এক নজরে ম্যারাডোনার ফুটবল ক্যারিয়ার
ফুটবল মানে ম্যারাডোনা কিংবা ম্যারাডোনাই ফুটবল। ফুটবল আর ম্যারাডোনা বহুকাল থেকেই সমার্থক। অনেকের কাছে তিনি সর্বকালের সেরা ফুটবলার। আর্জেন্টাইনদের কাছে ফুটবল ঈশ্বর কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। ফুটবলের এই জাদুকরের মারা যাওয়ার খবরে হতবিহব্বল গোটা দুনিয়া। শোকের ছায়া নেমে এসেছে ফুটবল ভক্তদের মাঝে।
বা পায়ের জাদুতে শত শত কোটি মানুষের মনে গেথে যাওয়া আর্জেন্টাইন এই ফুটবল জাদুকর এখন প্রয়াত। আর্তনাদ-আহাজারি চলছে সবখানে, কিন্তু তা পৌঁছাচ্ছে না ফুটবলের চেয়েও কখনও কখনও বড় হয়ে ওঠা ম্যারাডোনার কানে। কীভাবে খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন, কেমন ছিল কিংবদন্তি এই ফুটবলের ক্যারিয়ার; এক নজরে তা দেখে নেওয়া যাক।
ফুটবলের কালো মানিক ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলের মতো ম্যারাডোনার জন্মও গরিব পরিবারে। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েনস এইরেস প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো প্রভিতা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার ছোটবেলা কাটে ভিয়া ফিওরিতোতে। তিন কন্যা সন্তানের পর চতুর্থ সন্তান হিসেবে ম্যারাডোনা জন্মগ্রহণ করেন।
ম্যারাডোনা নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত থাকলেও তার পুরো নাম দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। ডাকনাম গোল্ডেন বয়। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল তার। ১৯৭১ সালে ম্যারাডোনার বয়স ১১ বছর, খেলতেন এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে। এ সময় এক স্কাউটের নজড়ে পড়েন ছোট্ট ম্যারাডোনা। এই স্কাউটের এর সহায়তায় দ্য লিটল অনিঅন (ক্লাবটির আরেক নাম আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স) ক্লাবে সুযোগ হয় তার।
শুরুটা অবশ্য খেলোয়াড় হিসেবে হয়নি ম্যারাডোনার, বল বয় হিসেবে কাজ করা শুরু করেন ম্যারাডোনা। পরের বছর সময় আসে তার। ছোট্ট ম্যারাডোনা তার বা পায়ের জাদুতে সবাইকে চমকে দেন। আর্জেন্টিনার প্রথম বিভাগের খেলার অর্ধ-বিরতির সময় বল নিয়ে জাদুকরী সব পায়ের কাজ দেখিয়ে সবার নজড়ে চলে আসেন। এরপরও তাকে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয় পেশাদার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করতে।
১৯৭৬ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে সময় থেকে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে নামিদামি এই ফুটবলারের। ১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক হয় ম্যারাডোনার। এই ক্লাবের হয়েই নিজের জাত চেনান তিনি। তার ফুটবল প্রতিভার খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো আর্জেন্টিনায়।
পরের বছর ডাক পড়ে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে। তার বয়স যখন ১৭ (১৯৭৭), আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলে সুযোগ দেওয়া হয় ম্যারাডোনাকে। একই বছর জাতীয় দলেও অভিষেক হয় ম্যারাডোনার। এরপর তার জাদুকরী পায়ের খেল শুরু, আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে চাপিয়ে লিখে গেছেন উপাখ্যান।
ম্যারাডোনার ক্লাব ক্যারিয়ার:
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স (১৯৭৬-১৯৮১): ১৬ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার ক্লাবের হয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ম্যারাডোনা। চার বছর ক্লাবটির হয়ে খেলেন তিনি। এ সময়ে বা পায়ের জাদু আর সম্মোহনী শরীরের দোলায় প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের বোকা বানিয়ে গোলের বন্যা বইয়ে দেন তিনি। আর্জেন্টিনোসের হয়ে ১৬৭ ম্যাচে ১১৬ গোল করেন তিনি।
বোকা জুনিয়র্স (১৯৮১-১৯৮২): পাঁচ বছরে নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রতিভার ফুটবলার হিসেবে প্রমাণিত করা ম্যারাডোনাকে ১৯৮১ সালে দলে ভেড়ায় আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্লাব বোকা জুনিয়র্স। যদিও ক্লাবটির হয়ে বেশিদিন খেলা হয়নি তার। বোকা জুনিয়র্সে এক বছরে ৪০ ম্যাচ খেলে ২৮টি গোল করেন ফুটবলের এই মহারাজা।
বার্সেলোনা (১৯৮২-১৯৮৪): বোকা জুনিয়র্সের ম্যারাডোনাকে মনে ধরে লা লিগার দল বার্সেলোনার। ১৯৮২ সালে তাকে দলে ভেড়ায় কাতালানরা। যদিও এই অধ্যায়টি তার বর্ণিল হয়নি। দুই বছরে বার্সার হয়ে ৩৬ ম্যাচে ২২টি গোল করেন ম্যারাডোনা।
নাপোলি (১৯৮৪-১৯৯১): ইতালিয়ান এই ক্লাবটির হয়ে সবচেয়ে মধুর সময় কাটিয়েছেন ম্যারাডোনা। ক্লাবটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার আর্জেন্টাইন এই ফুটবল ঈশ্বর। ৭ বছরে নাপোলির হয়ে ১৮৮টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি, গোল করেছেন ৮১টি। যা ক্লাবটির ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ।
সেভিয়া (১৯৯২-১৯৯৩): লা লিগার দল বার্সেলোনা থেকে নাপোলি যাওয়া ম্যারাডোনা ১৯৯২ সালে আবারও লা লিগায় ফেরেন। এবার তার ঠিকানা হয় সেভিয়ায়। লা লিগায় এবারের পথটাও দীর্ঘ হয়নি তার। এক বছরে সেভিয়ার হয়ে ২৬টি ম্যাচ খেলে ৫ গোল করেন তিনি।
নিওয়েল'স ওল্ড বয়েজ (১৯৯৩-১৯৯৪): সেভিয়াতেই থাকতেই ক্যারিয়ার পড়তে শুরু করেন ম্যারাডোনার। অন্যদিকে না ভেবে তাই ১৯৯৩ সালে দেশের ফুটবলে ফেরেন কিংবদন্তি এই ফুটবলার, খেলতে শুরু করেন নিওয়েল'স ওল্ড বয়েজের হয়ে। এখানে নিয়মিত খেলা হয়নি তার। মাত্র ৫টি ম্যাচে খেলে গোলশূন্য থাকেন মেসি-আগুয়েরোদের এই অগ্রজ।
বোকা জুনিয়র্স (১৯৯৫-১৯৯৭): ১৯৯৪ বিশ্বকাপে মাদক পরীক্ষায় পজিটিভ হয়ে ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেন ম্যারাডোনা। কোনো ক্লাবই তার প্রতি আর আগ্রহ দেখায়নি তখন। এমন সময়ে হাত বাড়ায় তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে দল বোকা জুনিয়র্স। এই ক্লাবটির হয়ে আরও দুই বছর খেলেন ম্যারাডোনা। ৩০ ম্যাচ খেলে করেন ৭ গোল। ১৯৯৭ সালে বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ম্যারাডোনার জাতীয় দলের ক্যারিয়ার:
ফুটবল ইতিহাসেই যিনি অমরত্ব লাভ করেছেন, তিনি যে আর্জেন্টিনার ফুটবলের সর্বকালের সেরা; সেটা বলাই বাহুল্য। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব জয়ের মুকুট এনে দেন ম্যারাডোনা। ওই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ছিলেন জাদুকরের ভূমিকায়। কোনো বাধাই তার সামনে শেষপর্যন্ত টেকেনি। ভুবন ভোলানো ফুটবল খেলে দলকে ফাইনালে তোলেন এই ফুটবল জাদুকর। জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে হাত দিয়ে গোল করে দলের শিরোপা নিশ্চিত করেন তিনি। যে গোলটি 'হ্যান্ড অব গড' নামে পরিচিত।
১৯৯০ বিশ্বকাপেও অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ম্যারাডোনা। এবারও দলকে ফাইনালে তোলেন তিনি। কিন্তু এবার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষেই হেরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জয় থেকে বঞ্চিত হন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনা দলের অন্যতম ভরসা ছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে নিষিদ্ধ হন তিনি।
আর্জেন্টিনার জার্সিতে ৯১টি ম্যাচ খেলেছেন ম্যারাডোনা, গোল করেছেন ৩৪টি। জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বমাত করার আগে আর্জেন্টিনা যুব দলের হয়ে ১৯৭৯ সালে শিরোপা জেতেন ম্যারাডোনা।