বিশ্বকাপ সাফল্যের পেছনের গডফাদার: কে এই নাসের লারগুয়েত?
কাতার বিশ্বকাপে মরক্কো নতুন ইতিহাসের রচনা করেছে। প্রথম আফ্রিকান ও আরব দেশ হিসেবে সেমিফাইনালে জায়গা করে নিতে পেরেছে এ দল। ফুটবলপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে তাদের খেলার কৌশল। এর ভূমিকার কথা বলতে গেলে খেলোয়াড়দের সঙ্গে উঠে আসবে কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই-এর নাম। তার ব্যবস্থাপনার দক্ষতার বলেই এতদূর আসতে পেরেছে মরক্কো।
কিন্তু হাকিম জিয়েশ, সোফিয়ান বুফল, ইয়াসিন বোনোদের আজকের তুখোড় ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে অবদান রয়েছে আরেক ব্যক্তির, যাকে এই দলের গোড়াপত্তনকারী বললেও ভুল হবে না। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় সংগ্রহ করেছেন তিনি, দিয়েছেন প্রশিক্ষণ।
তার নাম নাসের লারগুয়েত। নাম শোনেননি নিশ্চয়। কারণ বিশ্বের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় নন তিনি। তাই মরক্কোর ফুটলার কিংবা কোচের নাম জানলেও, ৬৪ বছর বয়সী এই ব্যক্তির নাম না শোনাটাই সমীচীন।
আমরা তাকে না চিনতে পারি, কিন্তু তার হাতে গড়া মরক্কোন ফুটবলারদের খেলার মাধ্যমে তার বহু বছরের সাধনাকে ফলাফলে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে না হলেও, সুদূরে থেকে তিনি উপভোগ করেছেন আটলাসের সিংহদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। খবর দ্য অ্যাথলেটিক-এর।
১৪ বছর আগে মরক্কোর সুলতানের অনুরোধে তিনি এক মিশন গ্রহণ করেন; দেশটির জাতীয় ফুটবল দলকে দক্ষ করে তোলার মিশন।
মরক্কোর জাতীয় খেলা ফুটবলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে ২০০৯ সালে সুলতান মোহাম্মদ ষষ্ঠ একটি ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামানুসারেই এর নাম দেওয়া হয় মোহাম্মদ ষষ্ঠ ফুটবল একাডেমি।
সুলতানের নির্দেশে দেশটির ফুটবলকে ঢেলে সাজাতে কাজে নেমে পড়েন নাসের। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে খুঁজতে থাকেন ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী সম্ভাবনাময় ফুটবলার। তার এ যাত্রায় তিনি প্রায় ১৫ হাজার শিশু-কিশোরদের পর্যবেক্ষণ করেন। প্রাথমিক দল গঠনের জন্য তাদের মধ্য থেকে সেরাদের সেরা কিশোর খেলোয়াড়দের বাছাই করতে থাকেন।
উত্তর মরক্কোর সিদি স্লিমানে নামক এক ছোট শহরে বেড়ে ওঠা নাসের বর্তমানে সৌদি আরব ফুটবল দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। যতই নাসেরকে জানবেন, তাকে সৌদি আরবের মতো সম্ভাবনাময় দল কেন দায়িত্বে বসাল তা আপনার কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
১০ ডিসেম্বর কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে এক ঐতিহাসিক জয় পেয়ে সেমিতে উত্তীর্ণ হয় মরক্কো। সেসময়ে নাসের ছিলেন স্পেনে, সৌদির অনূর্ধ্ব ১৫ ফুটবল দলের সাথে। টেলিভিশনের পর্দায় এই বিজয় দেখে 'গর্বিত পিতার' মতো আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন তিনি।
সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ননা করে বলেন, 'আমার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল। ফুটবলার এবং কোচদের এই আমূল পরিবর্তন ছিল অসাধারণ! তারা দারুণ বুদ্ধিমত্তা ও বেশ সংহতির সঙ্গে খেলেছে। আর যখন আমি একাডেমির খেলোয়াড় ইউসেফ এন-নেসিরিকে গোল করতে দেখেলাম, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি।'
মরক্কোর জাতীয় ফুটবল দলের এই আমূল পরিবর্তনের ইতিহাসটা বোধহয় নাসেরই সবচেয়ে ভালো করে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তার বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে আরও অন্যান্য কিছু দেশের উদীয়মান দলের জন্য নীলনকশা করেছেন তিনি।
এই কাজে পাস করতে গেলে প্রয়োজন তার মতো একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি হবেন মেধাবী এবং যত্ন সহকারে কাজ করে যাওয়ায় হবেন নিরলস ও নিবেদিত। থাকতে হবে ধৈর্য্য। কারণ প্রত্যেক উদীয়মান ফুটবলারের যত্ন নিতে হবে ঠিক একটি ফুলের মতো। নিবিড় যত্নে রেখে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে ফুল ফোটার।
শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালে।
স্মৃতিচারণ করে নাসের বলেন, 'মরক্কোর সুলতানের অনুপ্রেরণাতেই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। খেলাধূলায় তার প্রবল আগ্রহ ছিল। আমাদের দল যে আফ্রিকান কাপ অব নেশনস (আফকন)-এ খেলার বাছাইপর্বে প্রায় উত্তীর্ণ হতো না - এ বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন। তাই সিদ্ধান্ত নেন, খেলাওয়াড়দের দক্ষতা বাড়ানোর দিকেই আগে মনোনিবেশ করতে হবে।'
এই প্রকল্পের দায়িত্ব পড়ে নাসেরের ওপর। একাডেমি তৈরি হতে দুই বছর লেগে যায়। এরপর সম্ভাবনাময় এবং সেরা খেলোয়াড়দের খুঁজে পেতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে থাকেন তিনি।
২০০৯ সালে একাডেমি এই খেলোয়াড়দের প্রথম প্রজন্ম পেয়ে যায়। এই দলে এন-নাসিরি, আজাদিনে ওউনাহি, নায়েফ আগুয়ের্ড, আহমদ রেদা তাগনাউতি ছিলেন, যারা এখন জাতীয় দলটির হয়ে খেলছেন।
এই প্রাথমিক দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য কিছু মানদণ্ড ছিল আবশ্যক: ফুটবলের পাশাপাশি স্কুলের পড়াশোনায় ভালো করাও ছিল শর্ত। খেলায় ভালো হয়েও অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স শর্তানুযায়ী না হওয়ায় কিছু কিশোর এ প্রজন্মে সুযোগ পাননি। শুধু তা-ই নয়, কোচদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটিকেও কম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনটা কেন?
এক্ষেত্রে নাসেরের দর্শন একেবারে সরল! তার ভাষায়, 'ভালো খেলোয়াড় পেতে হলে প্রয়োজন অত্যন্ত ভালো কোচের, সেই সাথে প্রয়োজন ভালো শিক্ষকের।'
'আমরা চেয়েছিলাম তরুণ খেলোয়ারদের সার্বিক বিকাশে অ্যাকাডেমি যেন খেলা থেকে শুরু করে সামাজিক এবং পড়াশোনাসহ সবদিক বিবেচনা করে। এটি এমন এক স্থান হবে যেখানে ফুটবলের পাশাপাশি চলবে পড়াশোনা,' বলেন নাসের।
অ্যাকাডেমির মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় পর্যায়ে দারুণ সব ফুটবলার তৈরি করা। সেই সাথে অনূর্ধ্ব ১৭, অনূর্ধ্ব ২০ এবং অলিম্পিক দলের জন্যেও খেলোয়াড় তৈরি করা।
প্রত্যেক দফায় ১২ বছর বয়সী নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীকে নেওয়া হতো। তারা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত অ্যাকাডেমিতে থাকতে পারত।
অনূর্ধ্ব ১২'দের জন্যেও ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। তাদের জন্য মরক্কেশ, ক্যাসাব্লাঙ্কা, ফেজ এবং টাঙ্গিয়ার - এই চারটি স্থানে চারটি মিনি-সেন্টার নির্মাণ করেন নাসের। তিনি জানান, 'এই সেন্টারগুলোতে আমরা নয় থেকে ১২ বছর বয়সীদের প্রস্তুত করি, তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিই। তাদের মধ্যে সেরাদের অ্যাকাডেমিতে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়।'
অ্যাকাডেমি ঠিকঠাকভাবে দাঁড় করানোর পর নাসের হার্ভে রেনার্ডকে (সৌদি আরবের জাতীয় ফুটবল দলের বর্তমান প্রধান কোচ) প্রকল্পটিতে যুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এতে সাড়া দেন রেনার্ড।
নাসের এরপর ওয়ালিদ রেগরাগুইকে কোচিং স্টাফে নিয়ে আসেন। শুধু মরক্কোই নয়, যেসব ইউরোপীয় দেশে মরোক্কান বংশোদ্ভূত পরিবার রয়েছে, সেখানেও যেতে ভোলেননি নাসের। ভালো এবং সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের সন্ধান মিললেই তাদের মরক্কোর জাতীয় দলে খেলতে রাজি করান তিনি।
আশরাফ হাকিমিও তাদের একজন। হাকিমি মরোক্কান বংশোদ্ভূত হলেও জন্ম নিয়েছিলন স্পেনের মাদ্রিদ শহরে। তাকেও নাসেরই বাছাই করেন। তবে স্পেন নাকি মরক্কোর হয়ে খেলবেন - এ নিয়ে কিছুটা সংশয়ে ছিলেন হাকিমি, অবশেষে জিনেদিন জিদান এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেন এবং হাকিমি নিজের মাতৃভূমিকেই বেছে নেন।
এছাড়াও সোফিয়ান আমরসবাত, নৌসের মাজরাউইকেও মরক্কোর জাতীয় দলে খেলতে রাজি করান নাসের, যাদের দুজনেরই জন্ম নেদারল্যান্ডসে। ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া সোফিয়ান বুফালকেও নাসেরই ইতিহাস গড়া এ দলের জন্য বাছাই করেছিলেন। বর্তমান মরক্কো দলে নাসের লারগুয়েতের অবদান সত্যিই অতুলনীয়!
ফুটবল বিশ্ব আফ্রিকান দল এবং কোচদের যেভাবে দেখত, তাতে এবারের বিশ্বকাপে তাদের পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলবে বলে নিশ্চিত নাসের। তিনি বলেন, 'খেলোয়াড় এবং কোচেরা এই সম্মান-মর্যাদা অর্জন করে নিয়েছেন। বিশ্ববাসী দেখতে পারছে, আফ্রিকান দল এগিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব বলে কিছু নেই - আফ্রিকাল ফুটবল এবং আরব বিশ্বকে এমনটাই জানান দিচ্ছে এবারের আসরে মরক্কোর অবস্থান। এটি অনুসরণ করার মতো একটি দৃষ্টান্ত।'
মরক্কোর জাতীয় ফুটবল দল নিয়ে গর্বিত পুরো দেশবাসী। তবে সবচেয়ে বেশি গর্বিত বোধহয় নাসের নিজেই। কারণ এ দলের গোড়াপত্তনকারী যে তিনিই!