কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের আশা নেই এখনই
কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা অর্জনের ধারণাকে ঘিরে আশায় বুক বেঁধেছেন বিশ্ববাসী। গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা (হার্ড ইমিউনিটি) অর্জনের মাধ্যমেই মহামারির অবসানের আশা করছেন অনেকেই।
তবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সহজ হবে না, এই দুঃসপ্নের অবসান এভাবে হওয়ার সম্ভাবনাও কম। যদিও শীতের পর সংক্রমণের হার কমে আসছিল, আবারও অধিক সংক্রামক স্ট্রেইন ছড়িয়ে প্রায় সংক্রমণের হার বাড়ছে বিভিন্ন দেশে। সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়, অন্যথায় সংক্রমণ হার বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার পথেই এগোবে পরিস্থিতি।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এখনই, শুধু এই মহামারির জন্যই নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মহামারির জন্যও সতর্কতা ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে।
টিকাদান বা আগেই সংক্রমণের মাধ্যমে কোনো দেশ বা অঞ্চলের নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হলেই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন হয়। কারণ যতো কম মানুষের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ হয়, ভাইরাস সংক্রমণ কমে আসবে, ধীরে ধীরে ওই অঞ্চলে ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকবে না আর।
কোনো রোগের সংক্রমণ হারের ওপর নির্ভর করছে ওই অঞ্চলের কতো শতাংশ মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব হবে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশ বা অঞ্চলের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষের কোভিডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে অনাক্রম্যতা অর্জন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫০ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হবে। এখন পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা ৫ লাখ ৯১ হাজার ৮০৬। আরও অনেক মানুষই আক্রান্ত হয়েছেন যারা টেস্ট করাননি, ফলে সেই হিসাবও জানা যায়নি। তবে সব মিলিয়েও দেশের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ গড়ে উঠতে আরও অনেক সময় লাগবে, এর অনেকটা নির্ভর করছে দেশের টিকাদান কর্মসূচি কতো দ্রুত এগোয় তার ওপর।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এখনো ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে আরও অনেক সময় লেগে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের আক্রান্ত ও টিকাদানের হিসাবে মাত্র ৪৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কোভিডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
এখানে আরেকটি বড় ব্যাপার হল ভাইরাসের অধিক সংক্রামক নতুন স্ট্রেইনের সংক্রমণ। এতো দ্রুত বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন স্ট্রেইনের উৎপত্তি হচ্ছে, এক ধরনের স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলেও, অন্য স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কাজ করবে না ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।
সংক্রমণ, এমনকি টিকাদানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করবে এমন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও যুক্তরাজ্যের অধিক সংক্রামক স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়েছে।
সংক্রমিত অন্যান্য প্রাণী থেকে মানবদেহে সরাসরি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু মানুষ, গৃহপালিত প্রাণী ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে পারস্পরিক সংক্রমণ ছড়িয়ে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন মহামারিবিদরা।
টিকাদানের হারেরে ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। এখন পর্যন্ত শুধু ১৮ বছর ও ততোর্ধদেরই টিকা দেওয়া হচ্ছে, বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণেও অনেকে টিকা নিতে পারছেন না। এছাড়াও টিকার প্রতি সংশয়ের কারণে টিকা নিতে আগ্রহী নন বড় একটি অংশ, এটিই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ।
তবে বিশ্বজুড়ে অনাক্রম্যতা অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ভ্যাকসিনের প্রতি সংশয় বা ভাইরাসের অধিক সংক্রামক স্ট্রেইন নয়, বরং ভ্যাকসিন সহজলভ্য না হওয়াই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য গঠিত জোট কোভ্যাক্স মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করছে, তবে অর্থায়ন সংকটে পড়েছে কোভ্যাক্স। ২০২১ সালের ২ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রাও ব্যহত হতে পারে।
সবকিছু বিবেচনায় ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন অন্তত কয়েক বছর বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ টিকাদানে আওতায় আসবেন না। ফলে ভাইরাসের নতুন ধরনের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। অধিক সংক্রামক ধরনের সংক্রমণে সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে আগামী কয়েক বছর হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।