মোহাম্মদ আলী, টম ব্র্যাডি থেকে শুরু করে লিওনেল মেসি: যেভাবে 'গোট' উপাধির উত্থান ঘটেছে
ক্রীড়া জগতে, বিশেষ করে ফুটবলে এখন সবচেয়ে পরিচিত দুটি শব্দ হলো 'সর্বকালের সেরা', ইংরেজিতে 'গ্রেটেস্ট অব অল টাইম' বা সংক্ষেপে 'গোট'। একবিংশ শতাব্দীতে ফুটবল বিশ্বে কে 'সর্বকালের সেরা' তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসি ও পর্তুগিজ ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সদ্য বিশ্বকাপ জয় করে সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন লিওনেল মেসি। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, সব জায়গায়ই বলা হচ্ছে 'গোট ডিবেট ইজ ওভার!" কিন্তু এই 'গোট' হওয়ার জন্যই কী পুরো ক্যারিয়ারে সংগ্রাম করে গেছেন মেসি? কেন এই উপাধি এত গুরুত্বপূর্ণ? এর আবির্ভাবই বা হলো কিভাবে?
শুরুতেই জানিয়ে রাখি, একবিংশ শতাব্দীর আগপর্যন্ত কোনো খেলোয়াড়ই 'গোট' উপাধি পেতে চাইতেন না! অনেক দশক ধরে 'গোট'কে মনে করা হতো ইংরেজি 'স্কেপগোট' এর সংক্ষিপ্ত রূপ, অর্থাৎ 'বলির পাঁঠা'। আমেরিকার ক্রীড়াঙ্গনে কিছু নাম কুখ্যাত হয়ে আছে, এই যেমন- বিল বাকনার, জ্যাকি স্মিথ, স্কট নরউড, ক্রিস ওয়েবার। যেসব খেলোয়াড়রা বড় ম্যাচে চূড়ান্ত মুহূর্তে কিছু ভুল করতেন, যার ফলে জয় অনিশ্চিত হয়ে পড়তো বা দল হেরে যেত, তাদেরকেই আগে goat বলে আখ্যা দেওয়া হতো। অথচ উল্লিখিত খেলোয়াড়দের কেউই এতটা অসম্মানজনক অবস্থানে ছিলেন না।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে 'গোট' শব্দের অর্থই পুরোপুরি বদলে গেছে। 'গোট' সংস্কৃতি এখন ক্রীড়া জগতে একটি হলমার্ক এবং আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছে। এখন এই উপাধি পাওয়ার জন্যই খেলোয়াড়দের মধ্যে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা- কে কাকে কতভাবে ছাড়িয়ে যেতে পারে সেই পরিসংখ্যানই এখন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যাটা হলো, কে সর্বকালের সেরা তার কখনোই কোনো অবিসংবাদিত উত্তর নেই। সর্বকালের সেরা হওয়ার মানদন্ডও সবার কাছে এক নয়। তাই সত্যবাদীরা যতই যুক্তি দেখাক না কেন, বাকি সবাই যে তার সঙ্গে একমত হবেই এমনটা নয়। কিন্তু কোনো কোনো গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এই 'সর্বকালের সেরা'র বিতর্ককে পুঁজি করে, সমর্থকদের হাতে তাদের ফেভারিটদের জন্য হইহল্লা করার মতো মোক্ষম অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা চমৎকার ক্যারিয়ার গড়ে ফেলেছেন।
এবার কাতার বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে আসা যাক। শুরুতেই বলা হয়েছে ফুটবলের বর্তমান দুই কিংবদন্তি লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর কথা। দুজনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ও একের পর এক অর্জনের জন্যই এতকাল তাদের মধ্যে তুলনা করা হতো; কিন্তু একটিমাত্র অপূর্ণতা ছিল দুজনেরই। আর তা হলো- কাতার বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত তারা কেউই বিশ্বকাপ জেতেননি। তাছাড়া, বয়সের কারণে এবারের বিশ্বকাপই ছিল দুজনের শেষ সুযোগ। মাঠের বাইরের নানা জটিলতাকে এড়িয়ে তাই কাতার বিশ্বকাপে বারবার এসেছে "শেষ পর্যন্ত কে হবেন 'গোট'?"
মাঠের পারফরমেন্স ও ব্যক্তিগত-দলীয় বিতর্ক, সব মিলিয়ে কাতার বিশ্বকাপ রোনালদোর জন্য মোটেও ভালো যায়নি। দল কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পড়েছে, অন্যদিকে রোনালদো নিজেও সব ম্যাচে শুরুর একাদশে থাকতে পারেননি এবং কোনো চোখ ধাঁধানো পারফরমেন্সও দেখাতে পারেননি। কিন্তু এবার আর ভক্তদের নিরাশ করেননি লিওনেল মেসি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদির কাছে হারের ধাক্কা সামনে নিয়েই মেসির দক্ষ নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা পৌছেছে ফাইনালে এবং ফ্রান্সের বিপক্ষে তুমুল লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছে বিশ্বকাপ। অল্পের জন্য কিলিয়ান এমবাপ্পের কাছে গোল্ডেন বুটটা হাতছাড়া হয়ে গেলেও, মেসিই এবার পেয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল। আর তাতে করেই আর্জেন্টাইন সুপারস্টারকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সেনসেশন। কারণ তিনি যে এখন আর শুধুই কিংবদন্তি নন, তিনি নিশ্চিত করেছেন 'গোট' বা সর্বকালের সেরা উপাধি!
কিন্তু 'গোট' তকমা পেতে হবে কিনা সেই চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট করে ফেলার পর্যায় থেকে কিভাবে এই উপাধিই খেলোয়াড়দের প্রিয় হয়ে উঠলো? পাঠক নিশ্চয়ই এটি বিশ্বাস করেন যে ইন্টারনেট যুগ আসার আগেও বহু নামজাদা খেলোয়াড় ছিলেন এবং তারা 'গোট' কিনা তা নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না।
১৯১০-৩০ এর দশকে অলরাউন্ডার বাস্কেটবল খেলোয়াড় জিম থরপে ও বেইব রুথ থেকে শুরু করে আশি ও নব্বইয়ের দশকে আইস হকিতে ওয়েইন গ্রেটজকি এবং বাস্কেটবলে মাইকেল জর্ডান- আমেরিকার ক্রীড়াঙ্গনে বরাবরই কোনো একক ব্যক্তিকে বাকিদের চেয়ে এগিয়ে রাখার ট্রেন্ড ছিল। ফলে আস্তে আস্তে 'গোট' উপাধি হয়ে যায় এমন এক মাপকাঠি যা দিয়ে আগামীর সব ব্যতিক্রমী খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন করা যাবে।
তবে খেলোয়াড়দেরকে 'গোট' উপাধিতে ভূষিত করার উদ্দেশ্য বোঝার আগে আপনাকে অবশ্যই আমেরিকার ক্রীড়াঙ্গনের পূর্বাপর সম্বন্ধ মনে রাখতে হবে। একটি খেলার ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় কে সে বিষয়ে ইএসপিএন প্রোগ্রামিং ক্যালেন্ডার বানিয়ে আলোচনা করার অনেক আগে থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক হয়ে আসছে। গ্রেটজকির ডাকনামই ছিল আসলে 'দ্য গ্রেট ওয়ান'।
কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলীর মতো আর কোনো খেলোয়াড়ই 'গোট' উপাধির বিপণনযোগ্যতা ও মূল্য বুঝতে পারেননি। ১৯৬৩ সালে (তখনো তিনি ক্যাসিয়াস ক্লে নামে পরিচিত) মোহাম্মদ আলী নিজের মুখে বলা একটি রেকর্ড মুক্তি দেন যেখানে তিনি নিজেকে 'আমিই সবচেয়ে সেরা' বলে দাবি করেন। সেসময় মোহাম্মদ আলীর বয়স ছিল ২১ বছর। সিবিএস থার্টিথ স্ট্রিট স্টুডিওতে রেকর্ড করা ওই ৪৫ মিনিটের ভয়েস রেকর্ডে মোহাম্মদ আলী নিজ ভাষায় পুরো পৃথিবীকে জানিয়েছেন তিনি নিজেকে কিভাবে দেখেন।
ওই ভয়েস রেকর্ডের কয়েকটি লাইনে তিনি নিজেকে নিয়ে বলেছেন, "দিস কিড গট আ লেফট। দিস কিড গট আ রাইট'... প্রতিটি লাইন বলার সাথেসাথে দুইশোর মতো দর্শকের হাসি ও হাততালির শব্দ শোনা যায়। তিনি আরও বলেন, "এই ছেলেটি যদি আপনাকে একবার আঘাত করে তাহলে ওই রাতের মতো আপনি আর চোখ মেলে তাকাবেন না নিশ্চিত। আর যখন আপনি আঘাত খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকবেন এবং রেফারি ১০ পর্যন্ত গুনতে থাকবে, তখন আপনি মনে মনে প্রার্থনা করবেন যেন আর কোনোদিন আমার সাথে আপনাকে লড়তে না হয়। আজকের এই কবিতাটা আমার জন্যে লেখা, খুব শীঘ্রই যে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে, আর এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্যাসিয়াস যদি এখন বলে যে একটা গরুও ডিম পাড়তে পারে, তাহলে তাই হবে। সে ই (মোহাম্মদ আলী) সবার সেরা। আমি যখন বলবো দুই, তা কখনো তিন হবে না। আমার বিরুদ্ধে বাজি ধরা খুবই একেবারে অর্থহীন।"
মোহাম্মদ আলীর এই রেকর্ডটি যে সত্যিকার অর্থেই এই কিংবদন্তির জীবনদর্শনের সারাংশ প্রকাশ করেছে তার প্রমাণ হলো, এই রেকর্ড মুক্তি পাওয়ার মাত্র ছয় মাস পরেই তিনি সনি লিস্টনকে হারিয়ে প্রথম হেভিওয়েট শিরোপা জয় করেন। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে এই রেকর্ডের বিক্রি বেড়ে যায় বহুগুণ, এমনকি এটি 'বেস্ট কমেডি পারফরমেন্স' শাখায় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্যও মনোনীত হয়েছিল!
১৯৯২ সালে এই আদ্যক্ষরগুলো আরও ব্যাপকভাবে পরিচিত হয় যখন মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী লোনি তার স্বামীর সাথে যুক্ত সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম দেখাশোনা করার জন্য G.O.A.T নামক একটি কর্পোরেশন চালু করেন; আলী অবশ্য ততদিনে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
এদিকে র্যাপার ও বক্সিংপ্রেমী এলএল কুল তার ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শীর্ষ অ্যালবামের নাম দেন G.O.A.T। ২০২০ সালে তিনি এসেন্সকে বলেছিলেন, "তার সাথে আমার স্বল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছে, কিন্তু আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবি না যে মোহাম্মদ আলী আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটিকে আমি অসম্মান করবো বা তার সাথে প্রতিযোগিতায় নামবো। এই মানুষটা সবার সেরা কারণ তিনি অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন এবং আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনিই সর্বকালের সেরা।"
২০০৪ সালে জানুয়ারি থেকে একেকটি বিষয় নিয়ে মাসে মাসে মানুষ কি পরিমাণ সার্চ দিয়েছে তা ট্র্যাক করে বোঝা যায় কিভাবে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে 'গোট' শব্দটি ক্রীড়া জগতে মূলধারায় চলে এসেছে। ন্যাশনাল ফুটবল লিগে টম ব্র্যাডিকে আগে থেকেই একজন সেরা খেলোয়াড় হিসেবে দেখা হলেও, ২০১৭ সালে নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিয়টসের হয়ে আটলান্টা ফ্যালকনের বিপক্ষে তার ঐতিহাসিক কামব্যাক ও জয় তাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। সেই সাথে 'গ্রেটেস্ট অব অল টাইম' বা 'গোট' উপাধি খেলোয়াড়দের জন্য একটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়ায়। এর কয়েক মাস পর টম ব্র্যাডির ৪০তম জন্মদিনে নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিয়টস ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসে তার জন্মদিন উদযাপন করতে। ব্র্যাডির ষষ্ঠ ও সপ্তম শিরোপা জয়ের পরেও ইন্টারনেটে তাকে নিয়ে সার্চের হিড়িক পড়ে যায়, কিন্তু কোনোটিই সেই ঐতিহাসিক কামব্যাকের সময়কার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।
কিন্তু... তবুও টম ব্র্যাডিই আধুনিক কালের 'গোট' বিতর্কের প্রথম অনুঘটক নন। তারও আগে ২০১৬ সালে আমেরিকান সাতারু মাইকেল ফেলপস অলিম্পিকে রিও অলিম্পিকে রেকর্ড ২৩টি স্বর্ণজয়ের অনবদ্য কীর্তির পর গুগল সার্চের শীর্ষে চলে আসেন। গুগল ট্রেন্ডস রেটিংয়ে জনপ্রিয়তার বিচারে ১-১০০ মাত্রার মধ্যে ফেলপসের ২০১৬ ফাইনাল ছিল ১৩ নম্বরে যা টম ব্র্যাডির চেয়ে বেশি।
এরপর থেকে বিশ্ববরেণ্য খেলোয়াড়রা তাদের সাফল্যের শিখরকে শুধু শিরোপা জয়ের সাথেই সম্পর্কযুক্ত হিসেবে দেখেছেন। বাস্কেটবল তারকা লেব্রন জেমসকে হয়তো এখনও অনেকে জর্ডানের ছায়ায় বেড়ে ওঠা অ্যাথলেট হিসেবে দেখেন, কিন্তু এটাও সত্যি যে গোল্ডেন স্টেট ওয়ারিয়রসের রাজত্বের সময়েই তিনি তাদের হারিয়ে ক্লিভল্যান্ড ক্যাভেলিয়ারসকে এনবিএ শিরোপা এনে দিয়েছিলেন। তবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিমান দুর্ঘটনায় বাস্কেটবল তারকা কোবে ব্রায়ান্টের ট্র্যাজিক মৃত্যুর পর তিনিই ছিলেন গুগল ট্রেন্ড রেটিং এর শীর্ষে, অর্থাৎ এই ট্রেন্ডের রেটিং ছিল ১০০; অন্যদিকে জেমসের ছিল ৬৪। তবে কিছুদিন পরে আবারও রেটিং এ এই ট্রেন্ডকে পেছনে ফেলেন জেমস।
বিভিন্ন সময়ে গুগল সার্চের ট্রেন্ডে চলে আসা এ বিষয়গুলো গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন মাইলফলকের একটি কালপঞ্জি নির্দেশ করে। ১১ বছর শিরোপাহীন থাকার পর ২০১৯ সালে টাইগার উডস মাস্টার্স জয়ের পর 'গোট' ট্রেন্ড নিয়ে আবারও হইচই শুরু হয়। অন্যদিকে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সেরেনা উইলিয়ামস টেনিস থেকে অবসর নেওয়ার পর তাকে নিয়ে 'গোট' সংক্রান্ত চর্চা সবচেয়ে বেশি হয়।
তাহলে শেষ পর্যন্ত এই সব তথ্য আমাদের কী বলে? প্রথমত, 'গ্রেটেস্ট অব অল টাইম' বা 'গোট' হতে হলে একজন খেলোয়াড়ের ঝুলিতে থাকতে হবে অসংখ্য ট্রফি। আমেরিকান সংস্কৃতি অনুযায়ী, যারা স্বর্ণ জিততে পেরেছেন তাদেরকেই শুধু 'গোট' এর আলোচনায় রাখা হয়, ফলে অনেক খ্যাতিম্যান খেলোয়াড় যারা বড় শিরোপা জিততে পারেননি তারা আগেই বাদ পড়ে যান।
দ্বিতীয়ত, 'গোট' উপাধি নিয়ে পাগলামোটা আমেরিকান স্পোর্টসের সাথেই বেশি জড়িত। কিন্তু এখানে আবার ব্যতিক্রম হলো ফুটবল। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ফুটবলার সর্বকালের সেরার খেতাব অর্জন করতে পারেননি, তা সে ল্যান্ডন ডোনোভান হোক বা ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক। কিন্তু মার্কিন সকার খেলোয়াদের কেউই 'গোট' এর বিবেচনায় আসার যোগ্য নন জেনেও ফুটবলের প্রতি মার্কিনিদের ভালোবাসা কিন্তু নেহাত কম নয়।
মার্কিন সংস্কৃতিতে ফুটবলকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দেওয়ার পাশাপাশি, আরও একটি ফ্যাক্টর রয়েছে যে কারণে ফুটবলে 'গোট' বা সর্বকালের সেরা ফুটবলার নির্ধারণ করা খুব কঠিন। ফুটবলে শুধুমাত্র গোল দেওয়া ও অ্যাসিস্ট করার উপর ভিত্তি করে সর্বকালের সেরা নির্ধারণ করা হয় না কিংবা একজন খেলোয়াড়ের সম্পূর্ণ গুরুত্ব বোঝা যায় না। এখানে আরও প্রশ্ন রয়েছে- বল পায়ে তার প্রতিটি স্পর্শে কি জাদু রয়েছে? তার সব ফুটবল দক্ষতা দিয়ে কি তিনি মায়েস্ত্রো হয়ে উঠতে পেরেছেন? আরও রয়েছে- গোল স্কোর করা নাকি অ্যাসিস্ট করা? একজন ভালো গোলকিপারও কি তাহলে স্ট্রাইকারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ নন? ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডারদের অবদানকে তেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয় না প্রায়ই, তাদের ক্ষেত্রে কী হবে?
আশির দশক থেকে ফুটবলে সবচেয়ে বড় বিতর্ক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী ফুটবলার পেলে ও আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ম্যারাডোনাকে ঘিরে। সময়ের সাথে সাথে পেলে-ম্যারাডোনার পুরনো হয়েছেন, গত ১৫ বছর ধরে সর্বকালের সেরার বিতর্ক চলছে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে। তবে এতগুলো বছর প্রায় সমানে সমানে লড়াই চললেও মাত্র দুদিন আগে মেসি তার ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ জয় করায়, ইতোমধ্যেই তিনি রোনালদোর থেকে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। গুগল ট্রেন্ড রেটিংয়ে এই মুহূর্তে মেসির রেটিং ১০০ স্ট্যান্ডার্ডে, রোনালদোর ৫৪, অর্থাত অর্ধেক জনপ্রিয়; এরপর আছেন পেলে (এই মাসে তার রেটিং ১০), আর ম্যারাডোনার মৃত্যুর সময় তার সার্চের রেটিং ছিল ৫।
মেসি যে সর্বকালের সেরা তার প্রমাণ মাঠেই বারবার দিয়েছেন মেসি, যদিও তিনি নিজ মুখে তা কখনোই দাবি করেননি। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তিনি সত্যিকার একটি ছাগলের সাথে ফটোশ্যুট করেছিলেন পেপার ম্যাগাজিনের জন্য। তার মানে এই না যে তিনি নিজেই নিজেকে 'গোট' মানছেন। তার ভাষ্যে, "আমি নিজেকে সেরা ভাবি না, আমার মনে হয় আমি শুধুই একজন খেলোয়াড়।"
কাতার বিশ্বকাপের পুরো মাসজুড়ে মেসি যে চমক দেখিয়েছেন এবং আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের শিরোপা খরা ঘুচিয়েছেন, তাতে করে সারা বিশ্বের বহু ফুটবল কিংবদন্তি ও ফুটবল বিশেষজ্ঞই স্বীকার করে নিয়েছেন যে পেলে নন, ম্যারাডোনা নন, রোনালদোও নন... লিওনেল মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার।
কিন্তু বিশ্বের অন্যতম 'গোট' অ্যাথলেট টম ব্র্যাডির মেসি সম্পর্কে মতামত কী?
২০১৮ সালে, "আমি মেসিকে ভালোবাসি এবং আমি মনে করি সে একজন সেরা খেলোয়াড়।" তখনও ব্র্যাডি মেসিকে 'সর্বকালের সেরা' বলেননি। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের পরে হয়তোবা তার ধারণা পাল্টে যেতেও পারে!
সূত্র: দ্য অ্যাথলেটিক