মরোক্কান হাকিমি: ‘কঠিন সময়’ থেকে তারকা বনে যাওয়ার গল্প
রিয়েল মাদ্রিদের কাস্তিলা অ্যাকাডেমিতে যাতায়াতের সময় প্রতিনিয়ত চোখে পড়ত উন্নত জীবনধারার প্রতিচ্ছবি; দেখতে পেতেন, আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে জীবন কেমন হতো। তবুও নিজের শৈশবকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 'কঠিন কিছু মুহূর্তে ভরা হাসিখুশি শৈশব।'
ভাগ্য সাহসীদের পক্ষেই থাকে-আশরাফ হামিকিই যেন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ!
বিশ্বকাপের আগেও মরক্কোর ফুটবল দলটি নিয়ে যতবার আলোচনা হয়েছে, ততবার উঠে এসেছে হামিকির নাম। এই রাইট ব্যাক ফুটবলারই তাদের সবচেয়ে বড় তারকা।
মরক্কো-স্পেন ম্যাচে হাকিমির করা গোলে নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের ইতিহাসের পুনর্লিখন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে মরক্কো এই প্রথমবার নকআউট টপকে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার সুযোগ পেয়েছে। এর আগে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলেছিলেন আটলাসের সিংহরা।
ছোটবেলা থেকেই আশরাফ হাকিমির জীবন ছিল প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ। কৈশোরে রিয়াল অ্যাকাডেমিতে অনূর্ধ্ব ১৭'তে খেলা, তারপর রিয়াল মাদ্রিদ, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড এবং শেষমেশ প্যারিস সেন্ট জার্মেই তথা পিএসজি-এই সুদীর্ঘ রাস্তায় রয়েছে বহু উত্থানপতনের গল্প। বহু সংগ্রাম করে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়েছে তাকে। খবর আল জাজিরার।
কষ্টে, কিন্তু হেসেখেলে বেড়ে ওঠা হাকিমির
১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বরে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে জন্ম মরক্কোর বংশোদ্ভূত হাকিমির। অল্প বয়সেই ফুটবলের প্রতিভা দেখাতে সক্ষম হন। ইউরোপের সবচেয়ে সফল ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদে যোগ দেন মাত্র আট বছর বয়সে।
শুনে মনে হতে পারে, কত সহজেই এতদূর এগোল! কিন্তু বাস্তবতা অতটাও সহজ নয়। সাফল্যের প্রতিটি দানা হাতের মুঠোয় পেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে।
স্পেনে প্রায় আট লাখ মরোক্কান অভিবাসী বাস করেন। তাদের মধ্যে হাকিমি একজন।
মাদ্রিদের শিল্প এলাকার শহরতলী হেতাফে'তে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। রিয়েল মাদ্রিদের কাস্তিলা অ্যাকাডেমিতে যাতায়াতের সময় প্রতিনিয়ত চোখে পড়ত উন্নত জীবনধারার প্রতিচ্ছবি; দেখতে পেতেন, আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে জীবন কেমন হতো। তবুও নিজের শৈশবকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, 'কঠিন কিছু মুহূর্তে ভরা হাসিখুশি শৈশব।'
পরিবারের খরচ যোগাতে বাসাবাড়িতে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন তার মা। আর বাবা ছিলেন ফেরিওয়ালা, বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করতেন রাস্তায় রাস্তায়।
স্প্যানিশ টিভি প্রোগ্রাম এল চিরিঙ্গিতো'তে হাকিমি বলেন, 'তারা (মা-বাবা) আমার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। আমি যেন সফল হতে পারি, সেজন্য ভাই-বোনেরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন আমি তাদের জন্যেই খেলি।'
স্পেন থেকে শুরু করে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস তথা ইউরোপ জুড়ে অসংখ্য মরোক্কান অভিবাসীর বাস করেন। এই বিপুল সংখ্যক মরোক্কানের মধ্যে থেকে প্রতিভাসম্পন্ন খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে স্কাউট নিয়োগ দেয় মরোক্কান ফুটবল ফেডারেশন।
২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ফোরটুফোর ম্যাগাজিনকে ফেডারেশনটির টেনকিক্যাল পরিচালক নাসের লারগুয়েত জানান, 'আমরা যখন আশরাফ হাকিমিকে দলে নিলাম, তখন সে রিয়েল মাদ্রিদে অনূর্ধ্ব ১৭'তে খেলত।
ফুটবলের নেশায় মত্ত হাকিমি প্রতিনিয়ত স্কাউটদের জিজ্ঞেস করতেন, কবে ট্রনিং ক্যাম্প শুরু হবে। পরবর্তী ম্যাচের জন্য অধীর আগ্রহে থাকতেন কিশোর হাকিমি।
তার এই উৎসাহ দেখে নাসের ব্যক্তিগতভাবে তাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এভাবে পরিশ্রম করতে থাকলে তাকে খুব শীঘ্রই জাতীয় দলে নেওয়া হবে।
কথামতো অনুশীলন করে যান হাকিমি। ২০১৬ সালে ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে ডাক পান। কিন্তু এ দলে যোগদানের সিদ্ধন্ত তার জন্য আবেগের প্রশ্ন। স্প্যানিশ যুবদল অর্থাৎ ইউথ টিমের হয়ে বেশ কয়েকবার খেলেছিলেনত; স্পেনের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলারও চিন্তাভাবনা ছিল তার। কিন্তু দেশটির জাতীয় দল লা রোজা'তে যোগদানের প্রখর টান অনুভব করেননি তিনি, নিজেকে সেখানে মানানসই লাগেনি তার কাছে। তাই শেষমেশ যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি।
লে'কিপ-এর এক সাক্ষাৎকারে হাকিমি বলেন, 'আমার সংস্কৃতি হলো মরোক্কান। বাড়িতে সবাই এ ভাষাতেই কথা বলি, খাবারও খাই মরোক্কান। তাছাড়া আমি একজন মুসলিম। তাই সত্যি বলতে স্পেনের জাতীয় দলে না গিয়ে মরক্কোর জাতীয় দলে যোগদান নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয়নি আমার।'
ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে টিভির পর্দায় মরক্কোর খেলা দেখতেন। বাবার হাত ধরেই পরিচয় হয় সেসময়ের দারুণ সব খেলোয়াড়দের সাথে।
২০১৭ সালে রিয়েল মাদ্রিদে যোগ দেন হাকিমি। এটি ছিল তার ক্যারিয়ার গড়ার সুবর্ণ সময়। কিন্তু দুই বছর ধারে তাকে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ক্লাবে পাঠায় রিয়েল মাদ্রিদ। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়ে হয়ে ওঠেন হাকিমি। দুই মৌসুমে ৭৩টি ম্যাচে ১২টি গোল করেন এবং ১৭টি আসিস্ট দেন তিনি।
কিন্তু তবুও রিয়েল মাদ্রিদ তাকে দলে ফেরাতে রাজি হয়নি।
বহুবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর রিয়ালের কাছ থেকে চূড়ান্তভাবে তাকে কিনে নেয় ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলান। ২০২০ সালে যোগ দেওয়া এই ক্লাবে তিনি মোট ৩৭টি ম্যাচ খেলেছিলেন। অ্যান্তোনিও কোঁত-এর এই দলের অপরিহার্য অংশ বনে যান তিনি। গতবছর তার দলে থাকা অবস্থায় সিরি আ শিরোপা জিতে মিলান।
বৈচিত্রে ভরপুর তার ক্লাব ক্যারিয়ারে, অবশেষে ২০২১ সালে পিএসজিতে এসে তার প্রতিভা সবার নজরে আসে। নিখুঁত লং পাসের জন্য খ্যাত হয়ে যান এই ডিফেন্ডার।
ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, ঠিক যখন তাকে দলের জন্য প্রয়োজন হয়, সে মুহূর্তে দলকে এগিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য রাখেন হাকিমি। তাই মরক্কো-স্পেন ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ পেনাল্টি কিকে তাকে দেখে অবাক হননি দর্শক ও ভক্তরা।
২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ হাকিমি এবং তার দলের জন্য হতাশাজনক ছিল। স্পেন, পর্তুগাল এবং ইরানকে হারিয়েও গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে যান তারা। তবে কাতার বিশ্বকাপে এসে দেশের জন্য গড়লেন রেকর্ড। দলকে কতদূর নিয়ে যেতে পারেন, এখন তা দেখার পালা।