অপর্যাপ্ত ঘুম থেকে মিষ্টির নেশা
চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার দেখলে লোভ সামলাতে পারেন না? দিনের কোন একবেলা মিষ্টি খেতেই হবে-এমন নেশায় ভুগছেন?
গবেষকরা বলছেন, অপরিমিত ঘুম এর কারণ। সোমবার আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গবেষণায় এই তথ্য জানা যায়। আর এই কাতারে নারীরা ঝুঁকিতে আছেন বেশি।
গবেষকরা দেখতে পান যেসব নারীরা ঘুমের অভাবে ভুগছিলেন তাদের মধ্যে অতিরিক্ত শর্করা, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ক্যাফেইন খাওয়ার প্রবণতা বেশি।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরভিং মেডিকেল সেন্টারের এই গবেষকরা এক বছর ধরে প্রায় ৫০০ নারীর প্রতিদিনকার খাদ্যাভ্যাস, ঘুমের মাত্রা আর হৃদপিণ্ডের গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেন।
সিএনএনকে এই গবেষকরা জানান, নারীরাই মূলত স্থূলত্ব আর অপরিমিত ঘুমের শিকার হন তুলনামূলকভাবে বেশি।
এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক ডাঃ ব্রুক আগরওয়াল বলেন, "আমাদের আধুনিক সমাজে আমরা প্রায়ই দেরিতে কাজ শেষ করি, খাবার দেরি করে খাই এবং আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পক্ষে ঘুম যে কতোটা জরুরি সেটা ভুলে যাই।”
"নারীদের সুস্থ হৃদপিন্ড ও শরীরের ওজন ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের গুরুত্বের বিষয়টা নিয়ে কাজ করেছি আমরা এই গবেষণায়”, বলেন ড. আগরওয়াল।
কম ঘুম মানেই অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন আপনি
এই গবেষণার জন্য ২০ থেকে ৭৬ বছর বয়সের প্রায় ৫০০ নারীর নিদ্রার ধরণ এবং তাদের খাবারের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়েছিল।
গত এক বছর ধরে তারা কি কি খেয়েছেন, কতটুকু পরিমাণে খেয়েছেন এবং কত ঘন ঘন খেয়েছেন
এই নারীদের এক তৃতীয়াংশই কিছু মাত্রায় ঘুমহীনতা বা অনিদ্রায় ভোগেন। তাদের প্রায় ৩০ শতাংশই রাতে সাত ঘণ্টার কম ঘুমান। আর প্রায় ২৫ শতাংশই সাড়ে সাত ঘণ্টার কম ঘুমান বা অনিদ্রারোগে ভোগেন।
পরীক্ষা করে দেখা গেল, এই নারীরা অন্যদের তুলনায় ৫০০ থেকে ৮০০ ক্যালরির খাবার বেশি খেয়েছেন। আর এর মধ্যে শস্য বা সবজি জাতীয় খাবার নয়, বরং চিনিযুক্ত আর ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার খেয়েছন তারা।
আর কমবয়সী নারীরা যারা কম ঘুমিয়েছেন দেখা গেল তারাও নিম্ন মাণের ডেইরি বা দুগ্ধজাত খাবার খেয়েছেন। এর সঙ্গে প্রোটিন বা কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের কোনো সম্পর্কই নেই।
অপর্যাপ্ত ঘুম আর অস্বাস্থ্যকর ডায়েটের মধ্যে সম্পর্ক কি
গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে অত্যধিক খাবার গ্রহণের চাহিদা তৈরি করে আপনার শরীরে। ঘুম না হলে ক্ষুধা জাগাবে আর যেসব হরমোন আপনাকে পেট ভরার অনুভূতি দেয় তাদের কার্যকারিতা ভোঁতা করে দেয়।
ড. আগরওয়াল বলেন, " ঠিকমতো ঘুম না হলে শরীরের ক্ষুধাজাগানো হরমোনগুলো কাজ করে। ফলে ক্ষুধা লাগে, নিজের অজান্তেই অতিরিক্ত মুটিয়ে যাওয়ার দিকে এগোতে থাকেন আপনি।”
মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলটি খাদ্য গ্রহণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। অনিদ্রা আপনার মস্তিষ্কের এই অংশটাকে সাময়িক সময়ের জন্য ভোঁতা করে দেয়। মিষ্টি আর চর্বিজাতীয় খাবার খেলে হিপ্পোক্যাম্পাস বিষয়টা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায় আর আপনি এই সুযোগে আরও বেশি বেশি খেতে চান।”
ড. আগরওয়াল বলেন যে নারীরা স্থূলত্ব এবং অনিদ্রার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন কারণ সন্তান জন্মদানের মতো বিষয়গুলো তাদের শরীরে প্রভাব ফেলে। হরমোনের পরিবর্তনগুলি প্রাক-গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের পর বেশি প্রকট হয়।
আগরওয়াল বলেন, শিশু লালনপালন, মেনোপজ এবং অসুস্থ স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়া যেমন জীবনযাত্রা অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে আবার তেমনই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
তাহলে ভালো ঘুমের রহস্য কি
ভালো ঘুমের জন্য তাই ঘুম আর স্বাস্থ্যকর ডায়েটের বিষয়টা বুঝতে হবে বলে জানান গবেষক আগরওয়াল।
তবে কেন আপনার ঘুমের সমস্যা কেন হচ্ছে তা জানা দরকার। আপনি যদি দীর্ঘদিন ধরে অনিদ্রার সঙ্গে লড়াই করে থাকেন তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
আর এর পাশাপাশি ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশের বিষয়টিও জরুরি। এর মধ্যে আপনার শোবার ঘরটি হওয়া চাই অন্ধকার, শীতল। বাইরের আলো আর শব্দ যতটা আটকানো যায় ততই ভালো। আর অবশ্যই সেল ফোনটা লুকিয়ে রাখুন। এর নীল আলো ঘুম তাড়াতে ওস্তাদ।
একটা নিয়মতান্ত্রিক জীবনের কিন্তু সত্যিই কোন বিকল্প নেই। নিয়মিত গোসল, মেডিটেশন বা প্রার্থনা এক্ষেত্রে সহায়তা করবে আপনাকে। আর মোবাইল বা অন্য যেকোনো স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন ঘুমানর আগে।
আপনি একটি বায়ু-ডাউন রুটিনও বিকাশ করতে পারেন, যার মধ্যে ধ্যান করা, গোসল করা বা বিছানার আগে কিছুক্ষণ আগে আপনার ফোনটি বন্ধ করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
স্বাস্থ্যকর ডায়েট আপনার ঘুমকেও উন্নত করতে পারে। যেহেতু অনিদ্রাজনিত মহিলারা বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণের সম্ভাবনা থাকতে পারে, তাই অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ প্রতিরোধের এক উপায় হ'ল হালকা থালা - বাসন নির্বাচন করা। এটি কম ক্যালোরি খাওয়ার সময় এবং সন্তুষ্ট বোধ করার সময় বৃহত খাবারের অংশ গ্রহণের মঞ্জুরি দেয়, রিপোর্টে বলা হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের পুষ্টি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ডিরড্রে টোবিয়াস বলেছেন, "পর্যাপ্ত ডায়েট এবং ঘুমই আপনার দিনটি কেমন যাবে তা ঠিক করে দেয়।
"আমাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করে যে আমরা স্বাস্থ্যকর খাচ্ছি এবং প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘুমাচ্ছি। একটি তালিকা করুন, ঘুমের সময়টা ট্র্যাক করুন। তখন দেখবেন আপনি সত্যিই পর্যাপ্ত ঘুমুচ্ছেন কি না।”
ক্যালোরি কম থাকে ,তন্তুযুক্ত উপাদান আছে এমন খাবার যেমন ফলমূল এবং শাকসবজি, গোটা শস্য এবং ফলমূল, চর্বিযুক্ত মাংস, চর্বিযুক্ত মাছ এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি আপনার স্বাস্থ্য যেমন ভালো রাখবে, ভালো ঘুমেও সহায়তা করবে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর হেলথ এডুকেশনের গবেষক ড. মায়া অ্যাডাম বলেন, "ঘুম কোনও বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের মৌলিক প্রয়োজন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর তাই আরকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক প্রমাণ করে যে এদের মধ্যে ভারসাম্য থাকাটা কত জরুরি।”