‘আমরা হয়তো ২০ শতাংশ লাভও বের করতে পারব না’
বেজে উঠেছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) দামামা। আগামী ২১ জানুয়ারি শুরু হয়ে যাবে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে জমজমাট এই আসরের মাঠের লড়াই। স্থানীয় সব তারকা ক্রিকেটারই অংশ নিচ্ছেন বিপিএলে, আছেন বিদেশি নামি-দামি ক্রিকেটাররাও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নাম সাকিব আল হাসান এবার ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলবেন। দলটিতে আছেস ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, মুজিব-উর-রহমানের মতো ক্রিকেটারও।
বিদেশি বড় বড় নাম, সঙ্গে দেশি তারকা ক্রিকেটার; দলটি গড়তে মোটা অঙ্কই খরচ করতে হয়েছে ফরচুন বরিশালকে। তারা এবারের আসরের অন্যতম ব্যয়বহুল ফ্র্যাঞ্চাইজি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এবার ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হতে পারে বলে জানিয়েছেন ফরচুন বরিশালের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।
এতো খরচ করে বিপিএল থেকে কতোটা আয় করা যাবে? লাভের মুখ দেখা যাবে? ফরচুন সুজ লিমিটেডেরও চেয়ারম্যানের পদে থাকা মিজানুর জানালেন, হয়তো ২০ শতাংশ লাভও তোলা সম্ভব হবে না। এরপরও কেন বিপিএলে মালিকানা কেনা, দল নিয়ে পরিকল্পনা, এবারের দলটির কাছে আশা, বড় প্ল্যাটফর্মে কোম্পানির মার্কেটিং, বিনোয়োগের উদ্দেশ্যসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন মিজানুর। বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি স্বত্বাধিকারীদের নিয়ে টিবিএসের বিশেষ সিরিজে আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: বিপিএলের মালিকানা নিয়েছেন, কেমন চলছে কার্যক্রম?
মিজানুর রহমান: আমাদের ভালোই কার্যক্রম চলছে। আপনারা জানেন আমরা সাকিব আল হাসানকে নিয়েছি, সঙ্গে আছে ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, মুজিব-উর-রহমান। বিশ্বের শীর্ষ ক্রিকেটাররা আমাদের দলে আছে। আমার বিশ্বাস আমরা হোমওয়ার্কটা ভালোই করেছি।
টিবিএস: দল কেমন হয়েছে? এই দলটা কতোদূর যেতে পারে, কতোটা আশাবাদী?
মিজানুর: বড় দল গড়েও কিন্তু অনেক সময় ফল করা যায় না। আমি মনে করি আমাদের ড্রেসিং রুমের পারফরম্যান্সটা যদি ভালো হয়, কম্বিনেশন যদি ভালো হয়, সবাই যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এবং রুমমেট হিসেবে যদি ভালো হয়, একটা ভালো ফল বেরিয়ে আসবে। খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা দিতে হবে, স্বস্তির জায়গা দিতে হবে। চাপ দিলে কখনও খেলা বেরিয়ে আসে না। খেলা বের করে আনতে তাদেরকে অনুপ্রাণিত রাখতে হবে। যেটা আমরা করতে যাচ্ছি।
টিবিএস: ক্রিকেটে কেন, কী ভেবে ক্রিকেটে যুক্ত হওয়া? বিপিএলকেই কেন বেছে নিলেন?
মিজানুর: আমি ক্রিকেট ভালোবাসি, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে। ভালোবাসা থেকেই ক্রিকেটে আসা মূলত।
টিবিএস: ফুটবল না কেন? ফুটবল তো আরও বড় ভালোবাসার জায়গা বাংলাদেশের মানুষের কাছে…
মিজানুর: অবশ্যই ফুটবল আরও বড় ভালোবাসার জায়গা। কিন্তু আমাদের টিউনটা হয়েছে ক্রিকেট দিয়ে, ক্রিকেটের ক্রেজ ছিল। এ কারণে আমরা ক্রিকেটের দিকে ধাবিত হয়েছি। ফুটবলও ভালোবাসি কিন্তু ক্রিকেটের মতো নয়।
টিবিএস: বিপিএলে যুক্ত হওয়ার আগে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কোনো কার্যক্রম ছিল আপনাদের?
মিজানুর: গত বিপিএলে আমরা ছিলাম। এর আগে বড় কোনো প্ল্যাটফর্মে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করা হয়নি। তবে প্রিমিয়ার ক্রিকেটে লিগে ছিলাম। আমি ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান। ছোটখাটো কাজ করা হয়েছে।
টিবিএস: ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি ও খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক বাবদ বিসিবিকে ৫ কোটি টাকার পে অর্ডার দিতে হয়েছে আপনাদের। এর বাইরেও বেশ খরচ আছে, সব মিলিয়ে বিপিএলে একটি দল চালাতে কতো খরচ হয় কিংবা এবার আপনাদের কতো খরচ হবে বলে মনে হচ্ছে?
মিজানুর: এটা স্বল্প সময়ে মধ্যে হয়েছে। কিছু খেলোয়াড়কে আমরা ড্রাফট থেকে পাইনি। ড্রাফট থেকে নিলেও পরে তাদের আমরা পাইনি। এই জন্য খরচ বেড়ে গেছে। যেমন প্রথমে আমরা নিরোশান ডিকভেলাকে নিয়েছিলাম। তাকে না পাওয়ায় বিকল্প হিসেবে আমরা ডোয়াইন ব্রাভোকে নিয়েছি। ব্রাভো আমাদের জন্য খরুচে হয়ে গেছে। ক্রিস গেইল, মুজিব-উর-রহমান, ব্রাভোদের নেওয়ায় ব্যয়বহুল দল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় এটা ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট। কিন্তু এখান থেকে রিটার্ন খুব কম। কারণ আমরা স্পন্সরদের ভালো প্রচারণা দিতে পারছি না। শুনছি দর্শক থাকবে না গ্যালারিতে। এটা আমাদের জন্য কঠিন হবে। ২০ শতাংশ লাভ বের করে নিতেও আমাদের সমস্যা হবে। হয়তো এটাও তুলতে পারব না।
টিবিএস: ১০-১২ কোটি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। যদিও এবারের বিপিএল আগের মতো জৌলুশপূর্ণ হচ্ছে না। অনেক তারকা ক্রিকেটার আসছে না। যেহেতু আপনি ব্যবসায়ী মানুষ, ব্যবসার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই মাথায় থাকে। এতো খরচ করে এখান থেকে কতোটা পেতে পারেন? খরচটা কি উঠে আসবে? কিংবা লাভের কথা যদি বলি, সেটা কি সম্ভব?
মিজানুর: এখনও অনেক ভালো খেলোয়াড় আসছে, ফর্মে থাকা খেলোয়াড় আসছে। আমি ধন্যবাদ জানাই বিসিবিকে। বিদেশি চারজনের জায়গায় তিনজন করেছে, এতে আমাদের স্থানীয় ক্রিকেটাররা বেশি খেলতে পারবে। আরও ধন্যবাদ জানাতাম যদি আরও দুটি দল দিতো। তাহলে আমাদের অন্তত ৪০ জন স্থানীয় খেলোয়াড় খেলতে পারতো। বিদেশিদের চেয়ে আমি দেশি ক্রিকেটার বেশি খেলানোর পক্ষে। গত বছর বিদেশি খেলোয়াড় ছাড়া হয়েছে, তবু টুর্নামেন্ট ভালোই গেছে। আমার ধারণা সবাই খেলা দেখেছে। আর দীর্ঘমেয়াদী হলে এখান থেকে লাভ করা যায়। আইপিএলের দলগুলো করছে। যেমন কলকাতা নাইট রাইডার্স অনেক আয় করছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তাদের। তারা একাডেমি করেছে, তারা বিদেশে কন্ডিশনিং ক্যাম্প করছে। তারা প্রাইজমানিও পাচ্ছে। বিসিবি যদি দীর্ঘমেয়াদ পরিকল্পনা করে, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তখন লাভের মুখ দেখবে।
টিবিএস: বিপিএলে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির আয়ের উৎস কোনগুলো? সেগুলো যথেষ্ট কিনা?
মিজানুর: আমরা কেবল স্পন্সরশিপ থেকে আয়ের উৎসটা তৈরি করার চেষ্টা করছি। কোভিডের কারণে এখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কিছু একটা পাওয়া যায় কিনা।
টিবিএস: ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে আপনাদের অনেক ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হলে পাবেন এক কোটি টাকা। এটা ঠিক আছে বলে মনে করেন?
মিজানুর: এটা নিয়ে আমি কোনো উত্তর দিতে চাচ্ছি না। বিসিবি এটা ভালো বুঝেই করেছে। তারা নিশ্চয়ই চিন্তা করে এটা করেছে। সবকিছু চিন্তা করেই তারা এটা করেছে বলে আমার ধারণা। আমি আশা করি ভবিষ্যতে তারা আরও ভালো কিছু করবে। এটা নিয়ে আমি সেভাবে মন্তব্য করতে চাই না।
টিবিএস: প্রাইজমানির ব্যাপারটা কি মালিকানা নেওয়ার সময়ই জেনেছেন, নাকি পরে? আগে জানলে মালিকানা কেনার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতো কিনা?
মিজানুর: না, এটা অনেক পরের সিদ্ধান্ত। মালিকানা নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারি আমরা। এখানে ছয়টা দল আছে। দুইটা দল প্রাইজমানি পাবে। চারটি দল কিন্তু পাবে না। প্রাইজমানি কারও কাছেই ব্যাপার নয়। কারণ আপনি যে ওই দলের একটি হবেন, সেটার তো নিশ্চয়তা নেই। এটা সম্মানের। আমি এটাকে অন্যভাবে দেখি। যে দল দুই দল ফাইনালে যাচ্ছে, তারা একা সম্মানী পাচ্ছে।
টিবিএস: তাহলে বড় একটি প্ল্যাটফর্মে কোম্পানির ভালো মার্কেটিং করার ব্যাপারটিই এখানে বড় পাওয়া? এটা কি যথেষ্ট?
মিজানুর: এটা অবশ্যই যথেষ্ট। যদিও এটা আমাদের জন্য নয়। কারণ আমরা রপ্তানিমূখী কোম্পানি। এখানে আমরা তেমন কোনো মাইলেজ পাচ্ছি না। তবে বাংলাদেশের মানুষ ভালো খেলা দেখবে, এটার স্বার্থেই আমরা ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আশা করি আমরা ভালো খেলা উপহার দিতে পারব।
টিবিএস: ক্রিকেটের স্বার্থের কথা বললে বিপিএল নিশ্চয়ই ক্রিকেটের উন্নয়নের জায়গা নয়। ক্রিকেটের উন্নয়নের জায়গা ঘরোয়া ক্রিকেট। আপনাদের কি কোনো পরিকল্পনা আছে ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার?
মিজানুর: ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমি যেহেতু ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত, ক্লাব নিয়ে কাজ করব। আমি চাচ্ছি আমাদের বরিশাল বিভাগে একটা একাডেমি হোক। স্টেডিয়াম হচ্ছে, একাডেমিটা হলে আমরা তখন খেলোয়াড় অন্বেষণে নেমে যেতে পারব।
টিবিএস: বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কার্যক্রম কেবল টুর্নামেন্ট চলাকালীন থাকে। বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এটা বছরব্যাপী করা যায় কিনা? যেখানে খেলোয়াড় অন্বেষণ বা ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করার জায়গা থাকতে পারে…
মিজানুর: আমরা গত বছর খেলোয়াড় অন্বেষণে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোভিড হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা কিন্তু কারখানাও চালাতে পারিনি। যে কারণে আমরা কার্যক্রম বন্ধ করে দিই। আর আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদী সুযোগ পাই, তখন আসলে পরিকল্পনা করা যায়। তখন আমাদের সঙ্গে যেসব স্পন্সর থাকবে, তাদেরকে ওই আওতায় নিয়ে আসা যাবে। যা তাদের কাজে আসবে। দীর্ঘমেয়াদীভাবে দল পেলে আমরা এমন পরিকল্পনা করব। আমাদের একাডেমি করার পরিকল্পনা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। কারণ দুই কেউ চলাফেরা করতে পারেনি। কোভিডের কারণে সব থেমে গেছে। আমি আশা করি আগামী বছর থেকে কার্যক্রম চালু করব।
টিবিএস: বিসিবির দীর্ঘমেয়াদীভাবে মালিকানা বিক্রি করবে, সেটা হলে নিশ্চয়ই মালিকানায় থাকতে চাইবেন?
মিজানুর: অবশ্যই যুক্ত থাকতে পারব। অবশ্যই এটা একটা ভালো উদ্যোগ। যদি তারা এটা করে, ক্রিকেটের উন্নয়ন হবে।
টিবিএস: আইপিএল মালিকানা না বদলানোয় দলগুলোর নামে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। দলগুলোর নির্দিষ্ট ভক্ত-সমর্থক গোষ্ঠী আছে। কিন্তু বিপিএলে সেটা নেই, প্রতিবার মালিকানার সঙ্গে সঙ্গে দলের নাম পরিবর্তন হয়। এটা কি টুর্নামেন্টের জনপ্রিয়তা নষ্ট করছে, জনপ্রিয়তা তৈরিকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে?
মিজানুর: অবশ্যই প্রভাব ফেলে। এই জন্যই বলেছি দীর্ঘমেয়াদে হলে নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আসে না। ব্র্যান্ড ব্র্যান্ডই থেকে যায়, যেমন কলকাতা নাইট রাইডার্স সব সময় কলকাতা নাইট রাইডার্সই। গত ১০-১২ বছর ধরে আমরা এটাই দেখছি। এমন হলে ভক্তদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়। এ কারণেই আমরা দীর্ঘমেয়াদের পক্ষে। দীর্ঘমেয়াদে গেলে তখন এটা ইতিবাচক ফল দেবে।
টিবিএস: আপনার কোম্পানি সম্পর্কে একটু জানতে চাই। বর্তমান অবস্থা, কীভাবে, কতো সালে শুরু, এর বাইরে আর কী কী ব্যবসা আছে, এসব নিয়ে যদি বলতেন...
মিজানুর: আমরা আমদানি দিয়ে আমার জীবনের প্রথম কাজ শুরু করি। এমজে ট্রেডিং নামে আমার একটি কোম্পানি ছিল, সেখান থেকে আমি ডোরলক আমদানি করাতাম। বাজারে এখনও একটি ডোরলক আছে, নাম ক্লাইম্যাক্স। এটা আমার নাম দেওয়া, ব্র্যান্ডটা আমার। ২০০৪ সালে এসে আমার বড় ধরনের লোকসান হয় এবং ওই ব্যবসাটা আমি ছেড়ে দিই। শুল্ক বাড়ানোর জন্য আমি ওই ব্যবসাটা ছেড়ে দিই। ১৯৯৬ সাল থেকেই আমি একটা অফিসে চাকরি করতাম। ২০০৪ সালে আমি কারখানা শুরু করি। তখন থেকেই কার্টিং ডায়েস কারখানা, অ্যামব্রোডারি কারখানা, কার্টুন কারখানা দিই। এরপর ২০০৬ সালে আমি জুতার কারখানা দিই। এখন আমাদের সাতটা জুতার কারখানা আছে। আমি মনে করি এই মুহূর্তে আমরা দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক। আমরা ফরচুন টেকনোলজি খুলছি, কেবল আনছি। এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে।