উত্তরাধিকারের চিহ্ন বাইসাইকেল কিক: পেলে থেকে সক্রেটিস, রোনালদো থেকে রোনালদিনহো এবং রিচার্লিসন
৩টি বিশ্বকাপ জয়, ১২৮৩টি গোল এবং আরও যা যা অর্জন করেছেন, এর সবকিছুর পরও একটা আক্ষেপ রয়েছে কিংবদন্তী পেলের। আর তা হলো তিনি বিশ্বকাপে কখনোই বাইসাইকেল কিকে গোল করেননি। নিজের আত্মজীবনীতেই পেলে লিখেছেন, "১২৮৩টি গোলের মধ্যে হাতেগোনা ৩-৪টি হয়তো বাইসাইকেল কিকে করা। এটা কঠিন, কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ আমি বিশ্বকাপে কখনো বাইসাইকেল কিকে গোল করিনি।"
পেলে অনেক বিখ্যাত গোল করেছেন, নান্দনিক তো বটেই। বিশ্বকাপের গোলগুলোও কম আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু তার কোনোটিই বাইসাইকেল কিক নয়। রাফায়েল যেমন দা ভিঞ্চির মোনা লিসার মতো ছবি আঁকতে পারবেন না বলে আক্ষেপ করতেন, একইভাবে পেলেও আক্ষেপ করেন বাইসাইকেল কিকের গোল নিয়ে। তাৎক্ষণিকতা, শারীরিক দক্ষতা, নমনীয়তা, বিজ্ঞান আর শিল্পের মিশেলে তৈরি বাইসাইকেল কিকের মতো বিরল জিনিস ফুটবলের জগতে খুব কমই আছে।
একে তুলনা করা যায় চিত্রকরের তুলি থেকে বের হওয়া বুলেটের সাথে, যেটি ডিজাইন করা হয়েছে একজন জ্যামিতিকের কম্পাসের কাঁটা থেকে। যার জন্য প্রয়োজন নাচিয়ের মতো পা, ষাঁড়লড়িয়েদের মতো শারীরিক শক্তি, কবির কল্পনা এবং জুয়াড়ির উদ্যমের সমষ্টি।
ফুটবলের সেরা ফরোয়ার্ডদের অনেকেই নিজেকে নিখুঁত মনে করেন না, নিজেদের প্রতিভা নিয়ে লজ্জিত হন কেবল একটি বাইসাইকেল কিক থেকে করা গোল না থাকার কারণে। পেলেকে সম্মান জানিয়ে যখন রিওতে একটি স্পোর্টস গ্যালারি চালু করা হয়, তখন পেলে তার নিজের সবচেয়ে সেরা গোল হিসেবে নির্বাচন করেন ১৯৬৫ সালে মারাকানায় বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে করা তার বাইসাইকেল গোলটি। গোলটিকে পেলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন তার জীবনের 'সবচেয়ে পরিতৃপ্তি দেওয়া গোল' হিসেবে। 'বিসিক্লেতা দো পেলে' নামের ছবিটি ৫০ বছর পর বিক্রি হয় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে!
পেলের অন্যতম যোগ্য উত্তরসূরী জিকো তার সেরা পারফরম্যান্স হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন জাপানে করা তার বাইসাইকেল গোলটিকে। ব্রাজিলে বাইসাইকেল কিক হয়ে উঠেছে ফুটবলের রাজাদের উত্তরাধিকারের চিহ্ন হিসেবে। পেলে থেকে সক্রেটিস, কারেসা থেকে রোমারিও, রোনালদো থেকে রোনালদিনহো (বার্সেলোনার হয়ে তার করা শেষ গোল ছিল ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে তার বিখ্যাত সিজর কিক), নেইমার এবং বর্তমানে রিচার্লিসন, সবাই এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে উত্তরাধিকারের চিহ্ন বয়ে চলেছেন। রিচার্লিসনের দ্বিতীয় গোল কেবল 'সুন্দর'ই নয়, এটা ব্রাজিলের ফুটবলের অস্তিত্ব আর সত্ত্বার সমার্থক শব্দ। কেবল একটি ফটোগ্রাফ দিয়ে এর সৌন্দর্য্য অনুধাবন করা যাবে না, সেজন্য প্রয়োজন প্রতি মিলিসেকেন্ডের সিরিজ ছবি।
এক সপ্তাহের মধ্যেই কাতার বিশ্বকাপ সালেম-এল-দাওসারীর দৃষ্টিনন্দন গোল দেখে ফেলেছে, তাকুমি আসানোর বুলেট শটও দেখে ফেলেছে, তবে রিচার্লিসনের বাইসাইকেল গোল ছাড়িয়ে গেছে সবগুলোকেই। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ছেয়ে গেছে রিচার্লিসনের বাইসাইকেল কিক নেওয়া ছবিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবল বাইসাইকেল কিকের ছবি। এরকম নিখুঁত বাইসাইকেল কিক জীবনে কয়বারই বা দেখা যায়?
ফুটবলস্ট্যাটিস্টিক্সডটকমের তথ্যানুযায়ী, প্রতি ৫৪০টি বাইসাইকেল কিক থেকে গোল করার চেষ্টার মধ্যে মাত্র একটি সফল হয়। তা-ই বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজের অভিষেকেই বাইসাইকেল কিক থেকে গোল করে রিচার্লিসন নিজেকে বিশেষ কেউ ভাবতেই পারেন।
কিন্তু ব্রাজিলের ইতিহাসের সেরা বাইসাইকেল-কিক গোল পেলে কিংবা রোনালদিনহোর নয়, সেটি 'ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান' হিসেবে পরিচিত লিওনিদাস ডা সিলভার। ১৯৩৮ বিশ্বকাপে ফ্রেঞ্চদের চমকে দিয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে অসাধারণ গোলটি করেন 'মাজিয়া নেগ্রা'। প্যারিসের ম্যাচটির পর সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল, "মানুষটি অনেকটা রাবার ব্যান্ডের মতো। মাটিতে হোক কিংবা আকাশে, মাঠের যেকোনো জায়গায় যেকোনো পরিস্থিতিতে বল নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে রকেটের মতো শট করে গোল করার মতো সহজাত দক্ষতা তার মধ্যে এতটাই প্রবল যে কেউ ভাবতেই পারবে না সেখান থেকে গোল হতে পারে। যখন লিওনিদাস গোল করে তখন সেটিকে স্বপ্নের মতো মনে হবে।"
লিওনিদাস ডা সিলভার শতবর্ষে গুগল তাকে নিয়ে একটি ডুডল বানায়। রিচার্লিসনের গোলও শীঘ্রই ব্রাজিলের ফুটবলীয় রূপকথার বইয়ে জায়গা পেতে যাচ্ছে, যেখানে রয়েছে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপক্ষে পেলের বজ্রগতির গোল, ১৯৭০-এ ইতালির বিপক্ষে কার্লোস আলবার্তোর গোল, ১৯৭৮-এ ইতালির বিপক্ষে নেলিনহোর গোল, এবং ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রোনালদিনহোর করা গোলের মতো গোলগুলো।
যারা রিচার্লিসনের গোল দেখেছেন, কিংবা যেকোনো বাইসাইকেল গোল, তারা নিশ্চয়ই একে স্বপ্নের মতোই ভাবেন। গোলগুলো কেবল দলের আত্মবিশ্বাসই বাড়ায় না, অন্যান্য খেলোয়াড়দের মধ্যে আরও সৃজনশীল কিছু করার চেষ্টা বাড়িয়ে দেয়। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ব্রাজিলেরও তা-ই হয়েছিল। শেষ ২০ মিনিটে ব্রাজিলের খেলার ছন্দ, গতি আর নান্দনিকতার মধ্যে দর্শকরা হারিয়ে গিয়েছিল এক অন্য ভুবনে, যার রেশ কাটে কেবল রেফারির বাঁশিতে।