৯৮’র ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানো ম্যাচে কী ঘটেছিল!
বুধবার (৩০ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ১টায় বিশ্বকাপের মঞ্চে মুখোমুখি হতে চলেছে বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্বের চরম বৈরী দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। ওইদিনের ম্যাচে জয়-পরাজয়ের ওপরেই নির্ভর করছে দুই দলের বিশ্বকাপের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়া বা না যাওয়ার বিষয়টি। ম্যাচে যে দল হারবে, সে দলকে বিদায় নিতে হবে এবারের বিশ্বকাপ থেকে। এমন পরিস্থিতিতে বুধবারের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচ ঘিরে বাড়ছে উত্তেজনা। ফোর ফোর টু ম্যাগাজিন অবলম্বনে।
১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলেও এরকমই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল দুইদল। দলগত ম্যাচে গ্রুপ-এফ এর যুক্তরাষ্ট্র বনাম ইরান ম্যাচকে 'মাদার অফ অল গেমস' বলে অবিহিত করেছিলেন মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। সে সময়ে ওয়াশিংটন-তেহরানের মাঝে চলতে থাকা রাজনৈতিক উত্তেজনা গড়িয়েছিল খেলার মাঠ পর্যন্ত।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিনপন্থী শাহ সরকারের পতন ঘটে। আর এর মাধ্যমেই দুইদেশের মধ্যে বৈরীতার সূত্রপাত হয়। এর ১৯ বছর পর দুই দেশের মধ্যকার ৯৮'র ওই ফুটবল ম্যাচ নতুন করে আবারও রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছিল। ম্যাচ পরিচালনায় ফিফাও পড়েছিল কিছুটা বিপাকে।
ইরানি বংশোদ্ভূত মেহরদাদ মাসুদি ওই ম্যাচে ফিফার পক্ষ থেকে মিডিয়া অফিসার হিসেবে ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, লিঁও তে ম্যাচটিকে ঘিরে কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশকিছু ইস্যু তৈরি হয়েছিল। তাই ম্যাচ পরিচালনায় মিডিয়া ইস্যুর বাইরেও তার দায়িত্ব ছিল অনেক। সেইসঙ্গে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই সামনে আসছিল নতুন নতুন সমস্যা।
এমনি এক সমস্যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মাসুদি বলেন, "ইরান ছিল বি টিমে এবং যুক্তরাষ্ট্র ছিল এ-তে। ফিফার নিয়মানুযায়ী ম্যাচ শুরুর আগে টিম বি-কে টিম এ'র সদস্যদের সঙ্গে হাত মেলানোর (হ্যান্ডশেক) জন্য এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, ইরানী খেলোয়াড়রা অবশ্যই আমেরিকানদের সঙ্গে আগে হাত মেলানোর জন্য এগিয়ে যাবে না।"
শেষ পর্যন্ত এক সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করেছিলেন মাসুদি। অবশেষে, আমেরিকানরাই ইরানী খেলোয়াড়দের দিকে এগিয়ে এসেছিল হাত মেলাতে।
এছাড়াও, ওই ম্যাচকে ঘিরে আরও বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল ফিফাকে। ম্যাচ চলাকালীন ইরান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিকল্পনায় ৭ হাজার টিকিট কিনেছিল মুজাহেদিন-ই-খালেক গ্রুপের (এমকেও) সদস্যরা। ইরানে তারা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিত। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এই দলকে সমর্থন করতেন। কারণ এমকেও'র প্রধান লক্ষ্যই হলো, অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে ইরান সরকারকে উৎখাত করা। যদিও লিঁওতে এমকেও গ্রুপের সদস্যদের স্বাগত জানানো হয়নি, তবে ৪২ হাজার দর্শকের মধ্যে ৭ হাজার সংখ্যাটি নেহাত কম ছিল না।
মাসুদি বলেন, "আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম। আমরা আগে থেকেই জেনেছিলাম গ্যালারির কোন দিকে তারা অবস্থান করবে; সে অনুযায়ী আমরা টিভি ক্যামেরাম্যানদের নির্দেশনা দিয়েছিলাম কোন কোন দিক এবং ব্যানার এড়িয়ে যেতে হবে।"
সারাবিশ্বে ওই ম্যাচ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তাই সন্ত্রাসী দলটিও চেয়েছিল তাদের প্রতিবাদী ব্যানারগুলো যেন টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। তবে ম্যাচটিকে কোনোভাবেই এমকেও সদস্যদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে দিতে চায়নি ফিফা। তাই তারাও কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে আগে থেকেই ক্যামেরাম্যানদের সতর্ক করে দিয়েছিল।
প্রাথমিক পরিকল্পনা বানচাল হওয়ায় প্ল্যান বি অনুযায়ী কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় মুজাহেদিন-ই-খালেকের সদস্যরা। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় তারা খেলার মাঠে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। তবে এ তথ্যও আগে থেকেই জেনে গিয়েছিল ফিফা। এ ব্যাপারে তারা ফ্রান্সের দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে আলাপ করে রেখেছিল। কিন্তু পুলিশ জানিয়েছিল, মারাত্মক অপ্রীতিকর কিছু না ঘটলে তারা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করবে না।
মাসুদি জানান, ঘটনাটি আসলেই মারাত্মক ছিল এবং বিশৃঙ্খলা এড়াতে স্টেডিয়ামে অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
তবে এতসব বাধা বিপত্তির মধ্যেও ইরানের পক্ষ থেকে অভূতপূর্ব সম্প্রীতি দেখানোর মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল ম্যাচটি। মার্কিন প্রতিপক্ষদের হাতে শান্তির প্রতীক সাদা গোলাপ ধরিয়ে দিয়েছিলেন ইরানি খেলোয়াড়রা। মাসুদির মতে, ইরানের ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি খেলার মাঠে তার দেশকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্যই নিয়েছিলেন এ পদক্ষেপ।
দুই দলের একটি গ্রুপ ছবিও তোলা হয়েছিল খেলার মাঠে। এর পরপরই রেফারির বাঁশিতে শুরু হয় ফুটবলের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনাপূর্ণ ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচ।
৯৮'র ওই ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল ইরান।
২৪ বছরের ব্যবধানে আবারও অনেকটা একইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দুই দেশ। এরই মাঝে ম্যাচ শুরুর ২ দিন আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে গেছে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ। মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা বিকৃতির অভিযোগ এনেছে ইরান। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে, মার্কিন দলের টুইটার, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম পেইজ থেকে ইরানের পতাকা থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতীক 'আল্লাহ' শব্দটি বাদ দিয়ে ছবি (ব্যানার) পোস্ট করা হয়েছে। এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে তেহরান। ফিফার কাছে ই-মেইল বার্তায় অভযোগ জানিয়েছে দেশটি।
অন্যদিকে, মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের দাবি, পতাকা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতীক সরিয়ে দিয়ে তারা মাহসা আমিনির মৃত্যু এবং 'মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াইরত ইরানি নারীদের প্রতি সংহতি' প্রকাশ করেছে।
অবশ্য রোববার (২৭ নভেম্বর) বিকেলের মধ্যেই মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া পেইজগুলো থেকে পুরনো ব্যানার সরিয়ে ইরানের জাতীয় পতাকার স্বাভাবিক ছবি পোস্ট করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র বনাম ইরান ম্যাচকে কেন্দ্র করে অনেকটা ৯৮'র মতোই উত্তেজনা চড়তে শুরু করেছে। দুই দেশের মধ্যকার ৪০ দশকের উত্তেজনার প্রতিফল ম্যাচ শুরু আগেই কিছুটা দেখা যাচ্ছে খেলার মাঠে। তবে চূড়ান্ত ফল কোন দলের পক্ষে যায়, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র একদিন।