ওষুধ ছাড়াই উচ্চ রক্তচাপ কমাবেন যেভাবে
ডাক্তারের চেম্বারে রক্তচাপ পরীক্ষা করতে গেলে ডাক্তার আপনাকে একটি রক্তচাপ নির্দেশক সংখ্যা দেবে । ছোট্ট ওই সংখ্যা যে কতটা তৎপর্য বহন করতে পারে সেটি সব সময় আপনি অনুভব নাও করতে পারেন!
উচ্চ রক্তচাপের দৈনন্দিন ভিত্তিতে কোন লক্ষণ নেই, লক্ষণগুলো দৃশ্যমানও নয়। অথচ হার্ট এটাক, স্ট্রোক, এমনকি কিডনি বিকল পর্যন্ত হয়ে যেতে রক্তের চাপের সামান্যতম তারতম্যের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রে তো দিনে হাজারেরও বেশি মৃত্যুর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ এই উচ্চ রক্তচাপ।
আরও ভয়াবহ হলো, প্রতি পাঁচজনের ভেতর একজন জানেই না যে, কি ভয়ংকর অসুখ নিয়ে সে বেঁচে আছে। দুই বছরেও যদি ডাক্তারের কাছ থেকে আপনার রক্তচাপ সম্পর্কে না জেনে থাকেন তবে আর দেরি না করাই অনুচিত। ১৩০/৮০ মিমি পারদের ওপরে উঠলেই বিপদ!
হ্যাঁ ওষুধে নিস্তার মিলতেই পারে, তবে তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এসেও যোগ হবে।
পা ব্যথা করতে পারে, মাথা ঘুরাবে, অনিদ্রাও ভর করতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ ওষুধ ছাড়াই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম।
সবার আগে নিশ্চিত করুন আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিনা। বর্ধিত ওজন থাকলে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে আগে এটির উপর নিয়ন্ত্রণ আনুন।
এরপর নিচের ব্যাপারগুলোর দিকে একটু খেয়াল করুন-
- হাঁটুন দ্রুত
৪০০ টি সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, দ্রুত হাঁটার ফলে দেহে যে উপকার হয় তা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ওষুধের সমতুল্য। শরীরচর্চার ফলে হৃদপিন্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অধিক অক্সিজেন ব্যবহার করে । ফলে রক্ত পরিশোধনের সময় এর উপর অধিক চাপ পড়ে না।
প্রতিদিন আধা ঘন্টার জন্য হলেও কার্ডিও করুন, যা হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করবে।
- শ্বাস নিন দীর্ঘ
আমরা যখন চাপে থাকি তখন আমাদের শরীর রক্তে কর্টিসল, এড্রেনালিনের মত স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে। এই হরমোনগুলো হৃদপিন্ডের গতি বাড়িয়ে তুলে, রক্তনালীকে সংকুচিত করে রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে। ইয়োগা, তাই চি'র মতো কিছু শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম স্ট্রেস হরমোনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে রক্ত চাপ কমায়।
শুরুটা করুন প্রতিদিন সকালে মাত্র পাঁচ মিনিট চর্চার মাধ্যমে, রাতেও ঘুমুতে যাবার সময় ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ার অভ্যাস করুন পাঁচ মিনিটের জন্য।
- পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বাছাই করুন
রক্তচাপ কমাতে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি বোঝাই খাদ্য তালিকা বাছুন। পটাসিয়াম আমাদের কিডনিকে প্রস্রাবের মাধ্যমে সোডিয়াম নির্গমনে সহায়তা করে। অতিরিক্ত সোডিয়ামের নির্গমন রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
কলায় প্রচুর পটাসিয়াম থাকে; তবে যাদের কাছে কলা পছন্দের নয় তাদের জন্যও কিন্তু প্রকৃতি অন্যান্য ব্যবস্থা করে রেখেছে। আলুতে যেকোন হলুদ ফলের চাইতে অধিক পটাসিয়াম থাকে। মিষ্টি আলু, টমেটো, কমলার জুস, কিডনী বীন, মটরশুঁটি, বাঙ্গি, কিসিমিস ও অন্যান্য শুকনো ফল পটাসিয়ামের ভাল উৎস। প্রতিদিন দুই হাজার থেকে চার হাজার মিলিগ্রাম পটাসিয়াম গ্রহণ করা উচিত বলে জানান নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ফিনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিনের প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের একজন অধ্যাপক লিন্ডা ভন হর্ন।
- সোডিয়াম থাকুক নিয়ন্ত্রণে
বয়স্ক, আফ্রিকান-আমেরিকান এবং যাদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস আছে, তাদের অনেকেরই লবণ থেকে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ঠিক কারা এমন 'সল্ট-সেনসিটিভ' সেটি স্পষ্টভাবে বোঝা না যাওয়ায় সবারই নিয়ন্ত্রিত উপায়ে সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত বলে জানালেন, ন্যাশনাল হার্ট, লাংগস এবং ব্লাড ইনস্টিটিউটের গবেষণা পুষ্টিবিদ ইভা ওবারজানেক।
আমেরিকান হার্ট ইনস্টিটিউট বলছে, প্রতিদিন ১৫০০ মিলিগ্রামের নিচে সোডিয়াম গ্রহণের মাত্রা সীমিত রাখা উচিত। প্রতিদিন আমেরিকানরা যতটুকু সোডিয়াম গ্রহণ করে থাকে এটি তার অর্ধেক পরিমাণ। কেবল কাঁচা লবণের কথা হচ্ছেনা; মানুষ ভুলে যায় প্রতিদিন কী পরিমাণ প্রক্রিয়াজাত খাবারের আড়ালে তারা সোডিয়াম গ্রহণ করে যাচ্ছে।
- ডার্ক চকলেটের মজা
মিষ্টি খাবারে ফ্লেভানল থাকে যা রক্তের চাপ কমিয়ে রক্ত প্রবাহকে সচল রাখতে সাহায্য করে। অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিয়মিত ডার্ক চকলেট খেলে সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার ৫ পয়েন্ট পর্যন্ত এবং ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেসার ৩ পয়েন্ট পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
ডার্ক চকলেট কতখানি 'ডার্ক' হবে? সত্যি কথা বলতে বিশেষজ্ঞরা এখনো কোকো গ্রহণের আদর্শ পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেন নি। কিন্তু এর পরিমাণ যত বেশি হবে, ততই ভাল।
অবশ্যই রক্ত চাপ কমানোর জন্য আপনাকে দিনভর চকলেট চিবোতে হবে ব্যাপারটা তা নয়। তবে হ্যাঁ যখনই একটু মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হবে তখন হাতটা ডার্ক চকলেটের দিকেই বাড়ানোর চেষ্টা করবেন ।
- ডিক্যাফ কফির দিকে ঝুঁকুন
রক্তে ক্যাফেইনের প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীদের তর্ক বহুদিনের। ৩৪টি সমীক্ষা বিশ্লেষণ শেষে অবশেষে বোধহয় একটা উপসংহারে আসা গেল। গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম ডিক্যাফ ( যা এক থেকে দুই কাপ কফিতে মেলে) সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার বাড়াবে ৮ মিমি পারদ এবং ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেসার বাড়াবে ৬ মিমি পারদ পর্যন্ত। এই প্রভাব থেকে যাবে ক্যাফেইন গ্রহণের পর তিন ঘন্টা পর্যন্ত।
ডিউক ইউনিভার্সিটির ক্যাফেইন এবং কার্ডিওভাস্কুলার হেলথ এর গবেষক জেমস লেন এর মতে, ক্যাফেইন রক্তনালীগুলোকে দৃঢ় করার মধ্য দিয়ে রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে।
"আপনি যখন অবসাদগ্রস্ত থাকেন, আপনার হৃদযন্ত্র তখন আরও বেশি পরিমাণ রক্ত পরিশোধনের মাধ্যমে রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে। ক্যাফেইন এই প্রভাবকে বর্ধিত করে তোলে।"
- চায়ে চুমুক
টুফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, মধ্যমাত্রায় উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, এমন বয়স্করা যদি দিনে তিন কাপ করে জবা ফুলের নির্যাস সমৃদ্ধ চা পান করতে পারে, তবে ছয় সপ্তাহে সাত পয়েন্ট পর্যন্ত সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার কমানো সম্ভব। জবাতে উপস্থিত ফাইটোকেমিক্যালস এই বিপুল পরিমাণ উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সক্ষম বলে অনুমান গবেষকদের।
- কাজের চাপ ( একটুখানি) কমান
ক্যালিফোর্নিয়ার ২৪ হাজার অধিবাসীর ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে ৪১ ঘন্টার ওপরে অফিস ডিউটি হাইপারটেনশানের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে ১৭ শতাংশ। এই গবেষণার প্রধান গবেষক হাইউ ইয়াং জানান, অত্যধিক কাজ মানুষকে শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণে বিমুখ করে তোলে।
যদি একেবারেই দিনে এক্সারসাইজের সুযোগ না পান, তাহলে অন্তত অফিস থেকে এমন একটা সময় বের হোন যেন কিছুটা সময় জিমে ঘাম ঝরাতে পারেন বা বাড়ি গিয়ে নিজের জন্য স্বাস্থ্যকর কোন রেসিপি তৈরী করতে পারেন। কম্পিউটারে একটা 'রিমাইন্ডার' দিয়ে রাখতে পারেন; কখন নীল স্ক্রিন বন্ধ করে বাড়ি যেতে হবে তা ভালভাবে মনে করিয়ে দেবে এই সংকেত।
- সংগীতে শান্তি
ইতালির গবেষণা বলে, সুরের তালে রক্তচাপও নামে। রক্তচাপের চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন ২৯ জনকে গবেষকরা প্রতিদিন আধা ঘন্টা করে ক্ল্যাসিক্যাল, সেল্টিক বা ভারতীয় সংগীত উপভোগের জন্য বলেন। ছয় মাস পর দেখা গেল, তাদের রক্ত চাপ গড়ে ৪ মিমি পারদ পর্যন্ত নেমেছে।
- নাক ডাকা সমস্যায় সমাধান খুঁজুন
আপনি নাক ডাকছেন অথচ ঘুমুতে পারছে না পাশের সঙ্গীটি। তাঁর অভিযোগ অবহেলা না করে এবার সত্যিই একটু সচেতন হোন। উচ্চ মাত্রায় অবিরত নাক ডাকার সমস্যা কিন্তু অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ এপনিয়ার (ওএসএ) মত গুরুতর ঘুমের সমস্যার লক্ষণ।
অনেক স্লিপ এপনিয়া ভুক্তভোগীর মাঝে উচ্চ মাত্রার এল্ডোস্টেরন থাকে; এটি এমন এক হরমোন যা রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে। ইউনিভার্সিটি অফ এলাবামার গবেষকবৃন্দ এটি প্রকাশ করেছে।
ঘুমের সমস্যার সমাধান করলে রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণও সম্ভব।
- এক গ্লাস দুধ
প্রাণিজ হোক বা সয়া- সে ইচ্ছে আপনার । খাবারে পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট এর বদলে যদি সয়া বা মিল্ক প্রোটিন সমৃদ্ধ (টফু বা লো ফ্যাট ডেইরি) কিছু যুক্ত করতে পারেন , তাহলে হাইপারটেনশানের রোগীরা সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। দিনে অন্তত একগ্লাস দুধ খান।
সূত্রঃ প্রিভেনশন