ছোট দেশের বড় স্বপ্ন: নামিবিয়ান ক্রিকেটের বিস্ময়কর উত্থান
'এটা আমাদের গত তিন বছরের পরিশ্রমের ফল'- বলছিলেন ক্রিকেট নামিবিয়ার প্রেসিডেন্ট রুডি ফন বুরেন। ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট শিকার করা ফন বুরেন ১৮ বছর পর নামিবিয়াকে দেখলেন ইতিহাস গড়তে। ২০০৩ সালের পর এই প্রথম যেকোনো ফরম্যাটের বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশটি।
চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে নামিবিয়ার স্থান ছিল সবার নিচে। 'এ' গ্রুপে তাদের জায়গা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে। কাগজে-কলমে নামিবিয়াই যে ছিলো গ্রুপটার সবচাইতে দুর্বল দল, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ নামিবিয়া যে সুপার টুয়েলভে জায়গা করে নেবে, আসরের শুরুতে এর পক্ষে বাজি ধরার লোকও খুব বেশি ছিল না।
নামিবিয়া শুধু প্রথম রাউন্ডের গণ্ডিই পেরোয়নি, বরং প্রথম ম্যাচেই হারিয়ে দিয়েছে অভিজ্ঞ স্কটল্যান্ডকে। এত বছর পরও যেখানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ের মতো দল, সেখানে নামিবিয়া নিজেদের প্রথম ম্যাচেই করেছে বাজিমাত।
এতসব যে রাতারাতি হয়ে যায়নি, তা ভালো করেই জানেন রুডি ফন বুরেন। তিনি জানেন, গত দু-তিন বছরের পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ই নামিবিয়াকে এনে দিয়েছে অভাবনীয় সাফল্য।
অথচ নামিবিয়াতে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ফুটবল কিংবা রাগবির ধারে কাছেও নেই ক্রিকেট। রাজধানী উইন্ডহকে সীমিত পরিসরে খেলা হয় ক্রিকেট। পাঁচটা ক্লাব সেখানে লড়ে চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য। ক্রিকেট খেলার মতো মাঠ আছে সেখানে সর্বসাকুল্যে নয়টি। দুই বছর আগে যে নামিবিয়ার চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার ছিল তিনজন, এই তথ্যটা তাই চমক জাগায় না।
বদলটা এলো ২০১৯ সালে, যখন নামিবিয়া লাভ করে ওয়ানডে স্ট্যাটাস। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা তিন থেকে উন্নীত হয় ১৬ তে। সে বছরই সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের শেষ চারে উঠে বিশ্বকাপের টিকিটটাও নিশ্চিত করে তারা। নামিবিয়ার অধিনায়ক গেরহার্ড এরাসমাস নির্বাচিত হন সেরা খেলোয়াড়, অলরাউন্ডার জেজে স্মিটের উইলো থেকে আসে আসরের সবচেয়ে বেশি ছক্কা।
অভিষেকের পর থেকে সব জায়গায় অসাধারণ পারফর্ম করেছে নামিবিয়া৷ তবে ঘাটতি ছিলো একটা জায়গায়। বড় প্রতিপক্ষ বা বড় আসরে খেলার অভিজ্ঞতা যে একদমই ছিলো না পিয়েরে ডি ব্রুইনের শিষ্যদের।
নামিবিয়া শিবিরে আড়াইশোর বেশি টি-টোয়েন্টি খেলা ডেভিড ভিসার সংযোজন তাদের শক্তিমত্তাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভিসা আছেন অসাধারণ ফর্মে; নামিবিয়ার সুপার টুয়েলভে ওঠার পেছনে অসামান্য ভূমিকা রাখছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়েও খেলা এই অলরাউন্ডার।
বিশ্বকাপের আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে টি-টোয়েন্টি সামার ব্যাশে সবকটি ম্যাচ জেতে নামিবিয়া। প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে এসেই মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কার। শীর্ষ দশ টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে এর আগে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবার অভিজ্ঞতা ছিলো না নামিবিয়ার। ফলাফল- যা হবার তাই।
তবে প্রথম ম্যাচে হারের পরও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেনি এরাসমাস-স্মিট-ভিসাদের। দ্বিতীয় ম্যাচে ভিসার অসাধারণ হাফ সেঞ্চুরিতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১৬৫ রান তাড়া করে জিতে যায় নামিবিয়া। প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচে যখন আয়ারল্যান্ডকে হারায় নামিবিয়া, উইনিং রানটাও আসে ভিসার ব্যাট থেকে। সে ম্যাচে অধিনায়ক এরাসমাস অর্ধশতক হাঁকিয়ে রাখেন নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ। এই প্রথম কোনো টেস্ট খেলুড়ে দলকে হারানোর গৌরব অর্জন করে নামিবিয়া। সেই সাথে জায়গা করে নেয় বিশ্বকাপের মূলপর্বে। নিঃসন্দেহে নামিবিয়ার ক্রিকেটের ইতিহাসে এতবড় দিন আর আগে কখনও আসেনি।
তবে নামিবিয়ার রূপকথার ঝুলি যে তখনো ফুরোয়নি। সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচেই তাদের কাছে ধরাশায়ী হয় স্কটল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বাঁহাতি পেসার রুবেন ট্রাম্পেলম্যানের করা প্রথম ওভারটাই মেরুদণ্ড ভেঙে দেয় স্কটিশ ব্যাটিং লাইন আপের।
বিশ্বকাপে নামিবিয়ার আর বাকি চার ম্যাচ। মোকাবিলা করতে হবে ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও আফগানিস্তানকে। হয়তো কোনো একটা ম্যাচে অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে নামিবিয়া, হয়তো পারবে না। ধরা যাক, বাকি সব ম্যাচ বাজেভাবে হারলো নামিবিয়া৷ তাতে কী তাদের সফলতার গল্প এতটুকু রং হারাবে? যে দলটা একটা স্থায়ী ফিজিওথেরাপিস্ট, কন্ডিশনিং কোচ আর ম্যানেজার ছাড়া বিশ্বমঞ্চে খেলতে এলো, তাদের জন্য এতদূর আসাই বা কম কীসে!
গত কদিনে এই একঝাঁক তরুণ ক্রিকেটার ২৫ লাখ ৪১ হাজার জনসংখ্যার দেশটিকে উপহার দিয়েছে চিরদিন মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি। দেশটা ছোট হতে পারে, তবে তাদের স্বপ্নটা আকাশ সমান। আর শচীন টেন্ডুলকার তো বলেছেনই, 'কখনও স্বপ্নকে তাড়া করা থামিও না, কারণ স্বপ্ন সত্যি হয়।'