিশ্বাস থেকে যে সদ্যই পরপারে পাড়ি জন্মানো মানুষদের বিদেহী আত্মা আয়নায় আটকা পড়তে পারে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই প্রচলিত রয়েছে এমন বিশ্বাসের, যে-কারণে সেসব সংস্কৃতির মানুষ তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন মারা যাওয়া মাত্রই ঘরের সব আয়না ঢেকে ফেলে। বিশেষত ভিক্টোরিয়ান যুগের ব্রিটেনে এই কুসংস্কারের বিষয়টি বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে উঠে এসেছে।
বলাই বাহুল্য, এটি নিছক কুসংস্কার বৈ আর কিছুই নয়। আয়না নিয়ে এমন আরও অসংখ্য কুসংস্কার রয়েছে। রয়েছে নানা মিথ। এই লেখায় তেমনই কয়েকটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব আপনাদের।
সাত বছর কপালের গেরো
আয়না নিয়ে প্রচলিত সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত কুসংস্কারটি হলো, আপনি যদি কোনো আয়না ভেঙে ফেলেন তবে তা আপনার জন্য সাত বছরের দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। এই কুসংস্কারের জন্ম সেই প্রাচীন গ্রিক সমাজ থেকেই। তারা বিশ্বাস করত, প্রতি সাত বছর পরপর 'জীবনের পুনরুজ্জীবন' ঘটে। হয়তো সে-কারণেই কুসংস্কারটির মাঝে 'সাত' সংখ্যার এত তাৎপর্য।
এদিকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে আয়না ভাঙাকে দুর্ভাগ্যজনক তো নয়ই, বরং সৌভাগ্য বা ইতিবাচকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মনে করা হয়, আয়না ভেঙে গেলে কোনো একটা অশুভ শক্তি গৃহ ছেড়ে যাচ্ছে বা শুভ কিছুর সূচনা ঘটতে যাচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, আপনি যদি কুসংস্কারাচ্ছন্ন না-ও হন, তবু আয়না ভেঙে গেলে খুশি বা বেজার হওয়ার বদলে আপনার একটু সাবধান হওয়াই ভালো। কেননা ভাঙা আয়নায় আপনার বা আপনজনদের পা কেটে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাছাড়া ভাঙা আয়না সরাতে গিয়ে অন্য নানাবিধ হতাহতের শঙ্কাও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
আয়নায় নিজেকে দেখলেই বিপদ!
কাছের মানুষের মৃত্যুর পর আয়না ঢেকে রাখার কুসংস্কারটিরই একটি সম্প্রসারিত রূপ বলা চলে এটিকে। প্রাচীন জার্মান ও ডাচরা বিশ্বাস করত, কেউ যদি আপনজনকে হারানোর অব্যবহিত পরেই নিজের ছায়াকে দেখতে পায় আয়নায়, তার মানে হলো, এরপরে ঘনিয়ে আসছে তার নিজেরই মৃত্যু!
ব্লাডি মেরি
পশ্চিমা দেশগুলোতে 'ট্রুথ অর ডেয়ার' গেমের একটি খুবই জনপ্রিয় 'ডেয়ার' আছে। কী সেটি? তা হলো, আধো আলো জ্বলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ১৩ বার ব্লাডি মেরির নাম নিতে হবে।
যেহেতু এটি একটি 'ডেয়ার', সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কাজটি নেহাত সহজ কিছু নয়। লোককথায় প্রচলিত আছে, এভাবে আয়নার সামনে ব্লাডি মেরিকে ডাকলে নাকি বাস্তবিকই তার প্রেতাত্মা এসে হাজির হয়।
এছাড়া ডাকিনীবিদ্যা বিষয়ক বিভিন্ন লেখায় এই খেলারই আরেকটি ভিন্ন সংস্করণেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। কোনো এক গভীর রাতে যদি হাতে একটি মোমবাতি নিয়ে আপনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র তিনবারও 'ব্লাডি মেরি' উচ্চারণ করেন, এবং আরও কিছু আচার-প্রথা পালন করে চোখ বন্ধ করেন, তাহলে নাকি চোখ খোলার পরই আয়নায় দেখতে পাবেন ব্লাডি মেরি দাঁড়িয়ে রয়েছে আপনার ঠিক পেছনে!
প্রতিবিম্ব নেই = আত্মা নেই
অনেক সংস্কৃতিতেই ভাবা হয়ে থাকে, আয়নায় আসলে আমাদের বাহ্যিক রূপের নয়, বরং আমাদের আত্মার প্রতিফলন ঘটে। আর সেই ভাবনা থেকেই বিভিন্ন উপকথার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন : ভ্যাম্পায়ার কিংবা ডাইনিদের মতো অতিলৌকিক সত্তারা আয়নার সামনে দাঁড়ালেও কোনো প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না, কেননা তাদের তো কোনো আত্মাই নেই!
এসব আষাঢ়ে গপ্পো শুনতে মজা লাগলেও, বাস্তব জীবনে এসবের প্রয়োগ ঘটানো নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার। তারপরও যদি কখনও আপনার মন খারাপ থাকে, আত্মবিশ্বাসহীনতায় থাকেন, তবে একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতেই পাবেন। আয়নায় প্রতিফলিত চেহারাটা আপনার আত্মার না হোক, রক্ত-মাংসের আপনার তো বটেই। আর সেটাই অনেক সময় টনিকের মতো কাজ করতে পারে আপনার মেজাজকে চাঙ্গা করে দিতে!
ভবিষ্যৎ স্বামী দর্শন
এবারের কুসংস্কারটি বোধ করি যতটা না আয়না বিষয়ক, তারচেয়েও অনেক বেশি মানবমনের সূক্ষ্ম কামনা-বাসনা সংশ্লিষ্ট। প্রায় সকলেই চায় তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে। আর যদি জেনে নেওয়া যায় ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গী সম্পর্কে, তাহলে তো কথাই নেই! সেই অতি মানবিক ইচ্ছাটারই জানান দিচ্ছে এবারের কুসংস্কারটি।
বলা হয়ে থাকে, হ্যালোইনের মাঝরাতে যদি কোনো নারী একটি আপেলকে লম্বা অবিচ্ছিন্ন ফালিতে কাটে, এবং সেই আপেলের খোসাটিকে ডান হাত দিয়ে নিজের বাম কাঁধে ছুড়ে দেয়, তাহলে সামনের আয়নায় উদ্ভাসিত হবে তার ভবিষ্যৎ স্বামীর মুখ।
তবে এই মিথেরই আরেকটি সংস্করণ বলছে, ভবিষ্যৎ স্বামীকে দেখতে ইচ্ছুক নারীকে নাকি আসলে গোটা আপেলটি গলধঃকরণও করতে হবে। এতে একদিক দিয়ে ভালোই হবে। কেউ যদি এই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রীতিটি মেনে চলে এবং তার উদ্দেশ্য পূরণ না হয়, তবু একটা গোটা আপেল তো তার খাওয়া হবে। আর কথায় তো আছেই, "An apple a day keeps the doctor away!"
স্বর্গ থেকে মর্ত্যের সেতুবন্ধন
প্রাচীন অ্যাজটেকদের বানানো আয়নার উপাদান ছিল অবসেডিয়ান, যেটি কাচ-সদৃশ এক ধরনের কৃষ্ণবর্ণের আগ্নেয়শিলা।
অ্যাজটেকদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তারা দেবতা 'তেজকেটলিপোকা'র সাথে সম্পৃক্ত। রাত্রি, সময় ও বংশ পরম্পরায় পাওয়া স্মৃতির দেবতা ছিল এই তেজকাটলিপোকা।
কথিত আছে, আয়নাকে ব্যবহার করেই নাকি এই দেবতা স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকের রুটে আসা-যাওয়া করত!
আয়নার ধরা পড়ে চাঁদের শক্তি
প্রাচীন চীনের একটি জনপ্রিয় বিশ্বাস ছিল, আয়নার নাকি রয়েছে চাঁদের স্বর্গীয় শক্তি ধরে রাখার ক্ষমতা। এমনকি এ-ও কথিত আছে, চীনের এক সম্রাট নাকি জাদুকরি এক আয়না বসিয়ে নিজের সাফল্য ত্বরান্বিতও করেছিলেন!
আজ থেকে ১৯৯৬ বছর আগে, ২৫ খ্রিস্টাব্দে চীনের সম্রাট কিন শি হুয়াং এ দাবিটি করেছিলেন, আয়নার দিকে তাকানো মানুষের মুখে তাকিয়ে তিনি তাদের আসল চিন্তা-ভাবনা ও মনের খবর পড়তে পারছেন!
শোবার ঘরে আয়নার অবস্থান
ফেং শুই কী জানেন তো? চীনের ঐতিহ্যবাহী ছদ্মবৈজ্ঞানিক, ভূ-তাত্ত্বিক প্রথা। এই প্রথায় রয়েছে আয়নার কথাও।
যদি কেউ তার শোবার ঘরকে ফেং শুইয়ের রীতি মেলে সাজাতে চায়, তাহলে বিছানার দিকে মুখ করে কোনো আয়না রাখা যাবে না।
চীনা অনেক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয় যে ঘুমের মধ্যে শরীর ও আত্মার মেরামত প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তাই যদি কোনো ব্যক্তির ঘুমন্ত চেহারা আবার তার দিকে মুখ করেই প্রতিফলিত হয়, তবে শরীর থেকে নির্গত নেতিবাচক শক্তিগুলো থেকে সত্যিকারের মুক্তি পাওয়া যাবে না।