আয়না ভাঙলে কি সত্যিই কোন বিপদ হয়?
প্রতিটি সভ্যতারই কিছু নিজস্ব কুসংস্কার আছে। এশিয়ার কিছু অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করে, সূর্যাস্তের পর ঘর ঝাড়ু দিলে এবং ভাতের থালায় চপস্টিক দাঁড় করিয়ে রাখলে অকল্যাণ হয়। আমেরিকায় কিছু মানুষ দুর্ঘটনাক্রমে কোনো মইয়ের নিচ দিয়ে হেঁটে গেলে বা চলার পথে কালো বিড়াল দেখলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এরকম অনেক কুসংস্কারের উৎসই অজানা। আবার ইতিহাসের গলি ধরে অনেক কুসংস্কারের উৎপত্তি সম্পর্কেও জানা যায়। ২ হাজার থেকে ৩ হাজার বছরের পুরনো একটি কুসংস্কার হচ্ছে, বাড়িতে কোনো আয়না ভাঙলে পরের সাত বছর ধরে দুঃখ-দুর্দশায় ভুগতে হয়।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে বিশ্বাস করা হতো, প্রতিবিম্বিত চিত্র রহস্যময় শক্তির আধার। আয়না ভাঙার কুসংস্কারটি সম্ভবত ওই যুগ থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
ঐতিহাসিক উৎস
গ্রীকরা বিশ্বাস করত পানিতে পড়া প্রতিবিম্বে মানুষের আত্মার স্বরূপ প্রকাশ পায়। তবে পালিশ করা ধাতব পৃষ্ঠ থেকে প্রথম আয়না তৈরি করতে শেখেন রোমান কারিগররা। রোমানরা বিশ্বাস করত, তাদের দেবতারা এসব আয়নার ভেতর দিয়ে মানুষের আত্মা দেখেন। আয়নার কোনো ক্ষতি করাকে তারা ভীষণ অসম্মানজনক মনে করতেন। রোমানদের বিশ্বাস ছিল, কেউ আয়নার ক্ষতি করলে দেবতারা তার ওপর দুর্ভাগ্যের বৃষ্টি বর্ষণ করেন।
তৃতীয় শতাব্দীর দিকে কাচ থেকে আয়না তৈরি শুরু হয়। তখন কাচের আয়না ভেঙে যাওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তবে রোমানদের বিশ্বাস ছিল যে সাত বছর পর দুর্ভাগ্য কেটে যায়।
সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উৎস
মানবমন অনবরত অচেতনভাবে প্যাটার্ন খুঁজতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রাস্তা পার হওয়ার সময় পরিচিত ট্র্যাফিক প্যাটার্ন দেখে আমরা দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের বাঁচাই।
তবে আমাদের মস্তিস্ক কখনও কখনও অবাস্তব কিছু প্যাটার্নও গঠন করে। ধরুন, কোনো বন্ধু আপনাকে একটা সৌভাগ্য আনার মুদ্রা দিল। আপনি এসবে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু পরের কয়েকটা দিন আপনার ভালো গেল। ব্যাপারটা স্রেফ কাকতাল হলেও আপনার মস্তিষ্ক নতুন একটা প্যাটার্ন তৈরি করে নিল। আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে বন্ধুর দেওয়া মুদ্রার জন্য আপনার কপাল ভালো যাচ্ছে। এভাবেই জন্ম হলো একটি কুসংস্কারের।
সামাজিকীকরণের সময় বাবা-মা বা অন্য বিশ্বস্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু কুসংস্কার পাই। এভাবে কিছু কুসংস্কার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের সাহায্যে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। যত বেশি মানুষ এসব কুসংস্কারকে সমর্থন দেয়, এগুলো তত বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব লাভ করে।
উপকারী নাকি ক্ষতিকর
কুসংস্কারের কারণে আমরা যদি আয়না নাড়াচাড়া করার সময় সাবধান থাকি, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। মোটা দাগে কঠিন পরিস্থিতিতে কুসংস্কার আমাদের মানসিক চাপ কমিয়ে কাজের মান বাড়াতে পারে। কুসংস্কার কখনও কখনও বেশ মজাদারও হয়। এগুলো নিয়ে দারুণ আড্ডা দেওয়া যায়, ফলে পারস্পরিক বন্ধন বাড়ে।
অবশ্য মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। কুসংস্কারের জন্য অনেকসময় আমরা মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকি। কুসংস্কার এমন কিছু মিথ্যা বিশ্বাস, যা প্রায়ই আমাদের মনে উদ্বেগ ও অপরাধবোধ সৃষ্টি করে। অনেক সময় কোনো ঘটনার জন্য কুসংস্কারের বশে আমরা অযথাই নিজেদের দায়ী করি, কিংবা প্রত্যাশিত ফললাভের জন্য ভুল পথ ধরি। তখন কুসংস্কার আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।
- সূত্র-স্ক্রল ডট ইন