আমাদের জীবনকালেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমাজন
এতকাল মানুষের হাতে প্রকৃতি বিনাশের সবচেয়ে পরিচিত রুপ ছিল বন উজাড়িকরণ। আমাজনেও একই ধবংসলীলা চালায় আমাদের দু'পেয়ে অতি-বুদ্ধিমান, অতি-লোভি প্রজাতি। তবে এবার মানুষের হাত থেকে সেরা বিনাশী শক্তির শিরোপা ছিনিয়ে নিতে আসছে জলবায়ু পরিবর্তন। আমাজন বন ধবংসে তার প্রভাবই এখন প্রধান কারণ হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এ যেন মানব সভ্যতা ও বিরূপ জলবায়ুর মধ্যে আমাজন গ্রাসের এক সর্বনাশা লড়াই। কিন্তু, মানুষের কুঠারে বনের শেষ মহাবৃক্ষ ধরাশায়ী হওয়ার আগেই, চূড়ান্ত আঘাতটি হানবে জলবায়ু পরিবর্তন। একজন গবেষক ইতোমধ্যেই আমাজনের মৃত্যুর তারিখও আভাস দিয়েছেন। ২০৬৪ সাল: হ্যাঁ এবছরেই আমাজন নিশ্চিহ্ন হবে চিরতরে, আজকের তরুণ প্রজন্মের যারা তখন পরিণত বয়সের হবেন- তারা দেখতে পারবেন সেই পরিণতি।
"শুনতে নাটকীয় লাগে কী! অবশ্যই, সেটা স্বাভাবিক। কারণ; আমি মহাপ্রলয়কে চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি," বলছিলেন সংখ্যাতাত্ত্বিক ভৌগলিক বিশেষজ্ঞ রবার্ট ওয়াকার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার সেন্টার ফর লাতিন আমেরিকা স্টাডিজের একজন গবেষক। ২০৬৪ সালের দিনক্ষণ তিনিই দেন। এব্যাপারে তার মন্তব্য, "অহেতুক ভয় দেখাতে বাড়াবাড়ি কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। বলছি না যে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। আমি তাই বলছি যা জলবায়ুর পরিসংখ্যান বিজ্ঞান আমাকে জানাচ্ছে।"
কয়েক দশক ধরে আমাজনের বর্ষাবন নিয়ে গবেষণা করেছেন ওয়াকার। বনের ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, প্রাকৃতিক চক্র আর জলবায়ু প্রভাব নিয়ে তার জ্ঞান সমাদৃত সংশ্লিষ্ট মহলে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুসারে আমাজন অঞ্চলে ক্ষরা, বন উজাড়িকরণ, বৃষ্টিপাতের ধরন ইত্যাদি তথ্য সমন্বয় করে মহাবনের মৃত্যুর আভাসটি দিয়েছেন।
তিনি জানান, সবগুলো প্রভাবক আমলে নিলে দেখা যায়- এসব বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে আসা অসহনীয় এবং ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে, আমাজন ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না। হারাবে বন বিস্তারের গতি, ব্যাহত হবে নানান প্রজাতির গাছের বংশবিস্তার। পূর্ণবয়স্ক গাছেদের মধ্যেও দেখা দেবে ভয়াবহ মড়ক। সবুজের সাড়ি হবে শ্মশানের বিরান ভূমি।
ওয়াকারের মতে, ২০৬৪ সাল নাগাদ বর্ষাবন বলে আর কিছু থাকবে না। বরং, এককালের মহাবনের জায়গা করে নেবে শুস্ক তৃণভূমি আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গল।
বিনাশের ধারাবাহিক গতি
চলতি শতকের গোড়ায় আমাজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বল্পসময়ের জন্য হলেও কিছুটা আশা দেখা দিয়েছিল। সেসময় অর্থাৎ, ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল নাগাদ হ্রাস পায় বন উজাড়ের হার। কিন্তু, তারপরে আবার মারাত্মক আকারে ফিরে আসে যান্ত্রিক করাতের দানব। আগুনকে সঙ্গী করে চাষবাস ও পশুচারণের জমি তৈরির জন্য পুড়িয়ে দেওয়া হয় মাইলের পর মাইল বিস্তৃত বনরাশি। ২০২০ সাল নাগাদ ব্রাজিলের আমাজন অংশে ধবংসলীলা পৌঁছে যায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ হারে।
২০১৮ সালেই বিজ্ঞানীরা জানান, আমাজন আর মাত্র ২০-২৫ শতাংশ বন উজাড় সহ্য করতে পারবে। তারপর বৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় আদ্রতা তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে পরিণত হতে থাকবে শুস্ক বাস্তুসংস্থানে। অর্থাৎ, গাছেদের অভাবে সলোকসাংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ফিরবে না পর্যাপ্ত জলীয়বাষ্প, যার অভাবে ভেঙ্গে পড়বে বৃষ্টিপাতের চক্র।
এরপর, ২০২০ সালে আরেকদল গবেষক ইতোমধ্যেই হারিয়ে যাওয়া বনের আকার নিয়ে সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেন। তাদের মতে, তখন পর্যন্ত উজাড় হয়েছে মোট বনের ১১ শতাংশ আর ১৭ শতাংশ হয়েছে ব্যাপক ক্ষতির শিকার। তাহলে; দেখা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই ২০-২৫ শতাংশের বেশি বনভূমি প্রভাবিত হয়েছে। তাহলে; ২৫ শতাংশ হিসাবের ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা হলো; ক্ষতির শিকার হওয়া আর বন উজাড় এক ঘটনা নয়। উজাড় হল; কৃষি ও চারণভূমির জন্য বৃক্ষরাজি সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা। অন্যদিকে, একটি ক্ষতিগ্রস্ত বন হলো; যেখানে আগুন লাগিয়ে, বনের মধ্যে রাস্তা বানিয়ে, কাঠ সংগ্রহের করাত মিল স্থাপন করে উজাড়ের কাজ পূর্ণ গতিতে চলছে। তারপরও কোনো রকমে টিকা থাকা বনই হলো ক্ষতিগ্রস্ত বন। সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার আগে এটাই হলো তার প্রাথমিক চিত্র।
ওই হিসাবে দেখা যায়, ১৭ শতাংশ বন এখন সেই প্রাথমিক স্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, অচিরেই এসব অঞ্চল বৃক্ষের আচ্ছাদন সম্পূর্ণভাবে হারাতে চলেছে।
এমন ধরনের বন যেসব আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে যায়, তার একটি হলো আগুন লাগিয়ে দেওয়া। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয় চারাগাছ। কোনো কোনো প্রজাতি বেঁচে যায়, কেউ হয় সম্পূর্ণরুপে নিশ্চিহ্ন। তারপর ক্ষতির শিকার বনে দেখা দেয় ভিনদেশি প্রজাতির ঘাসের আগ্রাসন। আসলে পশুপালকেরাই বনের আশেপাশের চারণভূমিতে এগুলোর বীজ রোপণ করে। পুড়ে যাওয়া গাছেদের কার্বন সমৃদ্ধ জমির দিকে তাই আপনা থেকেই এগোতে থাকে এসব ঘাস। স্থানীয় প্রজাতির গাছেদের চারার সঙ্গে পুষ্টি ও পানির জন্য অসম প্রতিযোগিতা শুরু করে ঘাসগুলো এবং ধীরে ধীরে তাদের মেরে ফেলে। অর্থাৎ, আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া চারা পরের পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়। আর সৃষ্টি হয় না নতুন বন।
যে বন প্রাকৃতিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সেখানে এমন ক্ষতি মাত্র কয়েক বছরেই পূরণ হয়। কিন্তু, ক্ষতিগ্রস্ত বা বিনাশের পথে থাকা বন কখনোই- তা পূরণ করতে পারে না। আমাজনেও তাই ঘটছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা মানুষেরা যে সর্বনাশ ডেকে এনেছি, তার বহুগুণ মূল্য এই জনমেই শোধ করতেও হবে।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন