প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া খেলাধুলার সরঞ্জাম
সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ছোঁয়া লেগেছে সবকিছুতেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে বিনোদনের খোরাক খেলাধুলায়ও বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে নানা প্রযুক্তি। আর এই খেলাধুলাকে আরও বেশি আনন্দদায়ক করতে এবং খেলার ফলাফলে আরও বেশি সূক্ষ্মতা আনতে তৈরি করা হয়েছে প্রযুক্তি নির্ভর নানা যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতির সহায়তায় খেলাধুলা সম্পর্কিত যেসব তথ্য আরও কয়েক দশক আগেও ভাবনার বাইরে ছিল সেগুলোও আজ এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়।
আল রিহলা
কাতার বিশ্বকাপে যে বলটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটির নাম আল রিহলা। পূর্ববর্তী সকল বিশ্বকাপ বলের চেয়ে এই বলটি একটু ভিন্ন, প্রযুক্তিতে সকল বলের চেয়ে উন্নত। কেননা আসরে ব্যবহৃত আল রিহলা নামের প্রতিটি বলে কাইনেক্স অন কোম্পানির সহায়তার এডিডাসের সাসপেন্সন সিস্টেম ব্যবহার করে ৫০০ হার্জের মোশন সেন্সর লাগানো আছে। যার ফলে বিশ্বকাপে আল রিহলার প্রতিটি বল যখন মাঠে ব্যবহৃত হয় তখন বলের অস্পষ্ট গতিবিধি সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করা যায়।
বলটির সেকেন্ডে প্রায় ৫০০ বার তথ্য পাঠাতে পারে বলে ভিডিও ম্যাচ অফিসিয়ালের পক্ষে অফসাইড থেকে শুরু করে বলের সূক্ষ্মতর সব গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। তবে বলে প্রযুক্তিটি এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, এসব তথ্য সংরক্ষণ করতে যেয়ে বলের স্বাভাবিক গতিবিধিতে কোন পরিবর্তন ঘটে না। প্রতিটি বলে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি স্থাপন করা আছে যেগুলো আবেশের মাধ্যমে চার্জ দেওয়া যায়।
চলতি ফুটবল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে উরুগুয়ে বনাম পর্তুগালের ম্যাচে সতীর্থ ব্রুনোর পাসে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। কেননা রোনালদোর পক্ষ থেকে বলটি তার মাথায় খুব সূক্ষ্মভাবে স্পর্শ করেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আল রিহলা নামের বলটিতে স্থাপণকৃত প্রযুক্তির সাহায্য জানা যায় যে, বলটি রোনালদোর মাথায় স্পর্শ না করেই প্রতিপক্ষের জালে ঢুকেছে।
গলফ সুইং এনালাইজার
গলফ খেলায় গলফার ক্লাবের মাধ্যমে একটি বলকে আঘাত করে দূরবর্তী নির্দিষ্ট স্থানে পাঠায়। আর এক্ষেত্রে প্রতিটি বল আঘাতের ক্ষেত্রে গলফ ক্লাবের গতি ও ঘূর্ণন এবং শারীরিক অবস্থান সঠিক থাকতে হয়। কিন্ত কিছুদিন আগেও প্রতিটি শটের আগে এসব তথ্য পাওয়া এবং সেগুলো পর্যালোচনা করা একজন গলফারের জন্য সম্ভব ছিল না। ঠিক এইসব অসম্ভব তথ্যগুলোকেই হাতের নাগালে আনতে পেরছে গলফ সুইং এনালাইজার।
যন্ত্রটি মূলত একজন গলফারের খেলার সময় গ্লাভসের উপর প্রান্তে স্থাপন করা থাকে। যন্ত্রে একটি সেন্সর লাগানো থাকে যেটি দুইটি এক্সেলরোমিটার ও দুইটি গাইরোস্কপের সমন্বয়ে গঠিত। যন্ত্রটি ব্লুটুথের মাধ্যমে একটি স্মার্টফোনের সাথে সংযুক্ত থাকে। পরবর্তীতে প্রতিটি শটের পর স্মার্টফোনে থাকা গলফ সুইং এনালাইজার অ্যাপসে গলফ ক্লাবের স্পীড ও কম্পন এবং হাত ও শরীরের অবস্থানের সকল তথ্য দেখা যায়।
বাস্কেটবলে সংযুক্ত উইলসন এক্স
ফুটবলের ন্যায় বাস্কেটবল খেলাতেও ফলাফলে সূক্ষ্মতা আনতে বলের গতিবিধি এবং প্রতিটি শুটের সূক্ষ্মতর তথ্য প্রয়োজন হয়। আর সেই কাজটিই মূলত করে থাকে উইলসন এক্স প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তিটি বাস্কেটবলকে একটি স্মার্ট বাস্কেটবলে রুপান্তর করে যা ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে স্মার্টফোনের সাথে সংযুক্ত থাকে।
স্মার্ট বাস্কেটবলটি দিয়ে যখন মাঠে খেলা হয় তখন বলটির মধ্য থাকা উন্নত প্রযুক্তির সেন্সর বলটির গতিবিধি এবং প্রতিটি থ্রো এর তথ্য নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ করে। একইসাথে সংরক্ষণকৃত যাবতীয় তথ্যগুলো ব্লুটুথের মাধ্যমে সংযুক্ত স্মার্টফোনে প্রেরণ করে। এতে একদিকে খেলার ফলাফল নির্ণয়ে কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তথ্যগুলো ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে কোনো দল বা খেলোয়াড় তথ্যগুলো থেকে নিজেদের ভুল, ত্রুটি পর্যালোচনা করে তা সংশোধনও করতে পারে।
লাইট আপ স্ট্যাম্প
আগে ক্রিকেট ষ্ট্যাম্পে যখন লাইট আপ প্রযুক্তি ছিল না তখন আউটের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আম্পায়ারকে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হতো। কেননা রান আউট থেকে শুরু করে ষ্ট্যাম্পিং এর ক্ষেত্রে ব্যাটার আউট না-কি নট আউট সেই ফলাফল মিলিসেকেন্ডের ব্যবধানে পরিবর্তন হতে পারে। আর এই সমস্যা সমাধানে অস্ট্রেলিয়ান বিজনেস জিং ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি জিং ফর শট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্রিকেটের স্ট্যাম্পকে এলইডিতে ষ্ট্যাম্পে রুপান্তর করে।
ক্রিকেট একটি আউটের ক্ষেত্রে মিলিসেকেন্ডের যে বিড়ম্বনা সেটিকেই সমাধান করে লাইট আপ ষ্ট্যাম্প। এ প্রযুক্তিতে বল যখন সম্পূর্ণভাবে স্ট্যাম্পে টাচ করে ঠিক ঐ সময়েই স্ট্যাম্প ও বেলের বাতি জ্বলে উঠে। এ প্রযুক্তিতে বল স্পর্শের ১০০০ ভাগের ১ ভাগ সময়ের মাঝে বাতিটি জ্বলে বলে খুব সহজেই আম্পায়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে বলটি ঠিক কোন সময়ে স্ট্যাম্পকে টাচ করেছে। যার ফলে বর্তমানে রান আউট ও স্ট্যাম্পিং এর সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া আম্পায়ারদের জন্য অনেক সহজ হয়ে গেছে।
যখন খেলাধুলায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার কম ছিল তখন খেলার ফলাফল নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হতো। কিন্তু বর্তমানে খেলাধুলা এতটাই প্রযুক্তি ভিত্তিক যন্ত্র নির্ভর হয়ে যাচ্ছে যে, খেলার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করার খুব বেশি সুযোগ থাকবে না। কেননা মানুষ পক্ষপাতিত্ব করতে পারে কিন্তু যন্ত্র পক্ষপাতিত্ব করে না। একইসাথে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজ দল ও প্রতিপক্ষ দলের খেলাধুলার ধরণ সম্পর্কেও প্রচুর তথ্য বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে খেলাধুলা হচ্ছে আরও নিরপেক্ষ এবং আরও বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ।