পুরনো ক্যান্সারে ভুগছে বাংলাদেশের ক্রিকেট
পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি টেস্টে আমরা লড়াই-ই করতে পারিনি। এর সমস্যা খুঁজতে গেলে পেছনে যেতে হবে। সমস্যা শুধু এই ম্যাচের নয়, আপনি যখন 'শর্টকাটে' যাবেন, তখন আপনি স্বল্পমেয়াদী পারফরম্যান্স পাবেন, দীর্ঘমেয়াদে পাবেন না। বিশ্বকাপ, এসব ম্যাচ দেখার পর তাই মনে হচ্ছে। হয়তো আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি; বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত খুব একটা ভালো দেখি না।
কারণ, আপনি যখন সংস্কৃতি নষ্ট করে ফেলবেন, তখন ভালো কিছু পাবেন না। যে সংস্কৃতি হওয়া উচিত, সেটা থেকে যখন আপনি বেরিয়ে আসবেন, তখন আপনি ফল পাবেন না। দুনিয়ার সবখানেই গাফিলতি আছে, সেটা যে পরিমাণেই হোক। কিন্তু আমাদের এখানে আমরা স্বল্পমেয়াদী পারফরম্যান্স পছন্দ করি। কী করে ফল পাব, চ্যাম্পিয়ন হব, মানুষকে দেখাব; আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা শো ডাউন করা। আমাদের সময়ে আমরা এই করেছি, সেই করেছি।
ফল খুবই খারাপ হয়েছে। কিন্তু ভালো খেলবে কী করে! ভালো খেলবে তখনই, যখন ওই রকম একটা পরিবেশ থাকবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পরিবেশ, সবখানে খেলা; তখন অনেক প্রতিযোগিতা থাকবে। আমার মনে হয়, আমরা ২০০০ সালের দিকে চলে গিয়েছি। যখন আমরা টেস্ট মর্যাদা পেলাম, তখন কিন্তু আমরা সমুদ্রের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।
তখন আমরা নবাগত দল। তখন আমরা শচিন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের খেলা দেখতাম। ওই সময়ে এসব খেলোয়াড় আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। তখন কিন্তু আমরা রক্ষণাত্মক খেলা খেলেছি, মান-সম্মান বাঁচানোর খেলা খেলেছি। সম্মানজনক হারের জন্য খেলেছি, জেতার জন্য খেলিনি। দুটি-একটি যদি সুযোগ থাকে, জেতার চেষ্টা করব। জেতার মতো তো শক্তিই ছিল না আমাদের।
সে সময়ে আমরা খেলতাম কী করে ৫০ ওভারে ১৫০ বা ১৭৫ রান করা যায়। টেস্ট ম্যাচে কী করে ২৫০ বা ৩০০ রান করা যায়। কিংবা কতক্ষণ খেলা যায়। এখন আমরা সেই জায়গাটায় চলে গেছি। ২০০০ এর পর প্রজন্ম পরিবর্তন হলো। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা পারফর্ম করে জায়গা দখল করে নিল। এরপর তারা ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন ধরে রাখে। এখন বয়স, ইনজুরির কারণে একজন করে চলে যাচ্ছে।
১০ বছরের ছেলের কিন্তু বাড়ার জায়গা থাকে। ১২ বছরে তার গ্রোথ বাড়বে, ১৬ বছর বয়সে গোঁফ-দাড়ি উঠতে থাকবে। আমাদের পরে মাশরাফি, সাকিবরা উঠে এসেছিল, ওরা বাড়ছিল। বাড়তে বাড়তে দলকে ভালো জায়গায় নিয়ে এসেছিল। ওদের পরে যারা এসেছে, তারা যে ওদের টপকে আরও উপরের দিকে নিয়ে যাবে, সেই যাওয়ার প্রক্রিয়াটা একদমই দুর্বল। যে কারণে আমরা ভেঙে পড়ছি। আস্তে আস্তে নিচের দিকে চলে যাচ্ছি।
উঠে আসার উপায় আসলে আমি দেখি না, কারণ আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। এখন আমরা ফল দেখে হাবুডুবু খাচ্ছি, ভাবছি কী করব, কী করলে ভালো হবে। কিন্তু এটা দীর্ঘদিনের একটা ক্যান্সার। ছোট জ্বর না। জ্বর হলে যেমন তিনদিনের ওষুধ খেলেন, ঠিক হয়ে গেল। পাঁচ দিনে একটা অ্যান্টোবায়োটিক খেলেন, ঠিক হয়ে গেল। এটা তেমন নয়।
যেমন ভারত, তাদের বিশ্বকাপে খারাপ খেলাটা জ্বরের মতো। আমরা জানি তারা কতো ভালো দল। হয়তো কোনো কারণে তারা পারেনি, তবে এটা জ্বরের মতো। তারা আবার নিজেদের মতো করে ফিরে আসবে। বা ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড তাদের মতো করে ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের হয়েছে ক্যান্সার, এটা লম্বা সময়ের। ক্যান্সার ছোট্ট একটা কণা থেকে শুরু হয়। বাড়তে বাড়তে পড়ে গিয়ে বুঝতে পারে তার ক্যান্সার হয়েছে। তিন-চার বছরও লেগে যায় অনেক সময়। কিন্তু রোগটা সারানো খুব কঠিন। ভালো ট্রিটমেন্ট না হলে কিন্তু বেঁচে থাকা কঠিন।
ম্যানেজমেন্টে কারা আসবেন, কারা যাবেন; ক্রিকেটারদের কাছে এটা হয়তো তেমন বিষয় নয়। আমার কাছে এমনই মনে হয়। কারণ ম্যানেজমেন্ট তাদের কাজ করবে, খেলোয়াড়রা তাদের কাজ করবে। আমি কোনোভাবেই কোনো খেলোয়াড়কে দোষারোপ করি না। গ্রামের স্কুলে পড়া একটা ছেলে ওখানবার মতো করেই বড় হবে, আবার দেশের সবচেয়ে ভালো স্কুলে পড়া ছেলেটা অন্যভাবে বড় হবে। যে যেখান থেকে উঠে আসবে, ফল তেমনই হবে। ব্যতিক্রম ব্যাপারগুলো ভিন্ন।
তো আমি মনে করি না কখনই খেলোয়াড়দের দোষ। কারণ খেলোয়াড়রা কাঁদামাটির মতো, আপনি যেভাবে তৈরি করবেন, তেমন হবে। উপরে যে মানুষগুলো আছেন, তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে ঠিক করতে হবে, তারা খেলোয়াড় কীভাবে তৈরি করবেন। তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পরিণত খেলোয়াড় বানাবে নাকি গড়পড়তা কিংবা খেলা বিক্রি করা খেলোয়াড় বানাবে। এটা খুব বড় ব্যাপার।
আমরা বড় একটা গ্যাপ তৈরি করে ফেলেছি। ২০০০ সাল থেকেই আমরা খুব ধীর গতিতে এগিয়েছি। এতটা সময় কিন্তু যেকোনো দেশের জন্য অনেক সময়। একটা সময় উন্নতি কম ছিল, অ্যানালগ পদ্ধতি ছিল। কিন্তু ডিজিটাল হওয়ার পর আপনি প্রতিদিন আডডেট হচ্ছেন। কতো দ্রুত এগোচ্ছে দুনিয়া, সেইভাবে দ্রুত হওয়া উচিত ছিল আমাদের। তিন-চারটা প্রজন্ম আমরা পার করে ফেলেছি। আকরাম ভাইদের পর আমরা, আমাদের পরে মাশরাফি এসেছে, মাশরাফির পর মুশফিক, তামিম, সাকিকরা এসেছে। এরপর লিটন, সৌম্যরা, এ ছাড়া নতুন আরও খেলোয়াড় এসেছে।
তো এই প্রজন্মর আরও উন্নত হওয়া উচিত ছিল। তারা প্রযুক্তি, ভালো কোচিং; সব পেয়েছে। টাকা পয়সার অভাব ছিল না। কিন্তু এরপরও হয়নি কারণ আমাদের ভালো পরিকল্পনা ছিল না। ভালো পরিকল্পনা না থাকার কারণে আমি আসলে সেভাবে ভবিষ্যৎ দেখি না। পারফরম্যান্স খারাপ হয়েছে, সমালোচনা হবে; এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তো ভবিষ্যৎই দেখি না, ক্রিকেটের সাথে এতদিন থাকা মানুষ হিসেবে আমার এটাই মনে হয়। অনেকেই মনে করতে পারে আমি নেতিবাচকভাবে বলছি।
ধরুন আমরা বয়সভিত্তিকের কথা বলি। গত আট-দশ বছর ধরে আমরা অনূর্ধ্ব-১৭, ১৯ পর্যায়ে খুব ভালো খেলি। কিন্তু আমরা কি আসলেই ভালো খেলি? আমরা কিছুদিন আগে ভারত থেকে জিতে এসেছি, বড় জয় পেয়েছি। কিন্তু আসলেই কি আমরা অনূর্ধ্ব-১৯ দল? দূরবীন দিয়ে যদি দেখেন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড তাদের সত্যিকারের অনূর্ধ্ব-১৯ দল খেলায়। কারণ তারা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। কিন্তু আমরা যখন ইন্টার মিডিয়েটের ছেলেকে দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়াচ্ছি, ওই ছেলের জন্য এসএসসি পরীক্ষা খুব সহজ। কিন্তু দুই-তিন বছর পর আসল জায়গায় গিয়ে কূল পায় না।
কারণ আপনি ছোটর সাথে খেলে এসেছেন, ভুল আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। পলিসির দিক থেকে আমরা ভুল। মানুষকে দেখানোর জন্য আমরা ফল তৈরি করতে চাচ্ছি। উনিশে ভালো খেললে কয়েক বছর পর আরও ভালো খেলা উচিত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, কারণ আমি খেলেছি একুশের হয়ে উনিশের সাথে। আমার কাছে মনে হয়, নৈতিকতার দিক থেকে আমরা মানুষকে বোকা বানাচ্ছি। শুধু মানুষকে দেখানোর জন্য আমরা কতো কী করছি।
আমাদের ক্রিকেটে এখন অনেক টাকা। কিন্তু টাকা থাকলেই হবে না, ভালো বুদ্ধিটাও গুরুত্বপূর্ণ। কোথায় খরচ করবেন, কোথায় কম খরচ করবেন, কীভাবে করলে ভালো হবে; এসব ভাবনা থাকতে হবে। দেশের সব জায়গা থেকে ক্রিকেটার আসবে, ঢাকার ফ্ল্যাট থেকে তো আসবে না। তাহলে সবখানেই নজর দিতে হবে। কালচার তৈরি করতে হবে। প্রতিটা জেলা থেকে ক্রিকেটার তৈরি হবে। তবে এখানে সবচেয়ে বড় দায়ী টপ ম্যানেজমেন্ট। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে যখন ভালো পরিকল্পনা থাকবে না, জবাবদিহি নেওয়া হবে না, ততক্ষণ ভালো কিছু হবে না। সবাই উপরের দিকের ম্যানেজমেন্টের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু এখানে পরিকল্পনার অনেক বড় ঘাটতি।
শুনলাম মাশরাফি-তামিমকে নিয়ে মিটিং করেছে, সত্যি বলতে এসব 'আই ওয়াশ'। পরামর্শ অবশ্যই নেবে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি গোল টেবিলে বসে ভবিষ্যত পরিকল্পনা না করবেন যে, আমরা এই নকশা করতে চাই, ততক্ষণ কিছু হবে না। সব মিলিয়ে বলা যায়, শর্ট টাইম ভাবনার কারণে আমাদের এই দশা। আমরা বর্তমান সময়ে ফল করতে চাই মানুষকে বোঝানোর জন্য। মানুষকে না বুঝিয়ে বিবেগকে কাজে লাগিয়ে জাতির জন্য করা উচিত।
পাকিস্তানের বিপক্ষে দলটাকে দেখে মনে হয়েছে, আমাদের ক্রিকেটাররা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। ভালো সময়ে দেখবেন সবাই ভালো পারফর্ম করবে। কিন্তু একজনের যখন আরেক জনের ওপর থেকে বিশ্বাস চলে যাবে, তখন সবই সন্দেহ করা শুরু করবে। তখন আপনি পারফরম্যান্স পাবেন না। আমার কাছে মনে হয় বিশ্বকাপের আগে থেকেই সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে যে বোর্ডের দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এটা বিশাল সমস্যা। কারণ সিরিয়ররা আপনার কাণ্ডারী।
সিনিয়ররা কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। পরিবারে বড় ভাই-ই তো কথা বলে। বাবা-মায়ের সঙ্গে তারাই ডিল করবে। বড় ভাইকে বলার সেই সাহসটা দিতে হবে, তাদেরকে সেভাবে রাখতেও হবে। তাদের কাছ থেকে পারফরম্যান্স আদায় করতে হবে, নিয়মের মধ্যে রাখতে হবে। তাদের নিয়মটাই জুনিয়ররা অনুসরণ করবে যে এখানে সবাই সমান। তাদের অভিজ্ঞতা, ভাবনা কাজে লাগাতে হবে। তো আমার কাছে মনে হয়, বোর্ডের ওপর থেকে আমাদের খেলোয়াড়দের বিশ্বাস হারিয়ে গেছে, বিশেষ করে সিনিয়র খেলোয়াড়দের। দল ভালো করছে না, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও নেই; এটা কঠিন সময়। এখান থেকে বেরিয়ে আসাটা খুবই কঠিন।
আবার টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ খারাপ করল, আমি বলব দুই দলের মধ্যে শক্তিতে বড় একটি পার্থক্যও আছে। শাহিন শাহ আফ্রিদি বা হাসান আলীর মতো একটা ফাস্ট বোলার আছে আমাদের যে প্রতিটা ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যানকে পরীক্ষা নেবে? আমাদের বোলার ফ্রেন্ডলি বোলার যে বল করে যাচ্ছি, সময় পার করে যাচ্ছি। আর ওদের প্রতিটা ডেলিভারির মধ্যে এমন ভাব যে উইকেট নিয়ে নিব। আমাদের ব্যাটসম্যানরা কতো কঠিন সময় পার করেছে আর ওদের ব্যাটসম্যানরা কতো সহজ সময় পার করেছে। ওরা কঠিন বোলার খেলে এসেছে বলেই আমাদের বোলারদের বিপক্ষে সহজে ব্যাটিং করেছে।
একে তো আমরা শেষ ছয় মাসে সেভাবে পারফর্ম করতে পারিনি। কারণ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জিতলেও ব্যাটসম্যানরা রান পায়নি। বিশ্বকাপেও রান ছিল না। আপনি যখন রানের খরায় আছেন, তখন খারাপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আপনার জন্য কঠিন। এ সময়ে অনেক তরুণ ক্রিকেটার এসেছে। তাদের জন্য ভালো সুযোগ। কিন্তু তাদেরকেও কিন্তু চাপে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কারণ ফল পাকার আগে খেলে কিন্তু মিষ্টি হবে না বা আসল স্বাদ পাওয়া যাবে না। আমরা তরুণদের নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। তরুণরা আসবে কিন্তু তাকে পরিণত হয়ে আসতে হবে। শচিন ১৬ বছরে এসেছে, কিন্তু সবাই তো ১৬ বছরে পারফর্ম করতে পারবে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। কারণ পরিকল্পনাহীনভাবে এগিয়ে এসেছি, অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্যান্সার সারাতে আপনাকে শুরুতে যেতে হবে।
লেখক: জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক
অনুলিখন: শান্ত মাহমুদ