লিওনেল মেসি: সবুজ গালিচার বুকে ঠান্ডা মাথার চিত্রকর
বয়স হয়ে গেছে ৩৫, নিশ্চিতভাবেই এটি তার শেষ বিশ্বকাপ, যা বলেছেন নিজেই। একটি করে ম্যাচ যায় আর লিওনেল মেসিকে বিশ্বকাপে দেখার সময় ফুরিয়ে আসে। প্রতিটি ম্যাচেই এই ভয় নিয়ে শুরু হয় যে এই বুঝি তার বেলা ফুরিয়ে গেল!
ক্লাব ফুটবলে যা যা অর্জন করার, পেয়েছেন তার সবকিছুই। ব্যক্তিগত অর্জনের স্মারক তো বোধহয় গুনে রাখারও উপায় নেই। কিন্তু তবুও যেন কোথায় একটা অপূর্ণতা কাজ করেই লিওনেল মেসির, বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা যে ছুঁয়ে দেখা হয়নি এখনও!
আরও দুটো লিগ শিরোপা কিংবা পিএসজির হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেও তাতে খুব বেশি কিছু যোগ হয়ে যাবে না মেসির বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে। আর কিছু না জিতলেও হেরফের হবে না তার কৃতিত্বের, কিন্তু একটা ট্রফি, একটা বিশ্বকাপ ট্রফি অনেক কিছুই বদলে দিবে।
কাতার বিশ্বকাপে যে আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে এসেছেন, সেটিকে ভালো বলা গেলেও বিশ্বমানের বলা চলে না। অন্তত বাকি ফেভারিট দলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে তো নয়ই। নেতৃত্ব গুণ আর মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে সেই দল নিয়েই এখন বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে ধরা থেকে মাত্র দুই ধাপ দূরে লিওনেল মেসি।
চূড়ান্ত সাফল্যের একেবারে হাতছোঁয়া দূরত্ব থেকে আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা তো আর কম ফিরে আসেননি। ২০১৪ বিশ্বকাপেই হয়ে যেতে পারতো মেসির প্রবল আরাধ্য সেই ট্রফি উঁচিয়ে ধরা, জার্মান বাধা আর মারিও গোতজে সেটা আর হতে দিলেন কই!
তাই প্রশ্ন জাগেই, এবারও যদি ঘটে ২০১৪'র পুনরাবৃত্তি, আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা কীভাবে ধবংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াবেন! লিওনেল মেসিই বা কীভাবে আবার ফুটবল মাঠে ফিরবেন?
তাই বিশ্বকাপে প্রতিটা ম্যাচেই আশংকা জাগে, এটিই মেসিকে শেষবারের মতো মাঠে দেখা নয়তো? আর্জেন্টিনা যদি বিশ্বকাপ জিতে যায় সেক্ষেত্রে হয়তো আরও দুই-তিন বছর ফুটবল টা খেলবেন মেসি। কিন্তু যদি হেরে যায় এত কাছে এসে আবারও? কল্পনা করতেই গা শিউরে উঠে।
লিওনেল মেসি এমন একজন খেলোয়াড় যিনি কোচদের অধীনে যতোটা না শিখেছেন, তার থেকে বেশি কোচরাই মেসিকে ব্যবহার করে নিজেদের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করেছেন। নিজের যত্ন কীভাবে নিতে হয় সেটি মেসির থেকেই শেখা উচিত তরুণ ফুটবলারদের।
মেসির সবসময়ই চলেছেন আপন ছন্দে, নিজের মতো করে সাজিয়েছেন তার ক্যারিয়ার। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে হয়েছেন আরও পরিপক্ক।
৮ বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টাইব্রেকারে জিতেছিল আর্জেন্টিনা, সেই ম্যাচে ব্যক্তিগতভাবে বেশ নিষ্প্রভ ছিলেন মেসি। ডাচ কোচ লুই ভ্যান হাল ম্যান মার্কিং করিয়ে আটকেছিলেন মেসির জাদু।
২০২২ বিশ্বকাপেও ডাচদের কোচ ছিলেন সেই ভ্যান হালই, কিন্তু এবার মেসিকে আটকাতে পারলেন না কেন তিনি! কারণ একটাই, নিজের অতীতের ভুল এবার এড়িয়েছেন মেসি। ভূতের মতো ঘুরেছেন ডাচ রক্ষণভাগের আশেপাশে। মানুষকে না হয় মার্ক করা যায়, ভূতকে কীভাবে করবেন!
মেসির স্বভাবসুলভ দ্রুতগতির ফুটবল এখন আর দেখা যায় না। অনেকের মনে হতে পারে সেটি বয়সের জন্য। কিন্তু না, আগের ভুল মেসিকে শিখিয়েছে একটা ম্যাচ কীভাবে ধীরগতিতে খেলেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
তার ধীরগতির জন্য হয়তো রক্ষণে খুব বেশি সাহায্য করেন না, কিন্তু প্রতিপক্ষকেও নতুন করে ভাবতে হয় তাকে নিয়ে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেই যেমন দেখা গেল, ম্যাচের ৩৫ মিনিট পর্যন্ত মেসির বলার মতো তেমন কোনো অবদান ছিল না, কিন্তু যেই জায়গামতো বল পেলেন, ডাচ রক্ষণের কলিজা ছিঁড়েফুরে দিলেন এমন এক পাসে, যা তাকে ছাড়া কাউকে দিয়ে সম্ভব নয়।
নিজের পেনাল্টি গোল করলেন যে শটে, সেটি নেওয়ার আগে ডাচ গোলরক্ষক আন্দ্রেস নোপার্ট এসে কী কী যেন বললেন তাকে, কিন্তু মেসির মুখভঙ্গিমায় তার কোনো ছাপই পড়তে দেখা গেল না। নোপার্টকে রীতিমতো ঘোল খাইয়ে আলতো করে বল ঠেলে দিলেন জালে।
অথচ এই বিশ্বকাপেই বাঁচা-মরার ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে তীব্র গতির শট নিয়েও পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন মেসি। ভুল থেকে যে সাথে সাথেই শিক্ষাটা নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে গড়পড়তা দল নিয়েই আর্জেন্টিনাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ৩৬ বছর পর, মেসি কী পারবেন কাতারে সেই যুগকে ফিরিয়ে আনতে? পারতে যে তাকে হবেই। নয়তো বিশ্ব বঞ্চিত হবে আরো কিছুদিন মেসির মোহে বুঁদ হয়ে থাকার সুযোগ।
এই মেসি অন্যরকম, বছর ২৩ এর পাগলা টগবগে রক্ত গরম থাকা যুবক আর তিনি নন, এই মেসি ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতায় ভরপুর, ঠান্ডা মাথার সবুজ গালিচার এক চিত্রকর।