ব্রাজিলিয়ানরা কেন বিখ্যাত হলুদ জার্সি পরা ছেড়ে দিচ্ছেন?
হিগোর রামালহো মনেপ্রাণে একজন ফুটবল ভক্ত। ব্রাজিলে করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রান্ত বিধিনিষেধ অনেকটাই শিথিল হয়ে আসায় আবারও খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন রামালহো; কারণ সামনেই ফুটবল বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের চিরাচরিত হলুদ রঙয়ের একখানা জার্সি তারও রয়েছে, শেষবার এই জার্সিটি তিনি পরেছিলেন ২০১৮ সালে। কিন্তু রামালহো জানেন না, এরপরে আবার কবে তিনি এই জার্সি পরার সুযোগ পাবেন!
ব্রাজিলিয়ানরা তাদের বিখ্যাত হলুদ জার্সি পরছেন না- এই মুহূর্তে এর চাইতে অদ্ভুত কথা হয়তো আর কিছুই মনে হবে না!
৩৩ বছর বয়সী রামালহোর ভাষ্যে, "এই হলুদ জার্সি আমার জন্য এক গর্বের প্রতীক ছিল। এটা আমাদের জয়ের প্রতীক ছিল। শুধুমাত্র ম্যাচ দেখার সময়েই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও আমি প্রায়ই এটা পরতাম। কিন্তু এখন রাজনৈতিক কারণে এই জার্সি পরা বন্ধ করে দিয়েছি।
"বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং তার সমর্থকরা ব্রাজিলের হলুদ জার্সিকে একটি রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনে এবং নিজেদের দলের প্রতীকে পরিণত করেছে। যেহেতু আমি ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন করি না, তাই হলুদ জার্সি গায়ে দিলে আমাকেও লোকে তাদের একজন ভাবতে পারে বিধায় আমি সেটা পরি না।"
ফুটবলের মাঠে ব্রাজিলের অসংখ্য বীরত্বগাঁথার সাক্ষী হলুদ জার্সি 'কানারিনহো জার্সি' নামেও পরিচিত। কিন্তু একদম শুরু থেকেই এটি ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি ছিল না। এটি প্রথম নকশা করা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনালে মারাকানায় উরুগুয়ের কাছে হেরে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গের তিন বছর পর হলুদ জার্সিটি নকশা করা হয়। সেদিনের ফাইনালে ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের পরনে ছিল সাদা রঙয়ের জার্সি।
ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল গভর্নিং বডি এবং একটি সংবাদপত্র যৌথভাবে ব্রাজিল জাতীয় ফুটবলের জার্সির নকশা করার প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিল। শর্ত ছিল, নতুন জার্সিতে জাতীয় পতাকার একটি রঙ থাকতে হবে, কারণ তখনকার জার্সিতে 'ব্রাজিলিয়ান নাগরিকত্বের পরিচয় দেয়' এমন কোনো রঙ ছিল না। প্রতিযোগিতায় ৩০০টি জার্সি জমা পড়ে এবং বিজয়ী হয় আলদির গার্সিয়া শিলির তৈরি জার্সির নকশা।
এরপরে বহু বছর ধরে ব্রাজিলের অগণিত ম্যাচের সঙ্গী হয়েছে হলুদ জার্সি, ফুটবলের ইতিহাসে রেকর্ড পাঁচবার বিশ্বকাপ ও দুইবার কোপা আমেরিকা জিতেছে ব্রাজিল; সেই সাথে হলুদ জার্সি হয়ে উঠেছে ব্রাজিল সমর্থকদের আশা-স্বপ্ন ও ঐক্যের প্রতীক।
কিংবদন্তি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার পেলের ১০ নম্বর জার্সি, বিশ্বকাপ জয়ের সময় রোনাল্ডোর ৯ নম্বর জার্সি এবং ১৯৯৪ বিশ্বকাপে রোমারিওর ১১ নম্বর জার্সি... সবগুলোই ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় ব্রাজিলের সফলতা ও সমৃদ্ধির সাক্ষী হয়ে আছে।
কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো এবং তার সমর্থকরা ফুটবলের মাঠ থেকে হলুদ জার্সিকে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনে রূপ দেওয়ায় বহু ভক্ত এই জার্সি ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, যে ঐক্য ব্রাজিলের জাতীয় দল এবং ব্রাজিলকে বিখ্যাত বানিয়েছে, সেগুলোর বিরোধীতা করতে ব্রাজিল ফুটবলের সেই একই বিখ্যাত জিনিসগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
২৫ বছর বয়সী ইসাবেলা গুয়েদেস আল-জাজিরাকে বলেন, "ফুটবল ব্রাজিলের জন্য খুব বিশেষ কিছু, বেশিরভাগ সময় এই ফুটবলের কারণেই সবাই একত্রিত হই, এক কাতারে এসে দাঁড়াই। যখন তারা (ডানপন্থী সমর্থকরা) দেশের জন্য অর্থবহ এমন কোনোকিছুকে যখন তারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে, তখন মনে হয় যেন আমাদের কাছ থেকে এটা চুরি করে নিচ্ছে তারা! আমি চাই না বিশ্বকাপের সময় আমার জানালার কাছে একটা পতাকা ঝুলতে থাকুক, কারণ এর ফলে লোকে আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পাবে।"
"তারা আমাদের পতাকা আর হলুদ জার্সি কেড়ে নিয়েছে এবং সেগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতীক বানিয়েছে", এই বলে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইসাবেলা।
তবে জার্সিকে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বলসোনারো সরকারই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৭০ সালে ব্রাজিলে সামরিক স্বৈরশাসনের সময় দেশের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় ফুটবলে দলের ইমেজ ব্যবহার করা রাজনৈতিক কাজে, জানান রিও ডি জেনেইরো স্টেট ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি অব মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্টস স্টাডিজের একজন গবেষক ক্যারোলিনা ফন্তেনেল্লা।
১৯৭০-এর মেক্সিকো বিশ্বকাপকে সামনে রেখে জাতীয় দলের কোচকে চাকরিচ্যুত করার পেছনেও ব্রাজিলের তৎকালীন সামরিক নেতা জেনারেল মেডিচির ভূমিকা ছিল। ফন্তেনেল্লা বলেন, স্বার্থলোভীদের এসব প্রচেষ্টা এবং তার প্রতিহত করা, সব মিলিয়ে সময়ের সাথে সাথে হলুদ জার্সির সঙ্গে ব্রাজিলিয়ানদের একটি অন্যরকম শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হয়।
ফন্তেনেল্লা বলেন, "তখন থেকেই হলুদ জার্সিকে একটি প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ গর্বের সাথে এই জার্সি পরিধান করে, কারণ এতে মনে হয় তাদের নিজেদের একটা আলাদা সম্প্রদায় আছে।"
২০১৩ সালে ব্রাজিলে জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি, দুর্নীতি এবং পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদ করা নিয়ে দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার পর হলুদ জার্সি আরও একবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফন্তেনেল্লা বলেন, "এই দাঙ্গায় যারা অংশ নিয়েছিলেন তারাও এই জার্সি পরা ছিলেন।
২০১৪ বিশ্বকাপে প্রচুর অর্থ ব্যয় করাসহ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ করছিল মানুষ। ২০১৮ সালে আমরা দেখলাম যে রক্ষণশীল সমর্থকরা এই জার্সি পরতে শুরু করেছে। এটা দেখার পর যারা বলসোনারোর দলের সমর্থক ছিল না, তারা লজ্জা বোধ করে। একটা রাজনৈতিক দল যারা কিনা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়না, তারা যখন হলুদ জার্সি ব্যবহার করতে শুরু করলো, তখন জার্সির সত্যিকার মাহাত্ম্য হারিয়ে গেল।"
"২০১৪ সালের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ব্রাজিলিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী এসিও নেভিস ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার রঙ 'হাইজ্যাক' করেন!", যোগ করেন তিনি ।
হ্যাশট্যাগ গিভ ব্যাক আওয়ার ফ্ল্যাগ
মাত্র বছর দুয়েক আগে লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জোয়াও কার্লোস আসুম্পসাও ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল পরিষদের কাছে ব্রাজিলের হলুদ জার্সি বিলুপ্ত ঘোষণা করে সাদা-নীল জার্সি ফিরিয়ে আনার দাবি করে একটি ক্যাম্পেইন চালান।
সেসময় আসুম্পসাও বলেছিলেন, "আমরা একটা ভয়ঙ্কর সরকারের সাথে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছি, যে সরকার আমাদের জাতীয় পতাকা চুরি করেছে!"
'হ্যাশট্যাগ গিভ ব্যাক আওয়ার ফ্ল্যাগ' বা 'আমাদের পতাকা ফিরিয়ে দিন' আন্দোলন বেশকিছু রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন পেয়েছিল।
সাও পাওলোর মিউজিয়াম অব ফুটবলের লাইব্রেরিয়ান ও ঐতিহাসিক আদেমির তাকারা বলেন, "ফুটবল সবার জন্য। যারা বর্ণবাদ, যৌনতা, পুরুষতন্ত্র ও বৈষম্যকে প্রচার করে, তারা এই হলুদ জার্সি ব্যবহার করুক সেটা আমার পছন্দ না।
"এই জার্সি ওই নেতিবাচক বিষয়গুলোর ঠিক উল্টোটা দেখায়। এই জার্সি আমাদের ঐক্যের প্রতীক, কিন্তু বর্তমানে এটি সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ব্রাজিলের মানুষ ও হলুদ জার্সির মধ্যে একটা ভালোবাসার ও মায়ার সম্পর্ক আছে- ফুটবল নামক সুন্দর খেলাটা যা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে তা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।"
"২০১৩ সাল থেকে হলুদ জার্সি অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে যা আগে কখনো ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের ঐকমত্যে আসার জন্য কিছু একটার প্রয়োজন ছিল, আর হলুদ জার্সি ছিল এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ ও শক্তিশালী উপায়", বলেন এই ঐতিহাসিক।
এদিকে চলতি মাসের শুরুতে প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর হাজার হাজার সমর্থক অক্টোবরের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে রিও ডি জেনেইরোর কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতে জড়ো হয়। তাদের অনেকেরই পরনে ছিল জাতীয় দলের হলুদ জার্সি।
ব্রাজিলের স্বাধীনতা দিবসে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা টুইটার পোস্ট লেখেন, "৭ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের জন্য ভালোবাসা ও একতার দিন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে আর তা হচ্ছে না। আমার বিশ্বাস, ব্রাজিল তার পতাকা, সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে।"
ব্রাজিলের হলুদ জার্সির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে ফুটবলভক্ত মারিনা মোরেনো জানান, হলুদ জার্সিকে বর্তমান সরকারের প্রতীক হয়ে উঠতে দেখে তিনি ভীষণ হতাশ।
"বর্তমানে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ও তার সমর্থকদের থেকে এই জার্সিকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা দেখলে আপনাআপনিই হতাশা চলে আসে। আমি বর্তমান সরকারকে সমর্থন করি না এবং আমি চাই না কেউ আমাকে তাদের সমর্থক ভাবুক, সেজন্যেই আমি আর হলুদ জার্সি পরি না।"
সূত্র: আল-জাজিরা