বিশ্বকাপ ২০২২: ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েলকে হারিয়ে যে কারণে উড়ছে ফিলিস্তিনের পতাকা
কাতারে চলছে ফুটবল বিশ্বকাপ। বিশ্ব ফুটবলের এ আয়োজনে সোনালী শিরোপা যে দেশেরই হোক– এরমধ্যেই জিতে গেছে ফিলিস্তিন! ভাবছেন কীভাবে– যখন অধিকৃত ফিলিস্তিনের কোনো দলই নেই বিশ্বকাপে। আসলে ফিলিস্তিনের স্থান বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার হৃদয় ও মনে। স্বাধীনতা, বর্ণবাদ বিরোধিতা, উপনিবেশবাদ সবের সাথে একাকার হয়ে আছে যে ভূখণ্ডের নাম– তারই পতাকা জড়িয়ে বিশ্বকাপের গ্যালারিতে হাজির হচ্ছেন বিভিন্ন দেশের ফুটবল ভক্ত-সমর্থকরা। আল জাজিরা অবলম্বনে
ম্যাচ যে দেশেরই হোক– আরব বিশ্বের প্রথম এ ফুটবল আয়োজনে– গ্যালারিতে ভালোভাবে চোখ রাখলেই নজরে পড়বে ফিলিস্তিনের পতাকা, পতাকার রঙের আর্মব্যান্ড ও ব্রেসলেট। 'ফিলিস্তিন মুক্ত করে' (ফ্রি প্যালেস্টাইন) ধবনিও শোনা যাচ্ছে অহরহ। আরব শাসকরা যতোই অবহেলা করুন, বা ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠতার দিকে যান– তাদের জনগণ যে ফিলিস্তিনকেই মুক্তির শিখা মনে করে এ যেন তারই প্রতীক। অন্য দেশ থেকে আসা ফুটবল ফ্যানরাও এভাবেই ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। তাই বলা হচ্ছে, ৩২ দেশের এই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে না পেরেও– ৩৩তম দলটি হলো- ফিলিস্তিনের। কথাটি হয়তো মোটেও বাড়িয়ে বলা নয়। এমনকী লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের মিডিয়াও ফিলিস্তিনকে বলছে এই টুর্নামেন্টের '৩৩তম দেশ'।
ফিলিস্তিনের টিম না থাকারও পরও সরব এই উপস্থিতির পেছনে অন্য কী কারণ কাজ করছে, তা জানতে হলে, জেনে রাখা ভালো– ফুটবল পৃথিবীব্যাপী উন্মাদনার এক খেলা। আর তার সূচনা করে প্রতিটি বিশ্বকাপের আসর। এ শুধু আর খেলার আসর থাকে না, হয়ে ওঠে বৈশ্বিক জনতার মিলিত উপস্থিতি আর অংশগ্রহণের মিলনমেলা। এখানে তারা শুধু ফুটবলের প্রতি তাদের আবেগ প্রকাশ করতেই আসেন না, এটি হয়ে ওঠে মানবজাতির সহমর্মিতার এক আয়োজন। আর সেখানেই জয় হচ্ছে ফিলিস্তিনের।
তাছাড়া, আরব বিশ্বের প্রথম বিশ্বকাপ হওয়ায় এই অঞ্চলের জনতারা এবার ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও যাতায়াতের সুবিধার কারণে বেশি অংশ নিতে পারছে গ্যালারিতে। তাদের ভালোবাসাতে প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়েছে 'প্যালেস্টাইন' – আরব মানসপটে পশ্চিমা বিশ্বাসঘাতকতা ও উপনিবেশবাদের চূড়ান্ত শিকার।
ফিলিস্তিনের প্রতি কাতার সরকারের আন্তরিক সহানুভূতির কারণেও কোনো প্রকার আইনি বাধা বা নির্যাতনের ভয় ছাড়াই আরবরা প্রকাশ করছে 'অনন্ত ফিলিস্তিন' ভূখণ্ডের প্রতি তাদের ভালোবাসা; নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের সাথে একাত্মতা।
আত্মিক এই বন্ধন যে আজো অটুট– তারই প্রমাণ কাতার বিশ্বকাপের আসর। ফলত- স্বাভাবিকভাবেই কাতার বিশ্বকাপে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে ফিলিস্তিন সমস্যা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আরব জনতার ঐক্যের যোগসূত্র হয়ে উঠেছে– ফিলিস্তিন আজ। ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার সংগ্রামে তাদের দৃঢ় সমর্থন।
'ফিলিস্তিন মুক্ত কর'
সিংহভাগ মানুষ যে বিশ্বাসে আন্দোলিত তাকে বলা হয়- ভক্স পপুলি। আরবদের কাছে এবারের বিশ্বকাপে সেই ভক্স পপুলি মুহূর্তের প্রতীক ফিলিস্তিন; একইসঙ্গে যা সংগ্রাম ও অপরাজেয় মনোভাবের প্রতীক।
ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানিয়ে তারা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে নব্য-উপনিবেশবাদ ও দখলদারিত্বের তীব্র প্রতিবাদ করছেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে। একইসঙ্গে, এটি তাদের নিপীড়ক আরব শাসকদের প্রতিও এক প্রকাশ্য ধিক্কার।
যে শাসকদের অত্যাচারে নিভেছে এক দশক আগে আরব বিশ্বকে আন্দোলিত করা আরব বসন্তের প্রদীপ– তারই প্রতিচ্ছবি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আরব জনতার এই একাত্ম। ফিলিস্তিনের পতাকা গায়ে জড়িয়ে, মুক্তাকাশে উড়িয়ে তারা নিজেদের মর্যাদা ও অধিকারের দাবিই যেন মুখরিত করছেন 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' স্লোগানের আড়ালে।
ঐতিহাসিকভাবেই, আরবদের রাজনৈতিক সংগ্রামের কেন্দ্রে চিরকাল দেখা গেছে ফিলিস্তিনের পতাকা। তাই কাতার বিশ্বকাপে এর ব্যতিক্রম হওয়াটাই হতো বিস্ময়কর। ফলে প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারির শোভা বাড়াচ্ছে ফিলিস্তিনের কেতন।
ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে গত ২৬ নভেম্বর তিউনিশিয়া বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ চলাকালে। তারপর একই ধারা ছিল পরের দিনে মরক্কো বনাম বেলজিয়ামের ম্যাচেও। তারপর থেকেই ফিলিস্তিনের পতাকা আন্দোলিত হচ্ছে আরও বেশি বেশি।
তিউনিশিয়া বনাম ফ্রান্সের ম্যাচ চলাকালে ফিলিস্তিনের ঝাণ্ডা নিয়ে গ্যালারি ছেড়ে মাঠে ঢুকে পড়েন তিউনিশিয় এক ফ্যান। তিনি স্লোগান দিচ্ছিলেন 'ফ্যালেস্তিন' 'ফ্যালেস্তিন' (ফিলিস্তিনের আরবি উচ্চারণ) বলে। পরে তাকে মাঠের বাইরে নিয়ে যায় নিরাপত্তা কর্মীরা।
কানাডাকে হারিয়ে ১৬ দলের নকআউট পর্বে ওঠা নিশ্চিতকারী ম্যাচ শেষে– ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়ান মরোক্কোর খেলোয়াড়রা। এরপর তারা স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করেছে।
দোহার জনপ্রিয় বাজার প্রাঙ্গণ সৌক আফিকে এই জয় নেচেগেয়ে উদযাপন করেন মরোক্কোর ফুটবল ফ্যানরা। কিন্তু, উপযাপনের সঙ্গীত ছিল ফিলিস্তনের দুঃখে ভারাক্রান্ত পঙক্তিতে-
বিষাদময়, তবু ভালোবাসার অনুরণনে ভরা–
আমাদের বুকে পাষাণ ভার শুধু তোমারই জন্য,
বছর বছর তোমার বিষাদে জল ঝরে দু'চোখের–
প্রিয়তম ফিলিস্তিন।
কোথায় সব আরব, সবাই আজ ঘুমন্ত,
তবু হে সবসেরা তিলোত্তমা ভূমি, প্রতিরোধ গড়
সর্বশক্তিমান তোমার সহায় হোন…
(আরবি গানের ইংরেজি থেকে ভাবানূদিত অংশ)
আরেকটি হৃদয়বিদারক তবু অভিনব 'প্রতীকী' সমর্থনও জানান আরবরা। প্রতি ম্যাচের ৪৮ মিনিটের মাথায় উড়েছে ফিলিস্তিনের পতাকা। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের স্লোগান মুখরিত করেছে স্টেডিয়াম একইসঙ্গে। এ ছিল ১৯৪৮ সালের 'নাকবা'র স্মরণ। নাকবার আক্ষরিক অর্থ 'বিপর্যয়'- ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে সে বছর যে অগুনতি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল, স্বভূমি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, তাকেই তাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় মহাবিপর্যয় বলেন ফিলিস্তিনিরা।
শুধু আরবরা নয়, ফিলিস্তিনের জয়গাঁথা মাতিয়েছে লাতিন দর্শকদেরও।
ক্যামেরুনের সাথে স্বদেশের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার সময়– দোহার মেট্রো স্টেশনে' ফিলিস্তিন মুক্ত কর" স্লোগান দিতে শোনা গেছে ব্রাজিলীয় সমর্থকদের।
শুধু তারাই নয়, পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফুটবল পাগল মানুষকে দেখা গেছে দোহায়– মুক্তমনে ওড়াতে ফিলিস্তিনের পতাকা, আর জানাতে মুক্তির প্রতি, সাম্যের প্রতি অগাধ ভালবাসা। দোহার পথে পথে উড়িয়েছেন তারা ফিলিস্তিনের ঝাণ্ডা।