চরম উষ্ণতায় বেঁচে থাকাই দায় হবে পৃথিবীর কোটি মানুষের
চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রায় জীবনধারণে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে মানবদেহ। এই বিবর্তন প্রধানত দুইভাবে গড়ে উঠেছে; প্রথমত আমাদের রক্তনালী প্রসারিত হয়, যার ফলে ত্বকের মাধ্যমে তাপের বিকিরণ ঘটে। দ্বিতীয়ত, গরমে আমাদের শরীর ঠাণ্ডা করতে নির্গত হয় ঘাম, যা বাতাসে দ্রবীভূত হলে আমরা শীতলতার অনুভূতি লাভ করি। এসব প্রক্রিয়া যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু, শুনতে সরল মনে হলেও, এমন ব্যর্থতা আসলে এক জটিল ও ধারাবাহিক বিপর্যয়ের কারণেই হবে।
যেমন, হিটস্ট্রোকের শিকার কোনো ব্যক্তির দেহের প্রসারিত নালীতে রক্ত সঞ্চালন পূর্ণ রাখতে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। এক পর্যায়ে হৃৎপিণ্ডের পক্ষে আর কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। তখন রক্তচাপ কমে যায়, ফলে ওই ব্যক্তি মাথা ঝিমঝিম করা, অবসন্নতা, চলাচলে তাল হারিয়ে পড়ে যাওয়া এবং বাক্য জড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রতিক্রিয়ার শিকার হন। শরীরে লবণের অভাব দেখা দেয় ও মাংসপেশি সংকুচিত হয়। বিভ্রান্তি ও ভ্রমের এই দশায় অধিকাংশ ভিক্টিম বুঝতেই পারেন না যে তাদের জরুরি সাহায্য দরকার।
একইসময়, অতি-উত্তপ্ত ত্বকে রক্তের সঞ্চালন বাড়তে থাকায়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এটির প্রবাহ ব্যাহত হয়। এতে শরীরে যে চাহিদা দেখা দেয় তার ফলে কোষের বিভাজন বেড়ে যায়। তাই হিটস্ট্রোকের শিকার অনেক ব্যক্তিই মাত্র ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রায় প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য ১০৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত দেহের অভ্যন্তরে তাপবৃদ্ধি কয়েক ঘণ্টা ধরে সহ্য করতে পারেন।
তবে শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের সহ্য ক্ষমতা বেশি নয়। এমনকি বেশি বয়সের অনেক সুস্থ মানুষও তাপ সহ্য করার দিক থেকে চরম অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কারণ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘামগ্রন্থি সংকুচিত হয়, আবার নানা রকম ওষুধের প্রতিক্রিয়াতেও কমে যায় সংবেদনশীলতা। এই অবস্থার শিকার অনেকেই তাপদাহের আক্রান্ত হয়েও তৃষ্ণা অনুভব করেন না। আবার ঘাম নির্গমন বন্ধ থাকায় ত্বককে আর্দ্রতার সুরক্ষা দেওয়ারও উপায় থাকে না শরীরের। তার বদলে থেকে থেকে কাঁপুনি অনুভব করেন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি।
শরীরের হীনবল এ অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৃষ্টিসীমা সঙ্কোচন, হ্যালুসিনেশন হয়। স্নায়ুগ্রন্থির উপরিভাগ চরম উত্তপ্ত হওয়ায় মনে হয়ে সারা শরীরে আগুন লেগেছে। এতে করে অনেকেই শরীর থেকে পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন। এমন অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি দেয়; কারণ তাতে করে, রক্তনালীর প্রসারণ কমতে থাকে, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য পেশিটিস্যুর প্রসারণও কমে।
তবে আসল আঘাত আসে তারপরেই। এসময় পাকস্থলীর নালী ছিদ্র হয়ে বিষাক্ত জৈব-রাসায়নিক রক্তনালীতে অনুপ্রবেশ করে। রক্ত সঞ্চালনে যার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক; রক্ত জমাট বেঁধে এসব তেজস্ক্রিয় উপাদানের আগ্রাসন ঠেকানোর শেষ চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কিডনি, মূত্রথলী, হৃৎপিণ্ডের মতো অতি-গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই পর্যায় মৃত্যুর আগ মুহূর্তের।
এভাবে প্রতিবছর ভয়াবহ এই মৃত্যু যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ। মানব সভ্যতার অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনই যার প্রধান কারণ। বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে তাপপ্রবাহ এমন মাত্রায় বেড়েছে, যার ফলে অনেক অঞ্চল মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। আবার, হঠাৎ করে তাপ বৃদ্ধির ফলেও সেটা তুলনামূলক শীতপ্রধান দেশের মানুষের জন্যেও অসহনীয় হয়ে উঠছে।
শীতপ্রধান দেশে তাপপ্রবাহে প্রথম বড় বিপর্যয়
২০০৩ সালের গ্রীষ্মে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ বাড়ে। এসময় ভূমধ্যসাগরের ওপরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা বাতাস আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আসা শীতল বায়ুপ্রবাহকে প্রতিহত করে কয়েক সপ্তাহ ধরে। এ অবস্থায় ফ্রান্সের মতো কিছু দেশে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। টানা আটদিন ধরেই তাপ বৃদ্ধির রেকর্ড হয়ে এক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় মৃত্যুও বাড়তে থাকে।
ওই সময় বেশিরভাগ চিকিৎসক ও প্রাথমিক সেবাদানকারী গ্রীষ্মের ছুটিতে ছিলেন। তারা ছুটি কাটিয়ে ফিরতে ফিরতেই সব হাসপাতাল রোগীতে ভরে যায়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগীর চাপ কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। ফলে মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। লাশে ভরে উঠতে থাকে মর্গগুলোও।
এক পর্যায়ে রেফ্রিজারেটর ট্রাক ও বড় আকারের ডিপ ফ্রিজার ব্যবহার করে মরদেহ সংরক্ষণ করতে হয়। এ ঘটনা যেন চলমান কোভিড-১৯ মহামারির কথাই মনে করিয়ে দেয় আমাদের। তবে বাস্তবতা ছিল সত্যিই করুণ, বয়োবৃদ্ধদের পরিচর্যা করতে আসা নার্সরা তাদের গ্রাহকদের মাটিতে উল্টে থাকা অবস্থায় বা চেয়ারে বসে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। অনেক সময় পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙ্গে হতভাগ্যদের লাশ সরাতে হয়েছে বলে জানান ফ্রেঞ্চ অ্যাসোসিয়েশন অব ইমার্জেন্সি রুম ডক্টর্সের প্রেসিডেন্ট প্যাট্রিক পেলোউক্স।
ভয়াবহ ওই সময়কে স্মরণ করে তিনি বলেন, "লাশ আবিষ্কারের ঘটনাগুলো ছিল আতঙ্কজনক। পচাগলা অনেক লাশ মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর পাওয়া যায়।"
ওই বছরের তাপদাহে ফ্রান্সে মোট ১৫ হাজার মৃত্যু ঘটে। ইতালির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়, সেখানে মৃত্যু হয় ২০ হাজার জনের। আর পুরো ইউরোপে মারা যান মোট ৭০ হাজার জন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র নয়তো বয়োবৃদ্ধ ও একা বসবাসকারী ব্যক্তি। পরবর্তীতে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ২০০৩ সালকেই ইউরোপের ৫০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মকাল বলে চিহ্নিত করেন। এ ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলেও জানান তারা। খোদ রাজধানী প্যারিসে তাপদাহের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ৭৯ শতাংশ বেড়েছিল।
বৈশ্বিক উষ্ণতায় শুধু মানুষের সরাসরি মৃত্যু হচ্ছে তাই নয়, বরং এর ফলে সৃষ্ট অন্যান্য প্রভাবও বিপুল প্রাণহানি করছে প্রতিবছর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উষ্ণতার কারণেই দিনে দিনে আরও শক্তিশালী ও ধবংসাত্মক হয়ে উঠছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, বাড়ছে ঘন ঘন ঝড় সৃষ্টির ঘটনা। তার ওপর খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঘটনায় হুমকিতে পড়েছে পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলের কৃষিকাজ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনধারণ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। দাবানলে পুড়ে ছাই হচ্ছে একের পর এক অরণ্য।
গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে সূর্যের তাপ শোষণ করে ও মহাকাশে ফিরে যেতে বাধা দেয়। তাই গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধির সাথে সাথে তাপপ্রবাহের ঘটনা আরও দীর্ঘায়িত হবে, বাড়বে দিনের বেলায় উষ্ণতা। এমনকি গত ছয় বছরই ছিল তাপমাত্রা রেকর্ড শুরুর পর বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম সময়।
যেমন দক্ষিণ-পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে তিন ডিজিটের তাপমাত্রা এক শতাব্দী আগে যে সময়ে দেখা যেতো এখন দেখা দিচ্ছে তারও কয়েক সপ্তাহ আগে। থাকছেও আরও তিন সপ্তাহ বেশি সময় ধরে। ইউরোপে শুধু ২০০৩ সাল ব্যতিক্রম এক সময় ছিল না, বরং এরপর আরও পাঁচটি বড় আকারের তাপপ্রবাহের মুখে পড়েছে মহাদেশটি। ২০১৯ সালে ছয়টি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে স্মরণকালের রেকর্ড তাপমাত্রা দেখা দেয়, এ সময় ফ্রান্সে সর্বোচ্চ ১১৪.৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপ রেকর্ড করা হয়েছিল।
শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই ২১০০ সাল নাগাদ তাপজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বছরে এক লাখে উন্নীত হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, শুধুমাত্র ভারতে বার্ষিক ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর আভাস দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা হলো; প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর থেকে উন্নত দেশের জলবায়ু উদাসীনতার কারণে আজ আর সহজে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে চট করেই তাপ কমার আশা করা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে নিঃসরণ কমালেও আগামী কয়েক দশক জুড়ে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়বে। পরিবর্তনের এই দানব পৃথিবীতে জীবন ও জীবনধারণের সব সংজ্ঞাকেই বদলে দিতে চলেছে।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক