হাওরে নৌকাডুবির কান্না
বুধবার মোফাজ্জল মিয়ার বিয়ে হবার কথা।হাওরপাড়ের বাড়িটি সাজানো হয়েছে রঙিন কাগজ দিয়ে। বাড়িজুড়ে হুল্লোড়, ধুমধাম। উৎসবের আমেজ আর আনন্দের বন্যা।
ওদিকে, কনেবাড়ি যাবার জন্য বরযাত্রী বহন করতে বাড়ির সামনে চলে এসেছে সুসজ্জিত ইঞ্জিন নৌকো।
তারপর ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
বাড়িতে টানানো রঙিন কাগজগুলো এখনও সেভাবেই রয়ে গেছে। ইঞ্জিন নৌকোটাও বাঁধা আগের মতো। কেবল হুল্লোড় আর উৎসবের বদলে বাড়িজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে বিষাদ। চারপাশ থেকে থেমে থেমে ভেসে আসছে বিলাপের সুর।
মঙ্গলবার রাতে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালিকোটা হাওরে নৌকাডুবিতে মারা গেছেন ১০ জন। চার জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে মঙ্গলবার। আর ছ’জনের বুধবার। নিহতদের সবাই মোফাজ্জল মিয়ার স্বজন। উৎসবে যোগ দিতে নৌকোয় চড়ে বিয়েবাড়ির উদ্দেশে আসছিলেন তারা। হাওরের এক ঝড় দশটি প্রাণ কেড়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের আনন্দটুকুও মুছে দিল বাড়ির আঙিনা থেকে।
বিয়োগান্তক এই ঘটনার কারণে বর সেজেও মোফাজ্জল মিয়ার কনেবাড়ি যাওয়া হল না। বিয়ের অনুষ্ঠানটা সেদিন স্থগিত করে দিলেন পরিবারের সদস্যরা।
মোফাজ্জলদের বাড়ি দিরাইয়ের চর নারচর ইউনিয়নের পেরুয়া গ্রামে। হাওরের জনবসতিগুলো একেকটা দ্বীপের মতো। চারদিকে পানি। মাঝখানে উঁচু ছোট্ট একেকটা ভূখণ্ড। এটুকু জায়গাতেই গাদাগাদি করে থাকে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি পরিবার। স্থানীয়দের ভাষায় যা ‘আঁটি’ নামে পরিচিত। হাওরে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তাদের। ফলে মিলেমিশেই থাকতে হয় সবাইকে। একের আনন্দ ভাগ করে নেন অন্যরা। একজনের বিষাদ ছুঁয়ে যায় অন্যকে।
পুরো পেরুয়া গ্রামই তাই এখন পুড়ছে স্বজনহারানোর বেদনায়। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে হাওরের তাণ্ডব নিয়ে আর্তনাদ।
মোফাজ্জল মিয়ার মামার বাড়ি উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামে। তার এক চাচাতো বোনেরও বিয়ে হয়েছে এই বাড়িতে। খালা ও বোনের পরিবারকে বিয়েতে যোগদানের জন্য আনতে মঙ্গলবার সকালে মাছিমপুর গিয়েছিলেন মোফাজ্জলের ভাই মোশরাফ। সন্ধ্যায় ইঞ্জিন নৌকোয় চড়ে পেরুয়া গ্রামে বিয়েবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন ওরা ৩১ জন।
নৌকোটি হাওরের আইনুল বিলে আসার পরই শুরু হয় তুমুল ঝড়। হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের কাছে ‘আফাল’। ডুবে যায় নৌকো। পানিতে তলিয়ে যান যাত্রীরা। রাতেই উদ্ধার করা হয় আবির, শামীম, আজম ও সোহান নামে ৪ শিশুর লাশ। পরদিন সকালে উদ্ধার হয় আরও ৬ লাশ। বাকিরা সেদিনই সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছিলেন।
নৌকাডুবিতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন বর মোফাজ্জলের খালাতো ভাই ৪ বছরের শিশু শহিদুল মিয়া এবং আরেক খালা রহিতুন্নেছা (৩৫) ও খালাতো বোন তাছমিনা বেগম (১১)।
ওদিকে, নোয়ার চর গ্রামের আফজাল হোসেনের দুই ছেলে সোহান মিয়া (২) ও আসাদ মিয়া (৪) এবং স্ত্রী আজিরুন নেছা (৩৫) ও শাশুড়ি করিমা বিবি (৭৮) রয়েছেন নিহতদের তালিকায়।
নিহত অন্য তিন শিশু হল, মাছিমপুর গ্রামের জমসেদ আলীর মেয়ে শান্তা মনি (৩), বাবুল মিয়ার ছেলে শামীম মিয়া (২) ও বদরুল মিয়ার ছেলে আবির মিয়া (৩)।
একসঙ্গে এত স্বজনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মোফাজ্জলের পরিবার। তার বাবা ফিরোজ আলী কোনো কথাই বলতে পারছেন না। মাঝে মাঝে শুধু বিলাপ করছেন।
পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য হাবুল মিয়ার চাচাতো বোন নিহত আজিরুন নেছা। একসঙ্গে তিনি হারিয়েছেন চাচি, চাচাতো বোন ও ভাগ্নেদের। বললেন, “হাওরের সর্বনাশা ঢেউ আমাদের পরিবারের এত জনকে একসঙ্গে কেড়ে নিয়েছে। হাওর আমাদের আনন্দ না দিয়ে কাঁদিয়েছে।”
মাছিমপুর গ্রামের আরজ আলী স্ত্রী ও মেয়েকে হারিয়েছেন। কান্নাভেজা কণ্ঠে জানালেন, তার বড় শ্যালিকার ছেলের (মোফাজ্জল) বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন তার স্ত্রী (রহিতুন্নেছা), ছেলেমেয়েদের নিয়ে। নৌকাডুবিতে স্ত্রী ও মেয়ে মারা গেছেন। ছেলেটি কোনোভাবে সাঁতরিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে। আরজ আলী বিলাপ করে বললেন, “হাওরের সর্বনাশা ঢেউ আনন্দের বদলে আমাদের এ কী উপহার দিল!”
রফিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজোয়ান খান নিজেও শোকস্তব্ধ। বললেন, “এত বড় দুর্ঘটনা আমাদের এলাকায় আগে কখনোও-ই ঘটেনি। স্বজনহারা মানুষের কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।”
চর নারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন তালুকদারও বললেন, অভূতপূর্ব মর্মান্তিক এ ঘটনায় হাওরজুড়ে এখন বিষাদের পদধ্বনি।
বুধবার বিকেলে নিহতদের সকলের দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলে জানালেন দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বিশ্বজিৎ দেব। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৯০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানালেন তিনি।