যেভাবে খেলাধুলার ‘খেলা বদলে দিয়েছে’ প্রযুক্তি
আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমূল বদলে গেছে খেলাধুলা। প্রযুক্তির কল্যাণে অ্যাথলেটদের খেলার ধরন আর দর্শকের খেলা উপভোগ; দুটোর ক্ষেত্রেই এসেছে পরিবর্তন। তবে ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব এখন আর কেবল খেলা ও খেলা সম্প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
নতুন নতুন উদ্ভাবন- বিশেষত ডেটা প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেন্সর ও কম্পিউটার প্রযুক্তি একজন অ্যাথলেটের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে খেলার কৌশলেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। এ লেখায় জেনে নেওয়া যাক খেলাধুলায় ব্যবহৃত এমন কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি এবং সেগুলো কীভাবে এসব খেলাকে নতুন রূপ দিতে সাহায্য করেছে সেসবের কথা।
যে ৪ উপায়ে খেলা উপভোগের অভিজ্ঞতাকে বদলে দিয়েছে প্রযুক্তি
অফ-ফিল্ড রুল থেকে শুরু করে খেলোয়াড়ের হৃৎস্পন্দন মাপা; বর্তমানে সবকিছুই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তির কারণে পেশাদার ক্রীড়াগুলোর দর্শক যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনিভাবে এটি ক্রীড়ায় প্রতিযোগিতার হার বৃদ্ধি, ভক্তদের মধ্যে সম্পর্ককে আরও নিবিড়করণ, ও সবার জন্য খেলাধুলাকে আরও নিরাপদ করে তুলেছে।
পারফরম্যান্সের বিশ্লেষণ
খেলাধুলায় প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় অবদানটি হলো নতুন নতুন টুল ব্যবহার করে অ্যাথলেটদের নিজেদের আরও সেরায় পরিণত করতে সক্ষম করে তোলা।
১৯৮০-এর দশকে ভিডিও ক্যামেরা সহজলভ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে কোচেরা তাদের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ভিডিও করে ও পরে পুনরায় বিশ্লেষণ করার সুযোগ পান। আধুনিককালে কোচ বা প্রশিক্ষকদের জন্য ভিডিও ক্যামেরার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
অ্যাথলেটিক্স, সাইক্লিং, স্কিইয়িং, ববস্লেজিং, ট্রাইঅ্যাথলনসহ আরও অনেক খেলায় বর্তমানে খেলোয়াড়দের সময়ের হিসেব রাখার জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রনিক সময় ব্যবস্থা ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি দ্বারা অ্যাথলেটিক্সে খেলোয়াড়ের প্রতিক্রিয়ার সময়ও মাপা হয়।
প্রযুক্তির ক্রমাগত অগ্রগতির কারণে এখন অনেক বেশি তথ্য মানুষের হাতের নাগালে। এ তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট, ও ভক্তরা আরও শ্রেয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। বিশ্লেষণধর্মী তথ্য ও উপাত্তের সাহায্যে দলগুলো নিজেদেরকে আরও বেশি সমন্বিত করে তুলতে পারে। একই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষকদের এখন খেলার পরিকল্পনা সাজানোর জন্য আর অনুমান ও অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
যথাযথ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত
যেকোনো খেলা চলমান অবস্থায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন চ্যালেঞ্জিং তেমনিভাবে এতে মানবিক ভুল হওয়ারও প্রচুর সম্ভাবনা থাকে। তবে উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে এখন এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলের বিভিন্ন লিগে সিদ্ধান্ত রিভিউ করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভিডিও অ্যাসিসটেন্ট রেফারি তথা ভিএআর প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে। এখন মাঠের বাইরে থাকা কর্মকর্তারা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেফারির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।
গোল হওয়া নিশ্চিত করা, পেনাল্টি দেওয়া হবে কি না তা নির্ধারণ করা, কোনো ফাউলের জন্য লাল নাকি হলুদ কার্ড দেখানো হবে তা ঠিক করা; এসব কাজের কর্তৃত্ব রয়েছে মাঠের বাইরে থাকা এ কর্মকর্তাদের কাছে।
ক্রিকেট বলের গতিপথ দেখার জন্য 'হক-আই' প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ২০০১ সালে। এ প্রযুক্তি খেলার ফলাফলে বৃহৎ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
হক-আই প্রযুক্তিতে অনেকগুলো পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করা হয়। এসব বিশ্লেষণের মধ্যে রয়েছে বলের গতি, উইকেটে বলের পিচ, মাটি থেকে ঠিকরে ওঠার সময় বলের পথ ইত্যাদি। বর্তমানে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেনিসের শট বাইরে নাকি ভেতরে তা নির্ধারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি, হক-আই প্রযুক্তি দর্শকদেরও খেলার নিয়মকানুন বুঝতে সাহায্য করেছে।
২০১৪ সালে অফ-ফিল্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে রিভিউ করার সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩ করেছিল মেজর লিগ বেসবল (এমএলবি)। এ মৌসুমে আম্পায়ারদের মাইক্রোফোন দেওয়া হয়েছে যাতে তারা অন্য খেলাগুলোর রেফারিদের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে রিপ্লে ঘোষণা করতে পারেন।
অন্যমাত্রায় সরাসরি সম্প্রচার
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এখন খেলাধুলার সম্প্রচার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সর্বাঙ্গীণ হয়েছে। একসময় নির্দিষ্ট কয়েকটি চ্যানেলেই মানুষের খেলা উপভোগ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন দর্শকের সামনে খেলা দেখার অসংখ্য সুযোগ বিরাজমান।
খেলা প্রচার করা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতিতে ডেটা স্থানান্তর করতে পারে।
কেবল একটা স্মার্টফোন দিয়েই দর্শক এখন খেলার সর্বশেষ সংবাদ ও ঘটনা জানতে পারেন। এছাড়া বিশেষ মিডিয়াগুলো এখন এমন সব সম্ভাব্যতা উন্মোচন করছে যা অতীতে চিন্তাও করা যেত না।
আঘাত প্রতিরোধ ও পুনর্বাসন
খেলোয়াড়েরা কঠিন প্রশিক্ষণ ও শক্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান। যদিও তাদের শারীরিক ফিটনেস উচ্চমানের, তাও তারা সবসময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। এমনকি ক্রীড়াবিদদের স্বাস্থ্য স্থায়ীভাবে ভেঙে যেতে পারে।
প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে এখন খেলাধুলায় আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে গেছে। যেমন, আধুনিক প্রস্থেটিক মাউথ গার্ডগুলোতে আঘাতের মাত্রা নিরূপণের জন্য সেন্সর বসানো থাকে। এর ফলে আপাতভাবে সাধারণ সংঘর্ষ মনে হওয়া আঘাতগুলোর ক্ষেত্রেও মারাত্মক কিছু ঘটে যাওয়ার আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।
এছাড়া প্রযুক্তির কারণে বর্তমানে আঘাতের পর খেলোয়াড়দের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও আগের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরীভাবে করা সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিজিটাল মডেলিং প্রয়োগ করে কনুই ও হাতের আঘাতের অনেক দ্রুত ও নিখুঁত চিকিৎসা করা যাচ্ছে।