ক্রিকেট ছাড়তে চাওয়া মুনিমই এখন আনন্দ আঙিনায়
'খুব ভালো লাগছে, আলহামদুলিল্লাহ। বাসায় কথা হয়েছে, বাবা খুব খুশি হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলে খেলব।' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলা এই কথাগুলো মুনিম শাহরিয়ারের। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশ দলে ডাক পাওয়ার পর উচ্ছ্বাসের শেষ নেই বিপিএলে ঝড়ো গতির ব্যাটিং দিয়ে নজর কাড়া ডানহাতি এই ওপেনারের। অথচ এই মুনিমই হতাশায় একটা সময়ে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন!
একটি বেসরকারি বীমা কোম্পানির চাকুরিজীবি ছিলেন মুনিমের বাবা। তার অনুপ্রেরণায় ছোট বয়সেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি ফরচুন বরিশালের হয়ে বিপিএল মাতানো এই ব্যাটসম্যানের। একটু করে সময় যায় আর স্বপ্ন বড় হতে থাকে তার, যার শেষ সীমানা জাতীয় দলের হয়ে খেলা পর্যন্ত। পাড়া-মহল্লা পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ের বয়সভিত্তিক দলে জায়গা করে নেন মুনিম।
মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকেন যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। কিন্তু দলে জায়গা হয়নি, স্ট্যান্ডবাই হিসেবে থাকলেও স্বপ্নের দুয়ার খোলেনি তার। শ্রীলঙ্কাতে যুব টেস্ট খেলাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে মুনিমের সর্বোচ্চ পথ মাড়ানো।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেট পেরিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে শক্ত জায়গা গড়তে যাত্রা শুরু করেন মুনিম। এখানেও বন্ধুর পথ, প্রিমিয়ার লিগে দল পাওয়াটাই কষ্টসাধ্য। দল পেলেও সেভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ মিলতো না। তাই নিজেকে মেলে ধরার সুযোগও পেতেন না ময়মনসিংহের এই ক্রিকেটার। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেও পারফরম্যান্সে ছিল না ধারাবাহিকতা।
এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ক্রিকেটই ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন মুনিম। অন্য কিছুতে ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা ভর করে তার মাথায়। নিজের সঙ্গে নিজের কঠিন যুদ্ধের সেই সময়ে ক্রিকেটে মন দিতে মুনিমকে সবচেয়ে বেশি সাহস যোগান তার বাবা। মুনিমকে তার বাবা বলতেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত সবাইকে চেনাতে না পারবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।'
বাবার কথায় অনুপ্রাণিত হতে থাকা মুনিমকে সাহস যোগান এলাকার বড় ভাই, বন্ধু-বান্ধবরা। সে সময় মুনিমকে উৎসাহ যোগান জাতীয় দলের ক্রিকেটার নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনও। অনেকের যোগানো সাহসকে সঙ্গী করে হতাশা ঝেরে আবারও চলতে শুরু করেন মুনিম।
এবার তার পথচলা ভিন্ন। মুনিমের ভাষায়, 'প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতে আবাহনী লিমিটেডে সুজন ভাই আমাকে সুযোগ করে দেন।' এই সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। ২৩ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান আবাহনীর হয়ে ১৪ ম্যাচে ২টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ২৯.৫৮ গড় ১৪৩.১৪ স্ট্রাইক রেটে ৩৫৫ রান করেন। তার চেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কেবল সোহানের বেশি স্ট্রাইক রেটে ছিল, ১৪৯.৬১।
এরপরও বিপিএলের ড্রাফটে দল পাননি মুনিম। পরে তাকে দলে ভেড়ায় বরিশাল। করোনা পজিটিভ হওয়ায় শুরুর কয়েকটি ম্যাচ খেলা হয়নি তরুণ এই ব্যাটসম্যানের। ষষ্ঠ ম্যাচ থেকে সুযোগ পেয়ে দারুণ সব শটে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে থাকেন তিনি। একাদশে নিয়মিত জায়গা পেয়ে প্রায় প্রতি ম্যাচে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন ব্যাট হাতে ঝড় তোলা মুনিম।
ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসরটিতে ৬ ম্যাচে একটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ২৯.৬৬ ও ১৫২.১৩ স্ট্রাইক রেটে করেন ১৭৮ রান। তার শট খেলার সামর্থ্য, সাহসে মুগ্ধ বরিশালের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান জানান, মুনিম এবারের বিপিএলের সেরা আবিষ্কার। তার দিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখা জাতীয় দলের নির্বাচকদেরও তাই মনে হয়েছে। এ কারণেই আফগানদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে মুনিমকে দলে নেওয়া।
বিপিএল শেষ করে মুনিম বুঝতে পেরেছিলেন, জাতীয় দলে ডাক আসতে পারে। সেই ডাকটা এলো কদিন পরই, ২১ শে ফেব্রুয়ারি। উদ্বেলিত মুনিম ফেসবুকে পোস্ট দিলেন, 'এই ২১ শে ফেব্রুয়ারি কখনও ভোলা সম্ভব নয়।' এর আগে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে মুনিম বললেন, 'আশাপাশে শুনছিলাম, আমাকে কয়েকজন বলেছিল, 'তোর সুযোগ হতে পারে।' আমার মনে হচ্ছিল হয়তো হয়েও যেতে পারে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।'
স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে মুনিম। তবে স্বপ্ন ছুঁয়েই এবার আর মিলিয়ে যেতে চান না, স্বপ্নের ভুবনে গড়তে চান স্থায়ী বসতি, 'ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলে খেলব। মাঝে তো অনেক হতাশাজনক সময় পার করেছি। আমাকে ফিরে আসার পেছনে যারা কাজ করেছেন, সবাইকে অনেক বেশি ধন্যবাদ। এখন স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছি, যদি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই, তাহলে জায়গাটাকে ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ থাকবে। আমি আসলে আর হারিয়ে যেতে চাই না। কারণ, জানি জায়গাটা ধরে রাখা আরও বেশি কঠিন।'