মোহাম্মদ সালিম: খালি পায়ের কিংবদন্তি, যিনি সেল্টিক মাতিয়েছিলেন
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত থেকে হাতেগোণা কিছু খেলোয়াড়ই ইউরোপীয় পেশাদার লীগগুলোতে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ইতিহাস ঘেঁটে মাত্র ৩১ জন ভারতীয়কে পাওয়া যায়, যারা ভারত ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন কেবল ফুটবল খেলতে, তাও সেটি একেবারে প্রথম সারির দলগুলোতে নয়, বরং নিচের ডিভিশনে।
১৯৯৯ সালে বাইছুং ভুটিয়া প্রথম ভারতীয় হিসেবে কোনো ইউরোপীয় পেশাদার ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন, খেলা শুরু করেছিলেন ইংলিশ সেকেন্ড ডিভিশনের দল বুরির হয়ে। কিন্তু 'ভারতীয় ফুটবলের ঈশ্বরের আশীর্বাদ' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ভুটিয়া মাত্র ৪৬টি ম্যাচ খেলেই ফেরত এসেছিলেন দেশে। ভুটিয়া প্রথম চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হলেও প্রথম ভারতীয় নন যিনি ইউরোপের লীগে খেলেছেন। আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সম্মান কিংবদন্তি মোহাম্মদ সালিমের, যিনি ভুটিয়ারও ৬৩ বছর আগে ইউরোপের অন্যতম বড় ক্লাব সেল্টিকের হয়ে দু'বার মাঠে নেমেছিলেন। কোনো ধরনের বুট ছাড়াই ফুটবল খেলার জন্য সালিম ইতিহাস গড়েছিলেন, এর বদলে তিনি কেবল পায়ে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে খেলতেন।
খালি পায়ের বার্তা
১৯০৪ সালে কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন সালিম। ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ফার্মাসিস্ট হিসেবে, তবে তার মনে পড়ে ছিল তার আসল ভালোবাসা ফুটবলের দিকেই। ২২ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন চিত্তরঞ্জন ফুটবল ক্লাবে, তার আগে খেলে ফেলেছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, স্পোর্টিং ইউনিয়ন এবং ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের হয়ে। তবে ১৯৩৪ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ফেরার মাধ্যমেই তার ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সে বছরই মোহামেডানের টানা ৫ বার কলকাতা ফুটবল লীগ জয়ের সূচনা হয়েছিল, যার কাণ্ডারি ছিলেন মোহাম্মদ সালিম। এর আগে লীগে আধিপত্য ছিল ইংরেজদের, বিশেষ করে ডারহ্যাম লাইট ইনফ্যান্ট্রি কিংবা নর্থ স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ইংরেজ সেনাদের নিয়ে গঠিত দলগুলোর। ১৯৩৪ সালে মোহামেডানের লীগ জয় ছিল প্রথম সর্বভারতীয় কোনো দলের লীগ জয়। ভারতজুড়ে চলা ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল এই জয়। বরিয়া মজুমদার ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ দ্য হিস্টরি অফ স্পোর্টে উল্লেখ করেছেন, "বেশিরভাগ ভারতীয়রাই তখন খালি পায়ে খেলতো, বিপরীতে ইংরেজরা মাঠে নামতো বুট পায়ে। তারপরেও ভারতীয়দের কাছে ইংরেজদের এই পরাজয় প্রমাণ করে ইংরেজদের তুলনায় ভারতীয়রা কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে নেই।"
দল পরিবর্তন
১৯৩৬ সালে মোহামেডানকে নিয়ে তৃতীয়বারের মতো লীগ শিরোপা জেতার পর সালিম বার্লিনের অলিম্পিক গেমসে সর্বভারতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ পেলেন। প্রথম ম্যাচেই চীনা প্রতিপক্ষরা সেলিমের খেলার বেশ প্রশংসা করলেন। তবে সেই ম্যাচের পরেই হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলেন তিনি। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে, ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলো তার খোঁজ পাওয়ার জন্য। কিন্তু সালিম তখন পাড়ি জমিয়েছেন স্কটল্যান্ডে, তাদের চ্যাম্পিয়ন দল সেল্টিকে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য।
সেলিমের ভাই হাশিম ছিলেন রাজধানী গ্লাসগোর এক দোকানদার। ছুটির মধ্যে তিনি কলকাতায় গেলে এবং চীনাদের বিরুদ্ধে নিজের ভাইয়ের পারফরম্যান্স দেখে তিনি তার ভাইকে সেল্টিকে খেলার প্রস্তাব দেন, এক ব্রিটিশ স্টিমজাহাজে করে ভাইকে নিয়ে স্কটল্যান্ডের ফিরতি পথ ধরলেন।
হাশিম সেল্টিকের কিংবদন্তি ম্যানেজার উইলি ম্যালের সাথে কথা বলেন, যিনি ১৮৯৭ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ৪৩ বছর সেল্টিকের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সাথে জিতেছেন ৩০টি বড় শিরোপা। হাশিম ম্যালেকে জানালেন, "ভারত থেকে একজন খুবই ভালো খেলোয়াড় এসেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, সে খালি পেয়ে খেলে। আপনি কি তাকে একবার ট্রায়ালের সুযোগ দেবেন?" সেলিমের কথা শুনে আগ্রহী ম্যালে তাকে ট্রায়ালের সুযোগ দিলেন।
স্কটিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে সালিমকে খালি পায়ে খেলার অনুমোদন দেওয়া হলো। খেলা শুরুর আগে সেলিমের পা ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন সেল্টিকের সহকারী কোচ জিমি ম্যাকমেনেমি। ঠিক ঐ মুহূর্তের ছবিটি তুলে রেখেছিলেন এক ফটোগ্রাফার, যা বেশ পরিচিতি পেয়েছিল।
আগ্রহের চেয়েও বেশি কিছু
১৯৩৬ সালের ২৮ আগস্ট সেল্টিক পার্কের ৭ হাজার দর্শকের সামনে অ্যালায়েন্স লীগের এক ম্যাচে গালস্টোনের বিপক্ষে মাঠে নামেন সালিম। বুটছাড়া একমাত্র খেলোয়াড় সত্ত্বেও রাইট-উইং একাই নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তিনি, ৭-১ গোলে জয়ের ম্যাচে সালিমের অবদান ছিল ৩টি অ্যাসিস্ট।
সেল্টিক খেলোয়াড় অ্যালেক বেনেট সালিম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, "গ্যালারিজুড়ে থাকা দর্শকদের সেদিনের মূল আকর্ষণ ছিলেন সালিম। কেবল সেল্টিকের জার্সি গায়ে একজন অশ্বেতাঙ্গ হিসেবেই নয়, বরং খালি পায়ে খেলার শিল্প দেখতেও তারা মাঠে ভিড় করেছিলেন। কারণ এর আগে কখনোই তাদের সামনে কেউ খালি পায়ে ফুটবল নিয়ে কারিকুরি দেখায়নি।"
"সেল্টিকের দর্শকদের চিৎকার আর উৎসাহ ছাপ ফেলেছিল সালিমের ওপরেও। খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সালিম হয়ে উঠলেন দর্শকদের প্রিয় খেলোয়াড়। সালিমের চতুরতায় তারা ভালোভাবেই আমোদিত হচ্ছিল। একেবারে মাঠের প্রান্ত ঘেঁষে এগিয়ে যেতেন সেলিম, পাসও ছিল প্রায় নিখুঁত, যেভাবে চাইছিলেন ঠিক সেভাবেই পাসগুলো দিচ্ছিলেন, খালি পায়ে আলাদা পার্থক্য দেখা যায়নি। আর ক্রসগুলো সম্পর্কে কী-ই বা বলা যায়: অসাধারণ!"
ডেইলি এক্সপ্রেসের শিরোনাম লেখা হলো: "ভারতীয় জাগলার, নতুন স্টাইল," ভেতরে সালিমের উচ্চকিত প্রশংসা। "সালিমের ঝকমকে দশটি আঙুল, ভারত থেকে আসা সেল্টিকের খেলোয়াড়, গতকাল পুরো গ্যালারিভর্তি দর্শককে সম্মোহন করেছিলেন। নিজের বড় আঙুলের মাধ্যমে বলের ভারসাম্য আনেন, তারপর সেটি ছোট আঙুলগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে সামনে এগিয়ে যান, এক পায়ে দিয়ে ভর দিয়ে ডিফেন্ডারকে এড়িয়ে মাঝমাঠে বল পাঠিয়ে দেন, যার পরবর্তী গন্তব্য গোলপোস্টের নেট।" পরবর্তী ম্যাচের আগে ইভনিং টাইমস সেল্টিকের জার্সি পরা সালিমের ছবি ছাপিয়ে মন্তব্য করে "মাঠে সরাসরি খেলতে দেখার মতো যোগ্য একজন খেলোয়াড়।"
সেল্টিকের হয়ে নিজের অভিষেকের দুই সপ্তাহ পর সেল্টিকের রিজার্ভ দলের হয়ে আবারো মাঠে নামেন সালিম, প্রতিপক্ষ হ্যামিল্টন অ্যাকাডেমিক্যালস। ৫-১ গোলের জয় নিয়ে ফেরা সেল্টিক দলের হয়ে ম্যাচে নিজের একমাত্র গোলটি পেনাল্টি থেকে করেন তিনি। দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদনে লেখা হলো, "খালি পায়ের ভারতীয় গোলকিপারের বামদিকে শট করেন, যিনি বল স্পর্শ করলেও নেটের ছোঁয়া থেকে বলটিকে বাঁচাতে পারেননি।" সালিমের গোলে দর্শক সারি থেকে ভেসে আসা চিৎকারে উদ্বেলিত মনকে অবশ্য সালিম বাইরে থেকে বুঝতে দেননি। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, "মাঠের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সালিমই। দর্শক গ্যালারি থেকে বারবার সমস্বরে চিৎকার ভেসে আসছিলো, "সালিমের কাছে বল দাও।""
রিজার্ভ ম্যাচগুলোতে মাঠে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় দেখে সেল্টিক বোর্ড প্রতি ম্যাচের ৫ শতাংশ লাভ সালিমকে দেওয়ার প্রস্তাব জানালো। তবে ম্যানেজার ম্যালের কাছে তিনি অভিনব কিছুর চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন, যে কারণে পরবর্তী মৌসুমের জন্য তাকে সেল্টিকের হয়ে চুক্তিবদ্ধ করালেন। তবে সালিম দুই ম্যাচ খেলার পরেই দেশে ফেরার আকুতি জানালেন এবং কলকাতায় ফিরে গেলেন। আবারো নাম লেখালেন মোহামেডানের হয়ে, যেখানে ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে আরও দু'বার লীগ শিরোপা জেতেন।
যা-ই হোক, স্কটল্যান্ডের মাটিতে প্রথম ভারতীয় হিসেবে খেলার স্মৃতি তিনি কখনোই ভোলেননি। এজন্য ১৯৪৯ সালে ইভনিং টাইমসে চিঠি লিখে তিনি ম্যালের লেখা 'দ্য স্টোরি অফ সেল্টিক'-এর এককপি বই আনান, যেখানে তার ব্যাপারেও উল্লেখ করেছিলেন ম্যালে।
১৯৮৯ সালে ৭৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সালিম সম্পর্কে আর তেমন কিছু জানা যায় না। তবে ২০০২ সালে তার ছেলে রাশিদের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তার বাবা যখন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে, তখন তিনি সেল্টিকে চিঠি লেখেন। "তবে সেটি অর্থসাহায্য চেয়ে পাঠানো চিঠি ছিল এমন নয়। আমি কেবল জানতে চাইছিলাম আমার বাবার স্মৃতি এখনও তারা মনে রেখেছে কিনা তা জানার জন্য। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলেম, যখন তারা ফিরতি চিঠি পাঠিয়েছিল, সাথে ১০০ পাউন্ডের একটি ব্যাংক ড্রাফট। আমি বেশ খুশি হয়েছিলাম, টাকার জন্য নয়, বরং সেল্টিকের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসে বাবার নাম দেখতে পেয়ে। আমি এখনো ব্যাংক ড্রাফটটি সযত্নে রেখে দিয়েছি এবং আমার মৃত্যু পর্যন্ত তা আগলে রাখবো।"
"আমি কেবল ইউরোপে প্রথম ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে আমার বাবার নামের স্বীকৃতি চাই। এটাই আমার জীবনের একমাত্র চাওয়া।"