রোমাঞ্চকর জয়ে বিজয় দিবস রাঙালেন লিটনরা
আগে ব্যাটিং করে যে সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ, তা নিয়ে স্বস্তিতে থাকার উপায় ছিল না। বরং দুশ্চিন্তাই বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তারুণ্য নির্ভর দলটি হয়তো এই সংগ্রহেই নিজেদের ওপর আস্থা রেখেছিল। বল হাতে দাপুটে শুরুর পর নিয়মিতভাবে উইকেট উদযাপন করে গেছে বাংলাদেশ, যেখানে বল হাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন অবিশ্বাস্য বোলিং করা শেখ মেহেদি হাসান। দারুণ বোলিংয়ে অবদান রাখেন তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদরাও।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আটকাতে নিয়ন্ত্রিত এই বোলিং যথেষ্টও হলো, মাঝে রভম্যান পাওয়েল ঝড় চললেও বাংলাদেশকে দমানো গেলো না। নিজেদের দেশের ইতিহাসের গৌরবময় দিন বিজয় দিবসে রোমাঞ্চকর এক জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ। সোমবার সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নেস ভেলে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিবীয়দের ৭ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। দলটির বিপক্ষে ১৭ টি-টোয়েন্টিতে এটা তাদের ষষ্ঠ জয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তাদের বিপক্ষে এটাই বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। শুরুটা ভালো না হলেও সৌম্য সরকার ও জাকের আলীর জুটিতে গতি পায় সফরকারীদের ইনিংস। পরে ম্যাচসেরা শেখ মেহেদি হাসান ও শামীম হোসেন পাটোয়ারীর জুটিতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দেয় বাংলাদেশ। এই চারজনের ব্যাটে তাদের স্কোরকার্ডে জমা হয় ৬ উইকেটে ১৪৭ রান। জবাবে শেখ মেহেদির বোলিং তোপে ৩৮ রানে ৫ উইকেট হারালেও এক পাশ আগলে পরে ব্যাট হাতে ঝড় তোলেন রভম্যান। কিন্তু শেষ ওভারে তার বিদায়ে থামতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, এক বল বাকি থাকতে ১৪০ রানে অলআউট হয় ক্যারিবীয়রা।
ছোট সংগ্রহ গড়ে ম্যাচে লড়াই করতে বল হাতে দারুণ কিছু করতে হতো বাংলাদেশকে। শুরুতে সেই কাজটা দারুণভাবে করেন সফরকারীদের বোলাররা। প্রথম ওভারে ১ রান দেন হাসান মাহমুদ। পরের ওভারে এক রান খরচায় ব্র্যান্ডন কিংয়ের উইকেট তুলে নেন তাসকিন আহমেদ। তৃতীয় ওভারে শেখ মেহেদি হাসানের খরচাও এক রান, ডানহাতি এই স্পিনার ফিরিয়ে দেন নিকোলাস পুরানকে। ৩ ওভারে ৩ রান খরচায় ২ উইকেট তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চেপে ধরে বাংলাদেশ।
কিন্তু চতুর্থ বোলার হিসেবে তানজিম হাসান সাকিবকে বোলিংয়ে আনার সিদ্ধান্ত যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য। প্রথম ডেলিভারিতে ওয়াইডসহ ৫ রান দেন সাকিব। এরপর তার ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেন জনসন চার্লস, মারেন ২ ছক্কা ও এক চার। এই ওভার থেকে ২৫ রান পায় ক্যারিবীয়রা। ৩ ওভারে ৩ রান থেকে চার ওভারে তাদের স্কোরকার্ড দাঁড়ায় ২৮/২।
পঞ্চম ওভারে শেখ মেহেদি এই ঝড় থামিয়ে বাংলাদেশকে আবারও খেলায় ফেরান। ৫ রান খরচার ওভারে তিনি ফেরান ১২ বলে ২টি করে চার ও ছক্কায় ২০ রান করা চার্লসকে। ২ রানে ষষ্ঠ ওভার শেষ করেন তাসকিন, পাওয়ার প্লে ৬ ওভারে ৩ উইকেটে ৩৬ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর নিজের তৃতীয় ওভার করতে এসে স্বাগতিকদের পথ ভুলিয়ে দেন ব্যাট হাতেও দারুণ অবদান রাখা শেখ মেহেদি। এই ওভারে তিনি তুলে নেন আন্দ্রে ফ্লেচার ও রস্টন চেসের উইকেট।
যদিও চেসকে শুরুতে আউট দেননি আম্পায়ার, রিভিই নিয়ে তাকে ফেরান ক্যাচ নিয়েই জোরালো আবেদন করা লিটন। ৯ ওভারের মধ্যেই নিজের ৪ ওভার করে ফেলেন শেখ মেহেদি, ১৩ রানে নেন ৪টি উইকেট। যা তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং। ৭ ওভারে ৩৯ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ঘোর সঙ্কটে। এখান থেকে দলের হাল ধরেন অধিনায়ক রভম্যান পাওয়েল ও গুডাকেশ মোটি, ১০ ওভারে তারা দলকে নিয়ে যান ৫৭ রানে।
এই জুটিকে বড় হতে দেননি তানজিম সাকিব। নিজের প্রথম ওভারে ২৫ রান খরচা করা ডানহাতি এই পেসার এই ওভারে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ান, ২ রান খরচায় আউট করেন গুডাকেশকে। পরের ওভারে আকিল হোসেনকে নিজের শিকারে পরিণত করেন রিশাদ হোসেন। ৭ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচ প্রায় হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু খেই হারাননি রভম্যান, ক্যারিবীয় অধিনায়ক লড়াই চালিয়ে যেতে থাকনে রোমারিও শেফার্ডকে সঙ্গে নিয়ে।
১৪তম ওভার থেকে অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে। রিশাদের করা এই ওভার থেকে ১৫ রান তোলে ক্যারিবীয়রা। রভমান ২টি ও শেফার্ড একটি চার মারেন। ১৫তম ওভারে তাসকিনের ওপর দিয়ে চলে রভম্যান ঝড়, ৩টি ছক্কা মারেন তিনি। এই ওভার থেকে ২৩ রান তুলে জয়ের আশা ভালোভাবেই বাঁচিয়ে রাখে স্বাগতিকরা। পরের ওভার থেকে আসে ১২ রান। রভম্যান-শেফার্ড জুটির দৃঢ়তায় জয়ের খুব কাছে পৌঁছে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শেষ ১৮ বলে তাদের প্রয়োজন দাঁড়ায় ২০ রান।
এমন সময়ে ১৮তম ওভারের প্রথম বলে শেফার্ডকে ফেরান তাসকিন, ভাঙে রভম্যান-শেফার্ডের ৩৩ বলে ৬৭ রানের জুটি। ১৭ বলে ২২ রান করেন শেফার্ড। আলজারি জোসেফকে নিয়ে লড়াই চালানো রভম্যান আশা জিইয়ে রাখেন। শেষ ওভারে তাদের দরকার ছিল ১০ রান। শেষ এভারে মাত্র ২ রানে ২ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে থামান হাসান। শেষ ওভারের তৃতীয় বলে আউট হওয়া রভম্যান ৩৫ বলে ৫টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৬০ রান করেন। ৩.৫ ওভারে ১৮ রানে ২ উইকেট নেন হাসান। ২৮ রানে তাসকিনের শিকারও ২ উইকেট। খরুচে তানজিম সাকিব ও রিশাদ একটি করে উইকেট পান।
এর আগে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে তেড়েফুঁরে শুরুর চেষ্টা করেন তানজিদ হাসান হাসান তামিম, যেটাকে অস্থিরতাও বলা যায়। উইকেটে গিয়েই রানের খোঁজে মরিয়া হয়ে ওঠা তরুণ এই ওপেনার যেন ভিন্ন রূপে নিজেকে হাজির করতে চাইলেন। যেটার ফল ভালো হয়নি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সাজঘরে। পরের বলে বোলারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন অধিনায়ক লিটন কুমার দাসও। একটু পর আফিফ হোসেন ধ্রুবও ফিরলে বাংলাদেশ তখন দিকহারা এক দল।
এখান থেকে হাল ধরে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান চাপ সামলে জুটি গড়া সৌম্য জাকের আলী। তাদের গড়া জুটিই হয় বাংলাদেশের ইনিংসের সবচেয়ে বড়। এরপর শেখ মেহেদি হাসান ও শামীম হোসেন পাটোয়ারীর ব্যাটে এগোয় বাংলাদেশ। এতে মেলে কিছুটা লড়াই করার পুঁজি।
টি-টোয়েন্টিতে এই রান নিশ্চয়ই নিরাপদ কোনো সংগ্রহ নয়। কিন্তু সফরকারীদের শুরুতে চোখ রাখলে এটাই বেশি মনে হতে পারে। ১৫ রানের মধ্যেই ফিরে যান তাসজিদ ও লিটন; ৩০ রানে বিদায় নেন আফিফও। উইকেটের চাপ সামলাতে রান তোলায় মন দিতে পারেনি বাংলাদেশ। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ৩ উইকেটে ৩২ রান তোলে তারা। ৬ ওভারের ৩৬ বলের মধ্যে ২২টিই যায় ডট। এক ওভারে ২ উইকেট নেওয়া উইন্ডিজ স্পিনার আগেভাগেই নিজের ৪ ওভার শেষ করে। ৪ ওভারের ২৪ বলের মধ্যে ১৮টি করেন ডট বল করেন।
সৌম্য-জাকের চাপ সামলার দিলেও শুরুতে সেভাবে রানচাকা ঘোরাতে পারেননি, ১০ ওভারে ৩ উইকেটে ৫৬ রান যোগ হয় বাংলাদেশের স্কোরকার্ডে। ১১তম ওভারের ঝড়ে অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। গুডাকেশ মোটিকে টানা ২ ছক্কা মারেন সৌম্য, এই ওভার থেকে আসে ১৫ রান। ততোক্ষণে উইকেটে থিতু হয়ে জাকেরও ব্যাট চালাতে শুরু করেছেন। যদিও ইনিংস বড় করতে পারেননি তিনি। রোমারিও শেফার্ডকে তুলে মারতে গিয়ে লং অনে ধরা পড়েন ২৭ বলে একটি চার ও ২টি ছক্কায় ২৭ রান করা জাকের।
এর আগে চতুর্থ উইকেটে সৌম্য-জাকেরের গড়া জুটি থেকে ৪২ বলে আসে ৫৭ রান। জাকেরের বিদায়ের কিছুক্ষণ পর বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন সৌম্য। বাঁহাতি এই ওপেনার ৩২ বলে ২টি চার ও ৩টি ছক্কায় ইনিংস সেরা ৪৩ রান করেন। এরপর শেখ মেহেদি ও শামীমের ব্যাটে ১৯.৫ ওভার পর্যন্ত লড়ে বাংলাদেশ। ষষ্ঠ উইকেটে ২৯ বলে ৪৯ রানের জুটি গড়েন তারা। ঝড়ো ইনিংস খেলা শামীম ১৩ বলে একটি চার ও ৩টি ছক্কায় ২৭ রান করেন।
শেখ মেহেদি ২৪ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ২৬ রানে অপরাজিত থাকেন। তানজিদ ১১ বলে ৬ রান করেন। রানের খাতা খুলতে পারেননি এই সিরিজে টি-টোয়েন্টি নেতৃত্ব পাওয়া লিটন, প্রথম বলেই আউট হন তিনি। আফিফ ১১ বলে ৮ রান করেন। শুরুতে বাংলাদেশকে চাপে ফেলা আকিল ৪ ওভারে ২ উইকেট নিতে মাত্র ১৩ রান খরচা করেন, একটি ওভার নেন মেডেন। ওবেড ম্যাকয়ের শিকারও ২ উইকেট, ৪ ওভারে ৩০ রান দেন তিনি। রস্টন চেস ও রোমারিও শেফার্ড একটি করে উইকেট পান।