করোনাকালে কাচ্চি কেন্দ্রিক অর্থনীতি
বৈশ্বিক এই আধুনিকায়নের যুগে আগ্রাসী সব নতুনত্বের ভিড়ে যখন ধীরে ধীরে জাদুঘরে ঠাঁই পাচ্ছে নানান অঞ্চলের সব ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সংস্কৃতি, তখন করোনাকালে আগ্রাসী আধুনিকায়নের ভিড়েও বেশ দাপটের সঙ্গে টিকে আছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ 'ঢাকাই বিরিয়ানি'।
দেশ এবং দেশের বাইরেও সমানভাবে সাধারণ ভোজনরসিক থেকে শুরু করে ফুড ব্লগারদের আজও আকৃষ্ট ও তৃপ্ত করে যাচ্ছে ঢাকাই বিরিয়ানি, যা কেন্দ্র করে বিরিয়ানি ব্যবসায়ীদের বাইরেও চলছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনচক্র।
শুক্রবার দুপুরে পুরান ঢাকার বংশালের আবুল হাসনাত রোডে গেলে ঢাকাই বিরিয়ানির আধিপত্যের চিত্র দেখা যায় আরো স্পষ্টভাবে।
করোনাকালেও শীতের দুপুর গড়িয়ে বেলা সাড়ে ৩ টা বাজেও আবুল হাসনাত রোডে খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকা কোলকাতা কাচ্চি ঘর, গ্র্যান্ড নবাব ও সুলতান'স ডাইনের বাইরে দেখা মেলে ঢাকাই বিরিয়ানির স্বাদ নিতে অপেক্ষায় থাকা নানান বয়সের, নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের দীর্ঘ সারি।
বিরিয়ানির দোকানগুলোকে হিমশিম খেতে দেখা যায় দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা ভোজনরসিক মানুষদের বসার জায়গা করে দিতে। একসাথে অনেক লোকের বসার মতো অবকাঠামো সেখানকার কোনো বিরিয়ানি ঘরে না থাকায় স্বাস্থ্যবিধির কথা ভুলে গিয়ে অনেকটা গাদাগাদি করেই বসতে হয় বিরিয়ানি স্বাদ পেতে আসা মানুষদের।
ডেলিভারি ম্যান
আবুল হাসনাত রোডের প্রায় সবগুলো বিরিয়ানির দোকানের সামনে খাবারের অপেক্ষায় থাকা মানুষের পাশাপাশি দেখা মেলে নানান প্রতিষ্ঠানের ফুড ডেলিভারি ম্যানদের। কোলকাতা কাচ্চি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত ফুডপান্ডার ডেলিভারি ম্যান মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'লকডাউনের কারণে বিরিয়ানির দোকানে এসে বিরিয়ানি খাওয়া মানুষের সংখ্যার সঙ্গে সমানতালে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে অনলাইনে থেকে খাবার অর্ডার করা মানুষের সংখ্যা। যেখানে আগে দিনে তার ডেলিভারি এলাকার একেকজন ডেলভারি বয় ৬ থেকে বড়জোর ১০ টা ডেলিভারির অর্ডার পেত, সেখানে এখন সেই অর্ডার হয়েছে দ্বিগুণ এবং প্রায় বেশিরভাগ অর্ডারই আসে ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু দোকানের বিরিয়ানির জন্য'।
ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু দোকানের খাবারের অর্ডার আসার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'ঢাকাই বিরিয়ানির চাহিদা আশেপাশের এলাকায় সব সময়ই বেশি ছিল। একে তো সুলভমূল্যে মুখরোচক খাবার এবং সুলতান'স ডাইন, কোলকাতা কাচ্চি, গ্র্যান্ড নবাব ভালো মানের সাথে পরিমাণেও বেশি খাবার দেয়, তাই এই দোকানগুলোর খাবারের চাহিদা বেশি'।
তিনি জানান, প্রতিদিন আনুমানিক ২ হাজারেরও বেশি মানুষ অনলাইনে পুরান ঢাকার নানান দোকানের বিরিয়ানি অর্ডার করেন এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন তা আরো বেড়ে যায়।
তিনি আরো জানান, ৩ কিলোমিটার এলাকার ভেতর প্রতিটি ডেলিভারি থেকে ৬০ টাকা করে আয় করে একেকজন ডেলিভারি ম্যান। শুধুমাত্র পুরান ঢাকাতেই ২'শ ফুড ডেলিভারি ম্যান আছে নানা প্রতিষ্ঠানের। যাদের অধিকাংশের আয়ের অন্যতম বড় উৎস হচ্ছে মানুষের বাড়িতে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি পৌঁছে দেওয়া।
মাহমুদ বলেন, 'করোনায় সময় কর্মসংস্থান হারানো অনেকেই একটা সাইকেল আর স্মার্টফোনকে সম্বল করে ফুড ডেলিভারি করার মাধ্যমে পুনরায় অর্থনৈতিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছেন'।
ফুড ব্লগার
ঢাকাই বিরিয়ানির স্বাদ পেতে আসা মানুষ এবং ফুড ডেলিভারি বয় ছাড়াও আরেক ধরণের মানুষের আনাগোনা আজকাল খেয়াল করা যায় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার দোকানগুলোতে। তারা ইউটিউব ভিত্তিক ফুডব্লগার। গ্র্যান্ড নবাবে খেতে বসা ৫ জনের একটি ফুড ব্লগার দলের সঙ্গে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দলটি জানায়, তারা প্রায় ৬ মাস ধরে ফুড ব্লগিং করছে। ইউটিউব জগতে পুরান ঢাকার জীবনযাত্রা নিয়ে যেকোন ভিডিও'র প্রতি মানুষের আগ্রহ বরাবরই বেশি থাকে, খাবারের ক্ষেত্রে সেটা আরো বেশি। শুধু দেশের মানুষের নয়, অন্যান্য নানান দেশের মানুষেরও প্রবল আগ্রহ রয়েছে ঢাকাই খাবারের প্রতি। এমনকি ইউটিউবের জনপ্রিয় চ্যানেল দ্যা ফুড র্যাঞ্জার এবং বেস্ট এভার ফুড রিভিউ শো বাংলাদেশে এসে ইউটিউবে ঢাকাই বিরিয়ানির রিভিউ দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে কাছে থেকে। তাই তাদের চ্যানেলটিও ইউটিউবে মানুষের নজরে আসার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন পুরান ঢাকার খাবার রিভিউ করা।
ফুড রিভিউতেই আগ্রহ কেন তৈরি হলো তাদের- এই প্রশ্নের জবাবে দলটি জানায়, দেশে ইন্টারনেট সেবা এবং স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ার পর থেকেই তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে শিশুরা পর্যন্ত বিকল্প বিনোদন মাধ্যম হিসেবে ঝুঁকেছে ইউটিউবের দিকে। এর ফলে ভালো ক্যামেরা দিয়ে আইনসিদ্ধ যেকোনো কিছুর ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে পাওয়া যায় অগণিত দর্শক এবং একটা ভিডিও যত বেশি মানুষ দেখে তার উপর নির্ভর করে ভিডিও'র চ্যানেলে আসা বিজ্ঞাপনের সংখ্যা। যত বেশি বিজ্ঞাপন, তত বেশি আয়। দলটি জানায়, দেশে এমন বেশ কয়েকজন ফুড ব্লগার আছেন যারা প্রত্যেক মাসে ইউটিউবে শুধু খাবারের রিভিউ করেই প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি আয় করে। দলটির প্রত্যেকেই ঢাকার পৃথক কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থী, তারা জানায় করোনায় কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে অবসরে করার মতো কিছু না পাওয়ায় তারা ভাবছিলো ইউটিউব চ্যানেল শুরু করার কথা। পরবর্তীতে পুরান ঢাকার খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে তারা শুরু করে পুরান ঢাকার খাবার রিভিউ করা। তাদের ৬ মাস বয়সী ইউটিউব চ্যানেলটি গত ৩ মাস আগে প্রথম আয়ের মুখ দেখেছে এবং সে আয় বেড়েই চলছে ক্রমাগত।
রিক্সা চালক
কোলকাতা কাচ্চি ঘরের উদ্দেশ্যে আসা দুজন যাত্রীকে গন্তব্যে নিয়ে আসা রিক্সাচালক ফরহাদ মিয়া দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিনি ৩ বছর ধরে সদরঘাট এলাকায় রিক্সা চাচ্ছেন। লকডাউন উঠিয়ে নেবার পর থেকে প্রতিদিনই প্রায় ১০ থেকে ১৫ বার এলাকার নানান প্রান্ত থেকে তার যাত্রী বহন করে আনতে হয় পুরান ঢাকার বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকানগুলোতে। লকডাউনের আগে স্কুল কলেজ খোলা থাকা অবস্থায় বিরিয়ানি খেতে আসা মানুষবাহী রিক্সার জ্যামের কারণে কম দূরত্বের রাস্তা অতিক্রম করাও সময়সাপেক্ষ বিষয় ছিল। তিনি আরো জানান, শুধুমাত্র বিরিয়ানি খেতে আসা যাত্রীদের পারাপার করেই প্রতিদিন তার আয় হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার কাছাকাছি।
ঐতিহ্যের নামে প্রতারণা
ঢাকাই বিরিয়ানির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি নাম- হাজী বিরিয়ানি। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পুরান ঢাকার বিরিয়ানি বলতে নানান অঞ্চলের মানুষ জেনেছে কেবল হাজী বিরিয়ানির নাম। ১৯৩৯ সালে হাজী মোহাম্মাদ হোসেন মাত্র ১ হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে শুরু করেন বিরিয়ানি ব্যবসা। অনন্য স্বাদ আর মানের কারণে দ্রুতই সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে শুরু করে হাজী বিরিয়ানির খ্যাতি। কালক্রমে হাজী মোহাম্মাদ হোসেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র হাজী গোলাম হোসেন ধরেন ব্যবসার হাল।
২০০৬ সালে হাজী গোলাম হোসেনের মৃত্যুর পর হাজী বিরিয়ানির হাল ধরেন হাজীর নাতি হাজী মোহাম্মদ শাহেদ হোসেন ও হাজী মোহাম্মদ বাপী। এখন পর্যন্ত পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের ৭০, কাজী আলাউদ্দিন রোডে হাজী বিরিয়ানীর প্রধান বিক্রয় কেন্দ্র ছাড়া ৯৯, মতিঝিল এবং ক-১১/৬, এ, বসুন্ধরা রোড, বারিধারায় রয়েছে হাজীর বিরিয়ানির দুইটি শাখা। অথচ ঢাকাই বিরিয়ানির ঐতিহ্য এবং হাজী বিরিয়ানির খ্যাতি ব্যবহার করে সমগ্র রাজধানী জুড়ে হাজারো অসাধু ব্যবসায়ী শুরু করেছে হাজী বিরিয়ানির নামে কোটি টাকার ব্যবসা। যার কোনোটাই মানে অথবা স্বাদে হাজী বিরিয়ানির ধারে কাছেও নেই। তাদের অসাধু কৌশলের কারণে ঢাকাই ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী ক্রেতারা নকল হাজীকেই আসল হাজী বিরিয়ানি ভেবে প্রতারিত হচ্ছে রোজ। এর ফলে ভ্রান্তি থেকে একদিকে আসল হাজী বিরিয়ানিতে আসা মানুষের সংখ্যা যেমন কমছে তেমনই সেসব বিরিয়ানি ঘরের মান ও স্বাদের সীমাবদ্ধতার কারণে ঢাকাই খাবারের ঐতিহ্যের প্রতিও আগ্রহ হারানো শুরু করেছে মানুষ। অন্যদিকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে সুযোগ সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার দোকানগুলোতে প্রতিদিন কত মানুষ খাবার গ্রহণ করে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কেউই সঠিক তথ্য প্রদান করতে রাজি না হলেও আবুল হাসনাত রোডের স্থানীয়দের দাবী- গড়ে অন্তত ৮০০ থেকে ১২০০ মানুষ প্রতিদিন খাবার গ্রহণ করে ঐতিহ্যবাহী ও বাহারি ঢাকাই বিরিয়ানির একেকটা দোকানে। যেখানে খাবার বাবদ জনপ্রতি গড়ে খরচ করেন ২৫০ টাকা করে।