আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় ভক্ত বাংলাদেশিরা ফাইনালের জন্য প্রস্তুত
ঢাকার বাসিন্দা আদনান ইমাম আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের বিশাল ভক্ত। রবিবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার প্রস্তুতি হিসেবে তিনি খানিকটা কুসংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এই ২৬ বছর বয়সী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার যদিও কোনো ভাগ্য বা ঐশ্বরিক সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করেন না, তারপরেও তিনি মনে করেন আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনার জার্সি পরা দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে।
"নতুন জার্সি পরার পর আর্জেন্টিনা সৌদিদের বিরুদ্ধে হেরে গিয়েছে। তারপর থেকে আমি একটি পুরনো জার্সি পরছি, আর আর্জেন্টিনাও তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে," আল জাজিরাকে জানান তিনি।
অন্যদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এক স্থানীয় মাজারে শুক্রবারে নামাজের পর এক বিশেষ মিলাদের আয়জন করেন রোহান আহমেদ। তার সাথে যোগ দিয়েছে আরও কয়েক ডজন আর্জেন্টিনা ভক্ত। "আর্জেন্টিনা যদি বিশ্বকাপ জেতে, তাহলে আমি দুটো গরু কুরবানি দিয়ে 'মেজবান'-এর আয়োজন করবো," বলে জানান ৩৯ বছর বয়সী আহমেদ।
আহমেদ আর ইমামের মতো সমর্থকদের আর্জেন্টিনার প্রতি এই ভালোবাসা সবাই জানলেও এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই। তাদের দেশ আর্জেন্টিনা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক-কূটনীতিক সম্পর্কও খুব দুর্বল।
তবে, ফুটবল কোনো দেশের সীমানার কাঁটাতারে আটকা পড়ে না। আর দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির জন্য তা আরও বেশি সত্যি, যেখানে দেশটির ১৭ কোটি মানুষের বড় একটি অংশ চার বছর পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আর্জেন্টাইনে পরিণত হয়। আকাশী নীল-সাদা জার্সি পরে তারা আর্জেন্টাইনদের মরোই আর্জেন্টিনা ফুটবল দল আর তাদের খেলোয়াড়দেরকে সমর্থন করতে নেমে পড়ে।
বৈশ্বিক স্বীকৃতি
আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশিদের এই ভালোবাসার বয়স কম করে হলেও চার দশক। তবে এই প্রথমবার তারা পুরো বিশ্বের নজর কেড়েছে। মেসির গোলের পর বাংলাদেশিদের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের ভিডিও ফিফা টুইট করার পর সারা ফুটবল বিশ্ব আর্জেন্টিনা নিয়ে বাংলাদেশের উন্মাদনা নিয়ে জানতে পেরেছে, গ্যারি লিনেকারের মতো ফুটবল তারকাও আশ্চর্য হয়েছে বাংলাদেশিদের এই ভালোবাসা দেখে।
আর্জেন্টিনা থেকে বহুদূরের এই ছোট্ট দেশে বাংলাদেশিদের এই উন্মাদনাও নজর কেড়েছে আর্জেন্টাইন ফুটবল দর্শকদের। তারাও চেয়েছে বাংলাদেশিদেরকে এই ভালোবাসা ফেরত দেওয়ার। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে তারাও খুলে ফেলেছে এক ফেসবুক গ্রুপ, দুই সপ্তাহের মধ্যেই যার সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুই লক্ষ।
তবে এর চেয়েও চমকপ্রদ বিষয় হলো আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো কাফিয়েরো টুইট করে জানিয়েছেন ১৯৭৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার দূতাবাস পুনরায় চালু করার ব্যবস্থা নেবেন।
"খুবই ভালো লাগে যখন আর্জেন্টাইন জনগণ জানতে পারে যে আমরা মেসি আর আর্জেন্টিনা ফুটবল দল নিয়ে কতটা পাগল," বাংলাদেশিদের নিয়ে তৈরি এক ফুটবল গ্রুপের মোডারেটোর সিফাত মেহেদি আল জাজিরাকে জানান। বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রচুর ফেসবুক গ্রুপ থাকলেও এই গ্রুপটিই সবচেয়ে বড়, যাতে রয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ সদস্য।
"হ্যাঁ, আমাদের দেশের ফিফা র্যাংকিং হয়তো ১৯২, তবে আমাদের জনগণ ফুটবল সমর্থক হিসেবে কারোর চেয়ে কম নয়। যদিও তারা চার বছর পরপর ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা দেখায়, কারণ এই উন্মাদনা বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরেই।"
মেহেদি জানান সামাজিক মাধ্যম বাংলাদেশের এই ফুটবল সমর্থনকে বিশ্বদরবারে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে: "এই সময়ে, যেকোনো পোস্ট বা ভিডিও ভাইরাল হতে পারে। আপনি কখনোই জানবেন না। আমার মনে হয় না বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা বা পুরো বিশ্বের নজড় কাড়তো না, যদি না ফিফা ঐ ভিডিওটি টুইট করতো, অন্তত এই পরিমাণে। তবে বাংলাদেশিরা ১৯৮৬-এর ম্যারাডোনার জাদু দেখেই আর্জেন্টিনা সমর্থন শুরু করেছে।"
পেলে আর ম্যারাডোনার মতো ফুটবল কিংবদন্তির নাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শোনা যায়। কাতারে থাকা বাংলাদেশিরাও পেলের ব্রাজিল আর ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে সমর্থন জানাতে ভিড় করেছেন।
'এম' ফ্যাক্টর
সাংবাদিক সাইদ ফাইজ আহমেদ জানান, আশির দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে যখন টিভি ঘরে ঘরে ব্যবহার হওয়া শুরু হয়, এবং বেশিরভাগ বাংলাদেশিই তাদের প্রথম বিশ্বকাপ দেখে ১৯৮৬ সালে: "১৯৮৬ বিশ্বকাপ এক নতুন সুপারহিরোর জন্ম দেয়, ডিয়েগো ম্যারাডোনা। জনগণ এরকমই একজন সুপারহিরো খুঁজছিলো আর আর্জেন্টাইন মায়েস্ত্রো সেই আশাই পূরণ করলেন।" তারপর থেকে আর্জেন্টিনা কোনো বিশ্বকাপ না জিতলেও আর্জেন্টিনা বা ম্যারাডোনার প্রতি বাংলাদেশিদের ভালোবাসা তারপর থেকে একবিন্দু কমেনি। বরং মেসি আসার পর থেকে আরও বেড়ে গিয়েছে।
ধারাভাষ্যকার শাহনূর রব্বানী আল-জাজিরাকে জানান, "সমর্থন আরও বাড়ার কারণ মানুষজন এখন সারাবছর ধরে ক্লাব ফুটবল অনুসরণ করতে পারে। একইসাথে মেসির মতো তারকা খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যম থেকে জানতে পারে।"
আপনি মেসির খেলার প্রেমে না পড়ে থাকতে পারেন না। সে তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলোয়াড়। আর তার বিশ্বকাপ না জেতা মানে ফুটবলের ক্ষতি হওয়া।"
সূত্র: আল জাজিরা