ল্যারি: ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের রাজা!
লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারের ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাড়িগুলোর একটি। এর কারণ হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে প্রভাব রাখা এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী এই বাড়িতে থাকেন। পাঁচ বছরের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীরা এখানে স্বপরিবারের আসেন, কেউ মেয়াদ শেষ হলে বের হয়ে যান আবার কেউ কেউ পদত্যাগ করেও এই ভবনের মায়া ছাড়েন। গত নয় বছরে ডাউনিং স্ট্রিটের এই ভবন থেকে দুজন প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে গেলেও বের হননি ভবনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা। তার নাম ল্যারি।
কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের লড়াইয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টকে হারিয়ে গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন। কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের দেয়া ভোটে জেরেমি হান্টের পাওয়া ৪৬ হাজার ৬৫৬ ভোটের বিপরীতে ৯২ হাজার ১৫৩ ভোট পেয়ে দলনেতা নির্বাচিত হন বরিস। ফলে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের এই বাড়িতে বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসকে সাথে নিয়ে বসবাস করতে যাচ্ছেন বরিস জনসন।
কনজারভেটিভ দল থেকে নির্বাচিত ব্রিটিশ এমপি নাইজেল ইভান বিবিসিকে বলেছিলেন, "একমাত্র এই বিষয়টাই নিশ্চিত যে ল্যারিই ডাউনিং স্ট্রিটে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীরা এই বাড়িতে আসবে আর যাবে, শুধু ল্যারিই থেকে যাবে।"
ল্যারি কে?
ল্যারি একটি বিড়ালের নাম যার জন্ম ২০০৭ সালে। গায়ের রঙ সাদা এবং বাদামী। ২০১১ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের ক্যাবিনেট অফিসে প্রধান ইঁদুর শিকারি হিসেবে সে কাজ করছে।
দলচ্যুত ও অসহায় কুকুর-বিড়ালদের থাকার জায়গাসহ চিকিৎসা সহায়তা দেয় 'ব্যাটারসিয়া ডগস এন্ড ক্যাটস হোম' নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি সংগঠন। দলচ্যুত ল্যারিকে সেখান থেকে পছন্দ করেই ডাউনিং স্ট্রিটে নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কর্মকর্তারা।
ডাউনিং স্ট্রিটে আসার এক মাসের মাথায় ২০১১ সালের ২২ এপ্রিল ওই ভবনের একটি ইঁদুরকে মেরে ল্যারি প্রমাণ দেয়, শিকারী হিসেবে তার খুনে মেজাজের। তবে বছর শেষে আবিষ্কার হয় যে, ইঁদুর শিকারের চেয়ে বেশী সময় ল্যারি কেবল আয়েশ করে ঘুমিয়ে কাটাতেই পছন্দ করে।
ল্যারির সাথে ওবামার সাক্ষাৎ, ট্রাম্পের গাড়িবহরে ল্যারির বিড়ম্বনা
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১১ সালে যখন যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিলেন সেবার তার সাথে দেখা হয়েছিল বিড়াল ল্যারির। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনে বসে ব্রিটেনের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ওবামাকে বলেছিলেন ল্যারি সম্পর্কে।
"সে খুব ভালো ইঁদুর শিকারী। আমার মনে হয় সে এ পর্যন্ত তিনটা (ইঁদুর) মেরেছে... ব্যাপারটা যাচাই করতে হবে।"
ক্যামেরন বলেছিলেন, তিনি রান্নাঘরে থাকা একটা ইঁদুরের ছবি তার মোবাইল ফোনে তুলেছিলেন। ল্যারিকে এখন ওই রুমে পাঠাতে হবে।
ক্যামেরন এটাও বলেছিলেন যে ডাউনিং স্ট্রিটের ভবনে অনেক অতিথির ভীড়ে ল্যারিকে 'সামান্য নার্ভাস' লাগলেও মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে অন্যরকম ছিল সে।
তিনি বলেন, "অদ্ভুতভাবে সে ওবামাকে খুব পছন্দ করেছে। ওবামা তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলো এবং সে ওবামার সাথে একদম ঠিকঠাক ছিলো।"
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ল্যারির আচরণ ছিল একটু ভিন্নরকম।
এবছর ট্রাম্প যুক্তরাজ্যে সফরে এসে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আসলে বৃষ্টির পানি থেকে আশ্রয় নিতে ল্যারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের লিমুজিন কারের নিচে ঢুকে পড়ে। লন্ডনের রাস্তায় ট্রাম্প-বিরোধী আন্দোলনকারীরা কোন সমস্যা তৈরি করতে না পারলেও ল্যারি সেদিন ট্রাম্পের গাড়িবহরে দেরী করিয়ে দেন।
ল্যারিকে কতোটা আদর করতেন ক্যামেরন?
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটা ঘটনায় ল্যারি ও ক্যামেরনের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। ক্যামেরন অভিযোগ আনেন ডাউনিং স্ট্রিটে অতিথিরা আসার পর তিনি খেয়াল করেছেন তার স্যুটে বিড়ালের পশম লেগেছিলো এবং স্যুট থেকে বিড়ালের খাবারের ঘ্রাণ আসছিল যা লুকোতে এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করা হয়।
তবে এরপর ক্যামেরন টুইটারে পোস্ট দিয়ে জানান, তিনি এবং ল্যারি 'বিলকুল ঠিকঠাক' আছেন।
২০১৬ সালে হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ প্রশ্নোত্তর পর্বে ক্যামেরন বলেছিলেন, ল্যারি একজন সিভিল সার্ভেন্ট, সে কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হলেও ল্যারি ডাউনিং স্ট্রিটেই থাকবে।
যুক্তরাজ্যের জনগন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট দেয়ার পর ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে যখন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাসা ছেড়ে দেন তখন তিনি বলেছিলেন, তার আত্মজীবনীর জন্য তিনি ল্যারির সাথে একটা ছবি তুলে রাখতে চান।
ক্যামেরন বলেছিলেন, ল্যারির সাথে তার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঐ সেলফিটি তোলার সময়। ল্যারিকে তিনি মিস করেন।
ল্যারিকে মিস করবেন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে?
ডেভিড ক্যামেরনের পর ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হিসেবে ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন যুক্তরাজ্যের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। ল্যারিকে পছন্দ করেন কি না এমন প্রশ্নে টেরিজা নানা সময়ে নানা বিভেদ সৃষ্টিকারী উত্তর দিয়েছেন।
তিনি বলেছিলেন, তিনি কুকুরপ্রেমী মানুষ তাই ল্যারি তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। টেরিজা মে বলেছিলেন, 'ল্যারিকে দেখলে ভাল লাগে' তবে এর পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছিলেন যে, 'আমরা সবসময় বাড়িতে বিড়াল না রেখে কুকুর পুষতাম'।
এখন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে দেবেন মে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সে বাড়ির বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন বরিস জনসন। ল্যারি তার বাড়িতে আরেকজন নতুন বাসিন্দা পেতে যাচ্ছেন। তবে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে, জনসনও কি ল্যারিকে ক্যামেরনের মতোই আদর করবেন?
একটা বিষয় পরিষ্কার, সময়ের সাথে সাথে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বারবার পরিবর্তন হয়েছে। তবে ওয়েস্ট মিনিস্টারের ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের রাজা হিসেবে রয়ে গেছেন সবার প্রিয় ল্যারি যেমনটা বাকিংহাম প্যালেসে আছেন রাণী।