কী হবে যদি ধ্বংস হয়ে যায় আমাজন?
ধরুন, আপনার বুকের খাঁচা থেকে ফুসুফুসটা একমুহূর্তের জন্য উপড়ে ফেলা হলো - কেমন লাগবে আপনার? নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবেন, কিন্তু ঠিক ঐ মুহূর্তের অনুভূতিটা কি কল্পনা করতে পারেন?
আমাজন পুড়ছে, পৃথিবীর ফুসফুস, মানে আমাদের ফুসফুসটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আমাজনের রেনফরেস্ট জ্বলছে। অথচ গুরুত্ব না দেয়ার কারণে এতদিন খবরটি প্রকাশ করা হয়নি। গত বুধবার (২১ আগস্ট) এই খবরটি সামনে আসে।
শুধু তাই নয়, শুধু এ বছরেই আমাজনের জঙ্গলে রেকর্ড ৭২,৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের পর এরকম ভয়ানক পরিস্থিতি আর তৈরি হয়নি আমাজনে। আর এই আগুন লাগার ঘটনা স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৩ শতাংশ বেশি!
আর শুধু গত সপ্তাহ বা গত বছর নয়, গত শতাব্দী থেকে এই পর্যন্ত ধীরে ধীরে আমাজন রেইনফরেস্টের ২০ শতাংশের বেশি ধ্বংস করে ফেলেছি আমরা । গবাদী পশুর চারণ ক্ষেত্র, তাদের খাবারের জন্য কৃষিক্ষেত্র তৈরি আর সোনার খনি খুঁজতে মাটি খননের মতো কাজে এই রেইনফরেস্টের ২০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাজনের ২৭ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ তো বলছি ধীরে ধীরে ধ্বংস করার কথা।
কিন্তু মনে করুন, আমরা মানুষেরা হঠাৎ একদিন নিজেদের বোধ-বুদ্ধি হারিয়ে ফেললাম, মানবিক সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে উজাড় করে দিতে থাকলাম একের পর এক জঙ্গল। আর আমাজনকে যদি উজাড় করে দেই, তবে কি হবে বলতে পারেন?
চলুন, চিত্রটা একটু কল্পনা করার চেষ্টা করি।
১। ৫৫ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তৃত এই রেইনফরেস্ট পুরোটা বিরান ভূমিতে পরিণত হবে। যার মানে, ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন , মানে প্রায় ৪ হাজার কোটি গাছ কেটে ফেলব আমরা।
২। তার মানে প্রায় ১৪০ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস মিশে যাবে আমাদের পরিবেশে। যা প্রতি বছরে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ৩ থেকে ৫ গুণ।
আর তাই আক্ষরিক অর্থেই আমাজনকে পৃথিবীর ফুসুফুস বলা যায়, কেননা ফুসফুসটা না থাকলে যেমন নিশ্বাস নেয়ার কথা কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমন করেই - এত কার্বন-ডাই -অক্সাইডের ভিড়ে আমরা নিশ্বাস নিতে পারবো না।
আর শুধু মাটির পৃথিবীতেই নয়, এই বিপুল পরিমাণের কার্বন-ডাই-অক্সাইড কিন্তু জলভূমিকেও ছেড়ে কথা বলবে না। সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়ে পানির অম্লত্ব বাড়িয়ে দেবে, অর্থাৎ পানির চরিত্র হয়ে পড়বে অনেকটা এসিডের মতো। এতে মারা যাবে অসংখ্য সামুদ্রিক জীব, সমুদ্র তলদেশের শৈবাল-মস-গুল্ম মারা যাবে।
এক কথায়, পৃথিবীর প্রতিটি কোণ-গলি-ঘুপচি আক্রান্ত হবে বিপুল এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের।
৩। এতো গেল আমাদের বেঁচে থাকার কথা। এবার আসুন কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্য প্রাণের কথা চিন্তা করে দেখি।
বিশ্বের সবচাইতে সমৃদ্ধ প্রাণিবৈচিত্র্যের আবাসস্থল আমাজন। পৃথিবীর প্রতি ১০ টি প্রজাতির মধ্যে ১ টি এখানে বাস করে। তার মানে, আমাজন ধ্বংস হয়ে গেলে হারাবে
-
৪০ হাজার প্রজাতির প্রাণি
-
২.৫ মিলিয়ন বা ২৫ লক্ষ প্রজাতির পতঙ্গ
-
১৩০০ প্রজাতির পাখি
-
৪০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী
-
৪০০ প্রজাতির উভচর প্রাণি এবং
-
৩১ মিলিয়ন আদিবাসী মানুষ যারা শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে আমাজনের বুকে।
৪। মাটিকে ধরে রাখার জন্য যখন কোন গাছ থাকবে না, তখন এই বিরাট এলাকা জুড়ে শুরু হবে মাটি ক্ষয়। আমাজন নদীর অববাহিকা বা বেসিনটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অববাহিকা। আর এই ভূমি ক্ষয়ের সমস্ত অনুর্বর মাটি গিয়ে পড়বে আমাজন নদীতে, আমাজন বেসিনে জমবে এই মাটি।
পানিতে মিশে গেলে সেই মেটে পানি গিয়ে পড়বে আটলান্টিক পর্যন্ত। ব্যাহত হবে আমাজন নদীর বৈচিত্র্যময় জলজীবন।
৫। পৃথিবীর ৩০ শতাংশ উদ্ভিদজাত ঔষধের উৎস আমাজন। এর মাত্র ১ শতাংশ সপুষ্পক ঔষধী গাছ আমরা নিয়মিত ব্যবহার করি। এখনও একটা বিরাট অংশ পড়ে রয়েছে, যেটা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোন গবেষণাই করা হয় নি।
৬। আমাজন রেইনফরেস্টের সবচেয়ে বড় প্রভাব পৃথিবীর জলবায়ুতে। গাছ প্রস্বেদনের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি ত্যাগ করে। এই পানি জলীয়বাষ্প হিসেবে মেঘের সঙ্গে যুক্ত হয়, যা পৃথিবীর বৃষ্টিপাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। যেমন শুধুমাত্র একটা ওক গাছ বছরে ৪০ হাজার গ্যালন (১ লাখ ৮২ হাজার লিটার) পানি ত্যাগ করে।
গাছ মাটি থেকে যে পরিমাণ পানি শুষে নেয়, তার প্রায় ৯৭ শতাংশই ফিরিয়ে দেয় প্রকৃতিতে। আর তাই বিশ্বের মোট পানির ১০ শতাংশ আসে উদ্ভিদ থেকে।
এজন্যই এই জঙ্গলকে রেইনফরেস্ট বলা হয়। নিজের বৃষ্টি সে নিজেই তৈরি করে।
অর্থাৎ যত বেশি এই জঙ্গল উজাড় করা হবে, দেখা দেবে খরা, বৃষ্টিহীনতা - যা এই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর।
আচ্ছা, একবার ধ্বংস হয়ে গেলে এই বন কি আবার নতুন করে গজে উঠবে?
না। আজ থেকে ৫৬ মিলিয়ন বছর আগে ইওসিন যুগে এই রেইনফরেস্ট গড়ে উঠতে থাকে। তখন পৃথিবী ছিল অনেক গরম। ফলে জলীয়বাষ্প থেকে হওয়া বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু পৃথিবী ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়েছে, এই রেইনফরেস্টের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে এর নিজস্ব বাস্তুসংস্থান।
কিন্তু যখন উর্বর মাটি থাকবে না, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত থাকবে না - তখন সহজে এখানে বনভূমি গড়ে উঠবে না।
হাজার হাজার পর পর একসময় গাছ গজাবেই, কিন্তু সেই মহান আমাজন রেইনফরেস্ট হয়তো আর ফিরে আসবে না।
আর ততদিন পর্যন্ত বনভূমির জন্য আমরা এই জায়গা খালি রাখবো কি না তাও একটা প্রশ্ন। হয়তো রিয়েল এস্টেট আর কল-কারখানা দিয়ে পুরো জায়গা দখল করে ফেলব।
যাই হোক, কল্পনার সেই ভয়ানক সময় থেকে ফিরে আসি। এখনও সময় আছে, এখনও সুযোগ আছে আমাদের। সবাই মিলে চেষ্টা করলে হয়তো সেই ভবিষ্যতটাকে এড়িয়ে যাব আমরা।