১৮ ইঞ্চি উচ্চতার ভক্তের স্বপ্নপূরণ করলেন তামিম
জন্মের পরই পোলিওতে আক্রান্ত। বয়স বেড়েছে, কিন্তু শরীর বাড়েনি। থমকে গেছে ১৮ ইঞ্চিতে। শিশুর উচ্চতা, কিন্তু অবয়বে বয়সের ছাপ। জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই মানুষটার নাম শাহীন ফকির, বাড়ি বরিশাল। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে উঠলেও কারও বোঝা নন তিনি, নিজের জীবিকা নির্বাহ নিজেই করেন। তাই স্বপ্নও দেখেন নিজের মতো করে। অনেক স্বপ্নের মাঝে তার একটি বড় স্বপ্ন, একদিন তামিম ইকবালের সঙ্গে দেখা করবেন, প্রাণ খুলে কথা বলবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো শাহীনের, স্বপ্নের নায়ক তামিমের সঙ্গে দেখা হলো তার।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ এখন সিলেটে। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের নিমন্ত্রণে সিলেটে চলে আসেন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা ত্রিশোর্ধ্ব শাহীন, তার সঙ্গে আরও চারজন। সবার আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার খরব তামিমই বহন করেছেন। কারও বোঝা হতে না চাওয়া শাহীনের চাওয়া একটি মটোরেবল হুইল চেয়ার। যা তাকে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তামিম, তার সঙ্গে শাহীনের চাওয়া পূরণের অংশীদার হবেন জাতীয় দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম।
শাহীন বরিশালের মুলাদী উপজেলার চর কমিশনার এলাকার আবুল হাসেম ফকিরের ছেলে। বাবা-মা, দুই ভাই, চার বোন ও ভাবি-ভাতিজীকে নিয়ে যৌথ পরিবারে বাস তার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও কারও ওপর নির্ভরশীল নন শাহীন। গত পাঁচ বছর ধরে নিজের ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তিনি। নিজের দোকানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি শিশুদের চকলেট, বিস্কুটসহ কয়েক ধরনের পণ্য বিক্রি করেন শাহীন।
জীবন যুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয়ী শাহীন নিজেকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু সবচেয়ে বড় স্বপ্ন অপূর্ণ থাকার শঙ্কায় দিন গুণতে হচ্ছিল তাকে। গত ১০ মার্চ দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি অনলাইনে শাহীনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের সঙ্গে দেখা করার স্বপ্নের কথা জানান। প্রতিবেদনটি নজরে পড়ে তামিমের, শাহীনকে আমন্ত্রণ জানান সিলেটে আসার। মনে মনে এঁকে যাওয়া স্বপ্নের মুহূর্ত বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আর দেরি করেননি তিনি।
পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে শুক্রবার সিলেটে চলে আসেন শাহীন, গন্তব্য বাংলাদেশের দল অবস্থান করা গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল। এদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠান ছিল, তামিম তখন এখানেই ব্যস্ত। শাহীন ও তার পরিবারের সদস্যরা তখন গ্র্যান্ড সিলেটের ফটকের বাইরে অপেক্ষারত। এটা জানতেই তাদেরকে ভেতরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তামিম।
অবশেষে আসে শাহীনের জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সামনে দাঁড়িয়ে তামিম। স্বপ্নের নায়ককে ছুঁয়ে চিমটি কেটে মনকে হয়তো বোঝাচ্ছিলেন, এটা আর স্বপ্ন নয়, সত্যি। কিছুক্ষণ পর ঘোর কাটে তার, মুখে কথা ফোটে। নিজের গল্প শুরু করেন শাহীন, জানাতে থাকেন কীভাবে তিনি ক্রিকেট পছন্দ করতে শুরু করেন। কীভাবে হয়ে ওঠেন তামিমের ভক্ত। এখানে তামিম যেন মুগ্ধ এক শ্রোতা।
শাহীনের বিস্ময় আরও বাড়ে কিছুক্ষণ পরই, ভক্তকে আরও চমকে দিতে মুশফিককে ডাকেন তামিম। অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটারের সঙ্গে কিছু কথার পর আবদার করে বসেন শাহীন, চেয়ে বসেন মোবাইল নম্বর। হতাশ করেননি মুশফিক, নিজের নম্বর না দিলেও কাছের একজনের নম্বর দিয়ে শাহীন জানিয়েছেন, যেকোনো দরকারে যেন ওই নম্বরে ফোন দেন তিনি। তাহলে তার কাছে বার্তা পৌঁছে যাবে। তামিম ও মুশফিকের সঙ্গে শাহীনের আড্ডার মাঝে সেখানে হাজির হন সাবেক ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার নাফিস। বড় ভাই নাফিস ইকবালকেও শাহীনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তামিম। যদিও শাহীন নিজেই থেকেই নাফিসকে চেনার কথা জানান।
শাহীনের সঙ্গে আসা বাকি চারজনকে শনিবার প্রথম ওয়ানডের ম্যাচের গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের পাঁচটি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন দিয়েছেন তামিম। রুম থেকে নিজের একটি জার্সি এনে শাহীনকে সেটা উপহার দেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এই ওপেনার। জার্সিতে তামিম লিখে দেন, 'অনেক ভালোবাসা শাহীন।' কিছুতেই এসব বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। নিজের সঙ্গে আসা একজনকে ডেকে শাহীন বলেন, 'কেউ বিশ্বাস করবে না আমি তামিম ভাইয়ের সাথে দেখা করেছি। কেউ একটু ভিডিও করো। আমি সবাইকে ভিডিও দেখিয়ে বলবো, আমি আমার তামিম ভাইয়ের সাথে দেখা করতে পেরেছি।'
প্রিয় ক্রিকেটারের সঙ্গে দেখা করার, আড্ডা দেওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে শাহীন বলেন, 'তামিম ভাইয়ের সাথে দেখা করতে পারবো, এটাই তো কল্পনাতে ছিলো না। আর উনি আমাকে টাকা দিলো, খাওয়ালো, টিকিট দিলো, হুইলচেয়ার দেবে বললো। এসব তো আমি কল্পনাও করতে পারছি না।' এরপরই শাহীনের সাথে সেলফি তুলেছেন তামিম, কয়েকটি ছবি পোস্ট করেছেন নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে। যেখানে তামিম লিখেছেন, 'বিনয়ী থাকুন, আপনার যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকুন। সব সময় বলুন আলহামদুলিল্লাহ। বরিশাল থেকে আসা এই মানুষটার সাথে আজ দেখা করে খুব ভালো লাগলো।'