ক্যারিবীয় শাসন ও বাংলাদেশের অনিঃশেষ শিক্ষা সফর
মেহেদী হাসান মিরাজের ক্যাচটি তালুবন্দি করে একটু বসে থাকলেন রাকিম কর্নওয়াল। বোলার জোমেল ওয়ারিক্যান তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ছেন। যদিও হাত উপরে তুলতে গিয়ে কষ্টই হচ্ছিল উইন্ডিজের এই স্পিনারের। পেছন থেকে সতীর্থরা তখন তাকে জাপ্টে ধরে রেখেছেন। রোমাঞ্চকর জয়ের উদযাপনে সঙ্গী হতে এগোলেন কর্নওয়ালও। দু পা ফেলতেই তার কাঁধে চড়ে পড়লেন বদলি ফিল্ডার কেভেম হজ।
দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে ছোট কোনো 'পাহাড়' জয় করে ফেলেছেন হজ। আকৃতির দিক থেকে কর্নওয়ালের কাছে হজ নিতান্তই স্বল্পদেহী। এই দৃশ্য যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জন্য প্রতিকীই। নিয়মিত ১৩ ক্রিকেটার ছাড়া দল গঠনেই যাদের পাগল হওয়ার যোগাড়, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য গল্প লিখে দেখালো।
যাদের বিপক্ষে শেষবার (২০১৮ সালে) পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজও হোয়াইটওয়াশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল, সেই দলটিকেই হোয়াইওয়াশের স্বাদ ফেরত দেওয়া পাহাড় জয়ের চেয়ে কম কীসে! বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয় তাই মেয়ার্স-বনারদের কাছে রূপকথার মতোই। যে রূপকথার অংশ ওয়েস্ট ইন্ডিজও। এই রূপকথায় হয়তো ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, গ্যারি সোবার্সদের মতো গড়া কীর্তি নেই, তবে আছে অতি সাধারণ দলকে অসাধারণ করে তোলার রঙিন গল্প।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই সফরটিকে শিক্ষা সফরই বলা যায়। নিয়মিত দলের ১৩ জন ক্রিকেটারকে ছাড়াই বাংলাদেশে এসেছিল দলটি। অভিজ্ঞ বলতে কেবল ক্রেইগ ব্রাথওয়েট, জার্মেইন ব্ল্যাকউড, শ্যানন গ্যাব্রিয়েল, কেমার রোচরা ছিলেন।
এ ছাড়া বেশিরভাগ ক্রিকেটারই নতুন। অনেকেরই বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টেস্টে দিয়ে অভিষেক হয়েছে। এমন দল গঠন করায় প্রতিপক্ষ শিবিরের মশকরাও হজম করতে হয়েছে তাদের। বিসিবি প্রধান, নির্বাচক থেকে শুরু করে ক্রিকেটারদের পর্যন্ত হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বলা হচ্ছিল 'দ্বিতীয় সারির' দল।
এই হতাশা ওয়ানডে সিরিজ পর্যন্ত হয়তো ঠিক ছিল। তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেভাবে লড়াই-ই করতে পারেনি ক্যারিবীয়রা। জেসন মোহাম্মদের দল সিরিজ হারে ৩-০ ব্যবধানে। অনেকে ধরে নিয়েছিল, টেস্টেও দেখা যাবে একই দৃশ্য। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেট যে একেবারেই আলাদা, সেটা বুঝিয়ে দিতে সময় নেয়নি ক্যারিবীয়রা। প্রথম টেস্টে ঐতিহাসিক জয়, এরপর দ্বিতীয় টেস্টেও ব্রাথওয়েট, বনার, কর্নওয়ালদের দাপট। তাতে ঘরের মাঠেই হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ।
অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা যে এক নয়, চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণ দলটি। চারজন ছাড়া বেশিরভাগ ক্রিকেটারই যে দলে নতুন, সেই দলটিই টেস্ট ক্রিকেটের আসল সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। অভিষেক টেস্টেই ডাবল সেঞ্চুরি করে ইতিহাস গড়েছেন কাইল মেয়ার্স। আরেক অভিষিক্ত এনক্রুমা বনার দুই টেস্টের চার ইনিংসেই রেখেছেন দায়িত্বশীলতার ছাপ। মাত্র পঞ্চম টেস্ট খেলতে নামা রাকিম কর্নওয়াল বা দশম টেস্ট খেলতে নামা জোমেল ওয়ারিক্যানরাও গেঁথেছেন সাফল্যের মালা।
'দ্বিতীয় সারির' দলটি শিক্ষা সফরে লেটার মার্ক তুলে উতড়ে গেছে। আর বাংলাদেশ? বাংলাদেশের জন্য টেস্ট ক্রিকেট মানেই যেন শিক্ষা সফর। সাদা পোশাকের ফরম্যাটে পথচলার ২১ বছর হয়ে গেলেও শিক্ষানবিশই রয়ে গেছে দলটি। শুরুর মতো করে এখনও বলা হয়, 'এই টেস্টের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের টেস্টে কাজে লাগাব।'
ঢাকা টেস্টে হারের পর বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক যেমন বলেছেন, 'উন্নতির শেষ নেই, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুযোগ থাকে।' টেস্ট অধিনায়কের এই কথাতেই সব যেন বিশ্বাস বাংলাদেশের। আর তেমন হলে 'মাত্র' ২১ বছর চলে যাওয়াতেও অবশ্য আক্ষেপ হওয়ার কথা নয়! অর্থাৎ, সহসাই বাংলাদেশের শিক্ষা সফর শেষ হওয়ার নয়।
অনিঃশেষ এই শিক্ষা সফরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণ। ঘরের মাঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সব সময়ই স্পিনের ওপর ভরসা রাখে বাংলাদেশ। ফরম্যাটটা টেস্ট হলে 'অল স্পিন অ্যাটাক' নিয়ে মাঠে নামতেও কার্পণ্য দেখানো হয় না। স্কোয়াডে পেসারদের রেখে দেওয়া হয় 'শো পিস' হিসেবে। এবারই যেমন ৫ জন পেসারকে স্কোয়াডে রেখেও দুই টেস্টে খেলানো হয়েছে মাত্র দুজন পেসারকে।
এই স্পিন স্পিন করে যে অনেক পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে কিংবা স্পিনেরই শিকার হওয়া লাগতে পারে, সেই শিক্ষাটা এবার ভালোভাবেই হয়েছে বাংলাদেশের। উইন্ডিজের দুই স্পিনার রাকিম কর্নওয়াল ও জোমেল ওয়ারিক্যানই রীতিমতো ধাঁধার গোলকে ফেলে রেখেছিল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। ঢাকা টেস্টে ভেল্কি দেখিয়েছেন ক্রেইগ ব্রাথওয়েটও। সাহায্য করতে ছিলেন এনক্রুমা বনারও।
দুই টেস্টে বাংলাদেশের যাওয়া ৩৮ উইকেটের মধ্যে ২৭টিই নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনাররা। কর্নওয়াল একাই নিয়েছেন ১৪টি উইকেট। ওয়ারিক্যানের শিকার ১০ উইকেট। নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই আটকে গেছে বাংলাদেশ। অবশ্য এই অভিজ্ঞতাও প্রথম নয়। ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে স্পিন ফাঁদ বানিয়ে বাজেভাবে ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, স্পিন দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ফেরালেই যেন কাজ শেষ! স্পিনেই যে নিজেদের ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস অবস্থা হতে পারে, সেই হোমওয়ার্ক না করেই বারবার মাঠে নেমে পড়ছে বাংলাদেশ। তাতে ফল যেমন বিপক্ষে যাচ্ছে, পেসারদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে।
দলের সঙ্গে রেখে, পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে পেসারদের যে স্বপ্ন দেখানো হয়, সেটা বাস্তবায়ন না করার নিয়মিত কৌশলে সাবেক থেকে শুরু করে বর্তমান অনেক ক্রিকেটারেরই আপত্তি। প্রথম টেস্টে একাদশে এক পেসার দেখে বিকেএসপির ক্রিকেট পরামর্শক নাজমুল আবেদীন ফাহিম জানিয়েছিলেন দীর্ঘমেয়াদী শঙ্কার কথা।
বিসিবির সাবেক এই কোচ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের খেলোয়াড় টেস্ট খেলে খুব বেশি আয় করতে পারে না। টেস্ট ক্রিকেটে বোলিংটা অনেক কষ্টকর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির থেকে। পরিশ্রম করার পর যখন সুযোগ পাবে না, তারা হতাশ হবে, নিরাশ হবে। এটার জন্য তারা টেস্ট ছেড়ে অন্য ফরম্যাটে মনোযোগী হবে। এটার জন্য ভবিষ্যতে আমাদের টেস্ট উপযোগী বোলার আস্তে আস্তে কমতে থাকবে।'
২০০০ সালে টেস্ট যাত্রা শুরু বাংলাদেশের। এরপর ১২১ টি টেস্ট খেলা হয়ে গেছে দলটির। দীর্ঘ এই সময়ে জয় এসেছে মাত্র ১৪টি ম্যাচে। হার ৯১টি ম্যাচে, ড্র ১৬টি। ড্র করা বেশিরভাগ ম্যাচে অবশ্য বৈরী আবহাওয়ার অবদানই বেশি। ১৪টি জয়ের মধ্যে আছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার গল্প। আবার আছে আফগান্তিানের মতো নবীন দলের বিপক্ষে হারের স্মৃতিও। সব মিলিয়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাতের এই ফরম্যাটে বাংলাদেশ এখনও শিক্ষা সফরে, যে শিক্ষা সফর শেষই হচ্ছে না!