জাহাজীওয়ালা সফিকুল
যারা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে জাহাজে চেপে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে তাদেরকে আজো জাহাজীওয়ালা নামে জানে অনেকে। সফিকুল আলম তেমনই একজন। ১৯৭৪ সালে জাহাজে চেপে তিনি নেমেছিলেন ফিলাডেলফিয়া বন্দরে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। তখন যুক্তরাষ্ট্রে জনা কয় সন্দ্বীপী ছিল। সফিকুল জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ১৭ নম্বর সন্দ্বীপী। পাঁচ দশক হয়ে গেল তার বিভূঁইয়ে, কিন্তু অন্তরজুড়ে জন্মভূমি। ৭৬ বছর বয়স তার এখন, অবসর জীবনযাপন করেন লং আইল্যান্ডে। নিউ ইয়র্ক সিটির ওজন পার্ক এলাকায় তার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন প্রবাসী টিভির প্রতিবেদক সোহেল মাহমুদ। তিনি বেড়াতে এসেছিলেন মেয়ের বাসায়। সোহেল মাহমুদ ও সফিকুলের মধ্যকার আলাপ ছিল নিম্নরূপ:
আমেরিকায় আসবেন ভেবেছিলেন?
আমি জীবনেও ভাবি নাই।
তাহলে কিভাবে ঘটল?
আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় পালাইয়া লন্ডন চলে আসছিলাম। কিন্তু আইসা গ্রেপ্তার হইলাম। কর্তৃপক্ষ আমারে ধরে দেশে পাঠাইয়া দিল। আমার একটা ফার্মেসি ছিল, লাইব্রেরি ছিল দেশে। ফিরে আবার নতুন করে স্টার্ট দিলাম। কিন্তু সব ফেইল করল। কিন্তু আমার বাবা মারা গেছে, ছোট ভাইবোন আছে। আমি সবার বড়। তাহলে চলব কিভাবে? দেশে অভাব অভাব অভাব।
আপনি যখন আমেরিকায় পা রাখেন, তখন আপনার বয়স কত?
২৭ বা ২৮ হবে।
কিভাবে আমেরিকা আসার পথ খুজে পেলেন?
লন্ডনের পথ যারা পার করছিল তাদের গিয়ে আবার ধরলাম, ভাই আমারে বাঁচাও, খুব কষ্ট। লন্ডনের জাহাজ কোম্পানী, নারায়ণগঞ্জে অফিস ছিল। তারা আমাকে জাহাজের স্পেশাল ক্রু বানায় নিল। পদের নাম ইলেকট্রিশিয়ান হেলপার। আমার সঙ্গে জাহাজের সবার ভালো সম্পর্ক ছিল। এপ্রিলের ৮ তারিখে এসে ফিলাডেলফিয়া নামলাম। আমাদের তো তীরে নামার অনুমতি ছিল না কিন্তু আমি গার্ডকে গিয়ে বললাম ওই যে টেলিফোন বুথ আছে, আমি একটা ফোন করব। কাছেই পেয়ে গিয়েছিলাম এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। তাকে একটা ঠিকানা বলতেই ২০০ ডলার চাইল। আমি বললাম নো প্রবলেম, লেটস গো।
প্রথম কাজ পেলেন কবে?
তেরো দিন বসেছিলাম। কোনো কাজ পাই নাই। তারপর একদিন মিয়াবাড়ির (সন্দ্বীপের) মৌলভী আব্দুল হাই ডেকে নিয়ে গেলেন এক কনস্ট্রাকশনের কাজে। প্রথম দিন ১৫ ডলার পেয়েছিলাম। এরকম মাসখানেক চলল। তারপর একটা কার্পেটের দোকানে কাজ নিতে গেলাম, বিদেশী মালিক আমাকে জিজ্ঞেস করল, পারবা?
আমি বললাম, অফকোর্স পারব, আই অ্যাম আ ইয়াং ম্যান।
১২ ডলার মজুরিতে কাজ নিলাম। গাড়িতে কার্পেট তুলে দিতাম তখন ভদ্রমহিলারা ২/৪ ডলার টিপস দিতেন। শুধু টিপস পেতাম দিনে ১৫/২০ ডলার পেতাম। পাশাপাশি একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানীও খুললাম, নাম দিয়েছিলাম কমরেড কনস্ট্রাকশন।
গ্রিন কার্ড পেয়েছিলেন কত দিন পর?
অনেকদিন পর। তার মধ্যে দুইবার মাকে দেখতে দেশে গিয়েছি। তারপর আবার নানা কৌশল করে আমেরিকায় ঢুকেছি। তারপর চুক্তিতে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলাম, সেবাবদ বৈধ কাগজপত্রের আবেদন করি।
আপনার কেমন লাগছে এ জীবন?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো লাগে। আমি অনেক লোকের উপকারে আসছি। একবার এক ছেলে এসে আমাকে সালাম করে বলল, কাকা আপনার জন্য আমি ডাক্তার হতে পারছি। আমি বুঝলাম, যে শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা বিভিন্ন সময় করেছিলাম দেশে তারই কিছুর উপকারভোগী হয়তো এ ছেলে। সে আমার পা ধরে সালাম করল। আমার চোখে পানি চলে আসলো।
আপনার কোনো অতৃপ্তি আছে?
নাহ্ আল্লাহ যে হালে রাখছে আমি ভেরি মাচ হ্যাপি।