অধিনায়কদের অধিনায়ক: ইমরান খানে বিস্মিত পাইলট
অফিসিয়াল নাম খালেদ মাসুদ। ডাক নাম পাইলট। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও পাইলট ছিলেন তিনি। কয়েক দফায় বাংলাদেশের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন খালেদ মাসুদ। পাশাপাশি ব্যাট হাতে দলকে পথ দেখানো ছাড়াও উইকেটের পেছনটা সামলানোর গুরুদায়িত্বও ছিল তার কাঁধে।
সে সময়ের বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নবীন সদস্য। জেতার অভ্যাস তখনও গড়ে ওঠেনি। দলে যেসব ক্রিকেটার ছিলেন, তাদের নিয়ে ভালো খেলাটা অধিনায়ক খালেদ মাসুদের জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। পরাজয়ের ব্যবধান কম রাখাটাই তখন এক ধরনের সাফল্য ছিল বাংলাদেশের জন্য।
স্টিভ ওয়াহ, সৌরভ গাঙ্গুলিদের দেখে খালেদ মাসুদ ভাবতেন, 'আমিও তাদের মতো অধিনায়ক হবো'। কিন্তু তাদের মতো লড়ার রসদ তো নেই দলে; এটা ভেবে পরক্ষণেই স্বপ্নের ঘুড়িতে লাগাম টানতেন বাংলাদেশকে ৩০ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ৪ ম্যাচে জয় পাওয়া সাবেক এই অধিনায়ক। ১২টি টেস্টে নেতৃত্ব দিলেও জয়ের স্বাদ নেওয়া হয়নি অধিনায়ক খালেদ মাসুদের।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কয়েক পত্তনে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করা খালেদ মাসুদের বেশি মুগ্ধতা পাকিস্তানের বিশ্বজয়ী অধিনায়ক ইমরান খানকে নিয়ে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে নতুন একটি দলকে নিয়ে ইমরান খান যেভাবে বিশ্বজয় করে দেখিয়েছিলেন, সেটা অবাক করে তাকে।
স্টিভ ওয়াহ, সৌরভ গাঙ্গুলির অধিনায়কত্বও মনে ধরতো খালেদ মাসুদের। এদের পর গত ১০-১৫ বছরের পরিসংখ্যানে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নাম্বার ওয়ান অধিনায়ক মনে হয় তার কাছে। বাংলাদেশ থেকে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে সেরার ট্যাগ দেন খালেদ মাসুদ। যদিও দল এবং সময়ের ওপর অধিনায়কত্ব নির্ভর করে বলে সেরা বাছাই করাটা কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজন 'অধিনায়কদের অধিনায়ক' সিরিজের পঞ্চম পর্বে নিজের সেরা অধিনায়ক ও অধিনায়কত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন খালেদ মাসুদ পাইলট।
খালেদ মাসুদ পাইলট: আমরা তো সাফল্য দেখেই অনেক সময় বলে দিই এই অধিনায়ক ভালো। কিন্তু এর সাথে অনেক কিছু জড়িত। এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেই হোক, যার সাথেই যুদ্ধ হোক আমেরিকা জিতে যাবে। কারণ আমেরিকার কাছে যে অস্ত্র আছে, মিয়ানমারের কাছে সেটা নেই। মিয়ানমার পারবেও না এ কারণে। এদের ভালো প্রধানমন্ত্রী থাকলেও পারবে না।
একজন অধিনায়কের দলে কেমন ক্রিকেটার আছে, সেটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন অস্ট্রেলিয়া দলে স্টিভ ওয়াহ যখন খুব সাফল্য পেয়েছেন, তখন কিন্তু তার দলে ওই রকম খেলোয়াড় ছিল। আবার ধোনির ক্ষেত্রে যদি দেখেন, ধোনিরও ওই রকম খেলোয়াড় ছিল। সৌরভ গাঙ্গুলির সময়ও ওই মানের খেলোয়াড় ছিল।
তো অধিনায়কদের মধ্যে তুলনা করা খুব কঠিন, বিচার করাটা কঠিন যে কে এক নম্বর আর কে দুই নম্বর। আমি তাকেই সেরা অধিনায়ক বলি, যে কিনা মৃত একটা দলকে জীবিত করতে পারে। কিন্তু এখানে রেট করা খুব কঠিন। বিশ্বকাপ দিয়ে বিচার করে অনেকে। হিসাব করে ট্রফি জিতেছে কে। অধিনায়ক এভাবেই বিচার করতে দেখেছি বেশিরভাগ সময়ে।
সেরা অধিনায়কের প্রশ্নে আমি ইমরান খানের কথা বলব। এরপর সৌরভ গাঙ্গুলির কথা বলব। গাঙ্গুলি ভালো অধিনায়ক। ধোনির কথা বলব। সে অসাধারণ অধিনায়ক ছিল। শেষ ১০-১৫ বছরের কথা বললে আমি ধোনির নাম নিবো। সে সেরা অধিনায়ক ছিল এই সময়ে।
স্টিভ ওয়াহর জন্য সহজ ছিল। প্রায় ১০ বছর খাঁটি একটা দল ছিল অস্ট্রেলিয়ার। স্টিভ ওয়াহ যে দলটা পেয়েছিল, সেখানে যেমন ছিল ব্যাটিং বিভাগ, তেমনি বোলিং বিভাগ। তার দলের কোনো জায়গায় শূন্যস্থান ছিল না। তবে এই দলকে মানিয়ে নিতেও ক্যালিভারের দরকার। এই হিসেবে বলতে পারেন স্টিভ ওয়াহ অন্যতম সেরা অধিনায়ক।
সেরা দিক থেকে আমি ইমরান খানকে এগিয়ে রাখব। নতুন একটা দলকে নিয়ে সাফল্য পাওয়ার হিসেব করলে ইমরান খানের কথাই বলতে হবে। ইমরান খান যে দল নিয়ে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হন, সেই দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় নতুন ছিল। যেমন ইনজামাম-উল-হক, সে একেবারে নতুন ছিল। আচমকা একজন তরুণ খেলোয়াড় নিয়ে এসেছিলেন ইমরান খান। এটা বিশাল একটা চমক ছিল।
ইমরান খান কৌশলগত দিক থেকে দারুণ ছিলেন। দলের দুর্বল দিক, শক্তিশালী দিক বুঝে গেম্বলিং করতেন। এটা আবার ধোনির মধ্যেও ছিল। ইমরান খান নিজের দলের অবস্থা বুঝে বিশ্বকাপে অনেক গেম্বলিং করেছিলেন। কখন কাকে নামাবেন, এই গেম্বলিংয়ের মাধ্যমে যেটা করেছিলন, সেটা অসাধারণ ছিল।
স্টিভ ওয়াহর যে ব্যাপার দারুণ ছিল, সেটা হচ্ছে সে সব সময় একই রকম থাকতো। খুব স্বাভাবিক থাকতো। ভালো সময়েও যেমন স্বাভাবিক, খারাপ সময়েও তেমন স্বাভাবিক থাকতো। সে খুবই ঠান্ডা মাথার অধিনায়ক ছিল। বোঝা যেত না তার মধ্যে কী চলছে। এই ব্যাপারটা ধোনির মধ্যে ছিল। ধোনি ভালো বা খারাপ সময়ে একই রকম।
সাফল্য পাওয়ার পরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতো। সংযত রাখতো নিজেকে সব সময়। এটা একজন অধিনায়কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংযত থাকা এবং সব প্রতিপক্ষকে সম্মান দেওয়াটা একজন অধিনায়কের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ওইভাবে আমি কাউকে অনুসরণ করিনি যে, এই অধিনায়ক আমার আইডল। আপনি তখনই একজনকে অনুসরণ করবেন, যখন লড়ার জন্য তাদের মতো খেলোয়াড় আপনার কাছে থাকবে। আপনাকে নিজের দলকে নিয়েই লড়তে হবে। আমি বাংলাদেশে থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে অনুসরণ করলে তো হবে না।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি মেনেই বাংলাদেশের মতো করে এগোতে হবে। নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়কে আপনি অনুসরণ করতে পারেন। আমি কেমন হতে চাই বা বিভিন্ন খেলোয়াড়ের ভালো ব্যাপারগুলোকে পিক করা, এসব আমি করেছি। কোনো অধিনায়কের প্রভাব আসলে সেভাবে আমার অধিনায়কত্বে পড়েনি। আমি ওভাবে কাউকেই অনুসরণ করিনি। দেশের প্রেক্ষাপটে যেটা ভালো, সেভাবে চিন্তা করেই অধিনায়কত্ব করার চেষ্টা করেছি।
আমি সব অধিনায়কেরই কৌশলগত জায়গাগুলো দেখার চেষ্টা করেছি। কে, কখন, কীভাকে, কাকে ব্যবহার করছে, কোন বোলারকে টানছে, তারে পরিকল্পনা কী; এসব অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। মাঠের ভিউ অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।
অনেক অধিনায়ককেই ভালো করতে দেখেছি। কিন্তু তার মতো হতে চাইলেই তো আমি পারব না। কারণ তার মতো খেলোয়াড় তো আমার দলে নেই। এই কারণে কারও মতো হওয়ার ইচ্ছাই জাগেনি। তবে তাদের কৌশলগত জায়গাগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম। তারা মাঠে যেসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতো, সেসব নেওয়ার চেষ্টা করতাম।
বাংলাদেশের কথা বললে সাফল্যে অবশ্যই মাশরাফির কথা বলতে হবে। সফলতার দিক থেকে মাশরাফি সবার ওপরে। আবার মেধার দিক থেকেও সে দারুণ। কিন্তু সেরা বিচার করা খুব কঠিন। কারণ সময়ের সঙ্গে ফলাফলের একটা যোগসূত্র থাকে।
যেমন দুর্জয় খুবই আনলাকি। দুর্জয় ২০০০ সালে যখন অধিনায়কত্ব করে, তখন আমরা নতুন একটা দল। তার সাফল্যের গড় শূন্য, সে কোনো ম্যাচ জেতেনি। কিন্তু সে ভালো অধিনায়ক ছিল। তার সময়ে আমাদের দল শক্তিশালী ছিল না বলে সে ভালো অধিনায়কের ট্যাগ পায়নি। তো এভাবে বিচার করা আসলে কঠিন।
ওই সময় তো ভিন্ন অবস্থা। তখন ব্যাপার ছিল এমন যে, আমার কীভাবে প্রতিপক্ষের রানের কাছাকাছি যেতে পারব। অথবা কীভাবে ম্যাচ ড্র করব। কিন্তু এখন যেমন ম্যাচ জেতার চিন্তা-ভাবনা থাকে, প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন। তো একেক অধিনায়কের একেক রকম গুণ ছিল, কিন্তু এটা সময়ের ওপর নির্ভর করে। দলে সৈন্য বা খেলোয়াড় কেমন, এটার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।
বাংলাদেশে তুলনা করা খুব কঠিন। তবে ভারত দলে এই তুলনা করা খুব সহজ, অস্ট্রেলিয়া দলে সহজ, ইংল্যান্ড দলে সহজ। তাদের ইতিহাস অনেক বড়। একই ধরনের দল নিয়ে তারা লম্বা সময় ধরে খেলেছে। তাদের র্যাঙ্কিং প্রায় সময়ই একই জায়গায় আছে। এদের বেলায় তুলনা করা সহজ যে কোন অধিনায়ক কেমন।
যেমন ভারত দলে যদি ধরেন সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, আজহার উদ্দিন, শচিন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি বা ধোনি; এখানে তুলনা করা সহজ। কিন্তু বাংলাদেশে তুলনা করা খুব কঠিন। কারণ বাংলাদেশের প্রথম ৪-৫ বছর তো শুধু খারাপ সময়ই গেছে।