মরক্কোর বিশ্বকাপ যাদুমন্ত্র: মায়ের সঙ্গে ফুটবলারদের চোখ জুড়ানো উদযাপন!
এফ গ্রুপের নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে টুর্নামেন্ট ফেভারিট বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফুটবল বিশ্বকে চমকে দেওয়ার পর প্যারিস সেন্ট-জার্মেই ফুলব্যাক আশরাফ হাকিমি স্ট্যান্ডে মায়ের দিকে দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করেন। ২৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার পরে তার মায়ের কপালে চুমু দেওয়ার একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে ক্যাপশন লিখেছেন, "আমি তোমাকে ভালবাসি, মা"।
তবে হাকিমির মা-ই একমাত্র মরক্কোর ফুটবলারদের বাবা-মা নন যিনি ২০২২ বিশ্বকাপে তার ছেলেকে সরাসরি সমর্থনের জন্য কাতার ভ্রমণ করেছেন। খবর আল-জাজিরার।
পরিবারের ভালোবাসা
কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই এবং রয়্যাল মরোক্কান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ফৌজি লেকজার নির্দেশে মরক্কোর স্কোয়াডের সব ফুটবলারদের নির্বাচিত পারিবারিক সদস্যকে কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে, যার খরচ বহন করবে দেশটির ফুটবল ফেডারেশনই। ফলে, উইন্ডহ্যাম দোহা ওয়েস্ট বে হোটেলে থাকা মরক্কোর বেজক্যাম্প প্রায়ই পরিণত হয় অভিভাবক-চালিত গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পের মতো। কোচ রেগরাগুইয়ের মা ফাতিমার মতো অনেকের কাছেই এই ভ্রমণ ছিল 'জীবনে একবারের সুযোগ'।
"খেলোয়াড় কিংবা কোচ হিসেবে তার পুরো ক্যারিয়ারে আমি কখনোই তাকে সরাসরি দেখার জন্য ভ্রমণ করিনি। আমি এখন ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফ্রান্সে থাকছি এবং এটিই প্রথম প্রতিযোগিতা, যার জন্য আমি প্যারিস ছেড়েছি," মরক্কোর স্পোর্টস চ্যানেল আরিয়াদিয়াকে জানান ফাতিমা।
যখনই তাদের সামনে টেলিভিশন বুম আর মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছে, মরক্কোর খেলোয়াড়দের গর্বিত বাবা-মারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন কীভাবে স্কোয়াডের সমস্ত 'ছেলে'কে তারা নিজেদের ছেলের মতোই মনে করেন।
সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলো ছাড়াও, রেগরাগুইয়ের অন্যতম কৌশল ছিল স্ট্যান্ডে বাবা-মা উপস্থিত রেখে খেলোয়াড়দের মধ্যে আরও উৎসাহ বাড়ানো, দলে আরও পজিটিভ-এনার্জি বাড়ানো। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মামুরা শহরের ষষ্ঠ মোহাম্মদ কমপ্লেক্সে ঘোষণা দিয়েছিলেন: "আমাদের বাবা-মার খুশি ছাড়া আমাদের সাফল্য সম্ভব নয়।"
মরক্কো এই বিশ্বকাপে মোটেই ফেবারিট কোনো দল নয়, কিন্তু ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার শেষ ষোলোতে পৌঁছে তারা ইতিমধ্যেই তাদের পরিবার আর ভক্তদেরকে রোমাঞ্চিত করেছে। টুর্নামেন্টের মাঝখানে তারা এমন একটি দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যাদের জন্য অনেক নিরপেক্ষ সমর্থকও তাদের পক্ষে চলে এসেছে, বিশেষ করে বাবা-মায়ের সাথে তাদের আবেগঘন মুহূর্তগুলো গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর।
কিন্তু মরোক্কোর আশাকে বহন করা যাদুমন্ত্রের আরেকটি উপাদান হলো মরক্কোর সমর্থকদল যারা কাতারের স্টেডিয়ামগুলোকে তাদের আরেকটি বাড়িতে পরিণত করেছে।
ঘরোয়া মাঠের সুবিধা
অন্তত ১৫ হাজার মরক্কোর নাগরিক আগে থেকেই কাতারে বাস করে এবং বিশ্বকাপ উপলক্ষে সারাবিশ্ব থেকে আরও কয়েক হাজার মরোক্কান কাতারে ভিড় জমিয়েছে প্রথম আরব দেশ আয়োজিত বিশ্বকাপ দেখার জন্য। গ্রুপ-পর্যায়ের প্রতিটি ম্যাচে এই দর্শকরাই প্রতিপক্ষ দলগুলোর জন্য এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
দর্শকরা অ্যাটলাস লায়ন্সদেরকে কীভাবে সাহায্য করেছে তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচের শেষ পর্যায়। খেলার শেষ বাঁশি বাজার ১৫ মিনিট আগে ১-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর মরক্কো বেলজিয়ামের আক্রমণ প্রতিহত করা এবং পাল্টা আক্রমণ শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বিশ্বকাপ যদি ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকায় হত, যেখানে মরোক্কোবাসীর উপস্থিতি কম থাকতো, তবে সেই ১৫ মিনিটকে মনে হতে পারতো এক ঘন্টার মতো।
কিন্তু আল থুমামা স্টেডিয়ামের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেলজিয়ামের খেলোয়াড়রা যখনই বল দখলে নিয়েছিল তখনই শিস আর বুয়ের আওয়াজ বর্ষিত হচ্ছিলো তাদের ওপর। আবার, ঠিক যখনই মরক্কো তাদের কাছ থেকে বল কেড়ে নিত, স্ট্যান্ড থেকে শুরু হতো দর্শকদের 'গর্জন'। গ্রুপের শেষ ম্যাচের পর কোচ রেগরাগুই তাই বলেই বসেন, "আমি খোদার শপথ করে বলছি যদি সমর্থকরা এখানে না থাকত, আমরা পরের রাউন্ডে যেতে পারতাম না!"
আইয়ুব নামে একজন মরোক্কান সমর্থক জানান দোহায় মরক্কোর খেলোয়াড়দের এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ দর্শকদের উপস্থিতি: "আমাদের কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই এটাই আমাদের কাছ থেকে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন স্টেডিয়ামজুড়ে মরক্কোর স্লোগান শুনতে চেয়েছিলেন, আর সারা স্টেডিয়ামের সমস্ত মরক্কোর সমর্থকরা তা-ই করেছে।"
মরক্কোর সমর্থকরা কাতারে থাকা প্রতিপক্ষ দলগুলোর ওপর যে চাপ তৈরি করেছে তা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সাথে মিলে যায়। নিজের মাঠে খেলা দলগুলোর খেলোয়াড়দের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা দর্শকদের উৎসাহে বেড়ে যায়, এবং উত্তর আফ্রিকার দেশটি এ কারণে তাদের সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাতেই পারে।
অবশ্যই এই দর্শক উপস্থিতি খেলোয়াড়দের দক্ষতাকে খাটো করছে না, কারণ বিশ্বকাপের অন্যান্য আরব দল নিজেদের মাঠে খেলা থাকা সত্ত্বেও ভালো পারফর্ম করতে পারেনি। কিন্তু, স্পেনের সাথে ম্যাচের আগে টিকিটের চাহিদা এত বেশি ছিল যে, মরক্কোর সমর্থকদের জন্য মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশনকে অতিরিক্ত ৫ হাজার টিকেট সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
রাজকীয় লাল পতাকা আর দারবুকা গবলেট ড্রামে সজ্জিত মরক্কোর সমর্থকরা সম্ভবত বুধবার রাতে আবারও এজুকেশন সিটি স্টেডিয়ামকে নিজেদের হোম ভেন্যুতে পরিণত করবে।
ডায়াসপোরার ওপর নির্ভর করা ফুটবল দল
কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের বিরুদ্ধে মাঠে নামলেও মরক্কোর সাথে স্পেনের এক গভীর সমাজতাত্ত্বিক টানপোড়েনও আছে। আর
পুরো বিশ্বকাপে ১৩৭ জন খেলোয়াড় আছেন যারা যে দেশে জন্ম নিয়েছেন তার থেকে ভিন্ন দেশের হয়ে মাথে প্রতিনিধিত্ব করছেন, যার মধ্যে রয়েছে মরক্কো দলের অর্ধেকের বেশি খেলোয়াড়। রেগরাগুইয়ের নির্বাচিত ২৬ জনের স্কোয়াডের ১৪ জনই জন্মেছেন মরক্কোর বাইরে, ৩২ দলের মধ্যে এত বড় ডায়াসপোরা কেন্দ্রিক দল আর নেই।
খেলোয়াড়দের বেড়ে ওঠার পরিবেশ আলাদা থাকলে খেলোয়াড়দের মধ্যকার টিম-কেমিস্ট্রি বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়, তবে মরক্কোর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। কারণটা হলো দেশের বাইরে থাকা তাদের বিশাল ডায়াসপোরা সমাজ। খেলোয়াড়দের সকলেই বেড়ে উঠেছেন মরোক্কান কমিউনিটির মাঝেই, ফলে মরক্কোতে জন্ম না নেওয়া বা বেড়ে না ওঠা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে মরোক্কান জাতীয়তাবোধ প্রবল। মরক্কোর অনেক খেলোয়াড়ের বাবা-মাই জাতীয় দলের প্রতি তাদের সন্তানদের আবেগ এবং জন্ম নেওয়া দেশের পরিবর্তে মরক্কোর প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গর্ব করছিলেন।
স্ট্রাইকার জাকারিয়া আবুখলালের বাবা তারেক জানান: "জাকারিয়া হল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছে, তার সবকিছুই হল্যান্ডের। কিন্তু আমাদের রক্ত মরক্কোর।" মিডফিল্ডার বিলাল এল-খানুসের বাবা তার বেলজিয়ামে জন্মগ্রহণকারী ছেলে মরক্কোর হয়ে খেলতে কেন বেছে নিয়েছে তার জবাব দিতে গিয়ে বলেন, "তার হৃদয় যা চায়, সে সেটিই বেছে নিয়েছে।"
স্পেনে স্প্যানিশদের পরেই মরোক্কানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। স্পেনে থাকা প্রায় ৮ লক্ষ মরোক্কানদের মধ্যে হাকিমি পরিবারও রয়েছে। এল চিরিঙ্গুইতোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে আশরাফ হাকিমি জানান, "আমার ছিলেন একজন ক্লিনার, বাবা রাস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। তারা আমার জন্য সবকিছু দিয়েছেন। তারা আমাকে বড় করার জন্য আমার ভাই-বোনদের কাছ থেকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছেন। আজকে, আমি তাদের হয়ে খেলছি।"
বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই রাইট ব্যাককে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল স্পেনের হয়ে খেলার জন্যও, কিন্তু তিনি প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। "আমার কাছে মনে হয়েছিল এটা আমার জন্য ঠিক পরিবেশ নয়। আমি আমার বাসায় যেভাবে থাকি, তার সাথে এর কোনো মিল নেই। আমি আরব সংস্কৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি, নিজেকে একজন মরোক্কান মনে করি," মার্কার সাথে আরেকটি সাক্ষাৎকারে জানান তিনি।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ওঠার পরপরই ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী কোচ রেগরাগুই স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কথা ভাবছিলেন, যখন দলটি শেষবার গ্রুপ পর্ব থেকে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে উঠেছিল। "সে সময় আমি ফরাসি শহরতলীতে বাস করতাম, এবং যখন মরক্কো পর্তুগালকে হারিয়েছিল, আমার জীবনের সবচেয়ে সুখীতম মুহূর্ত ছিল ওটি," জানালেন রেগরাগুই।
এখন তার দল নতুন উচ্চতায় আরোহণের দ্বারপ্রান্তে: বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে তারা সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে। তারা কি পারবে বুধবার রাতে ফ্রান্সকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে?