চীনা রান্নার বৈজ্ঞানিক কারিকুরি
সিনেমার পর্দায় বা রান্নার অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা বহুবার শেফের অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কড়াই নাড়ানোর কারিকুরি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। রান্নার বিশেষজ্ঞের অভাব না থাকলেও এই কলাকৌশল কিন্তু সহজে সবার আয়ত্তে আসে না। সাধারণভাবে সবার কাছে এই কৌশলটি 'টসিং' নামে পরিচিত।
আমাদের বেশিরভাগেরই ধারণা নেই যে, এর পেছনে একজন শেফের দীর্ঘদিনের সাধনা মিশে থাকে; জেনে আরও অবাক হবেন যে, এটির সাথে বিজ্ঞানও জড়িত।
চলুন আপনাদের নিয়ে যাওয়া যাক একটি রান্নাঘরে। যেখানকার শেফ রীতিমত খাবার টস করায় বিশেষজ্ঞ।
শেফ কোভাক কেয়ুং তুং এক হাত দিয়ে কড়াইয়ের খাবার নাড়াতে থাকেন, আর অন্য হাতে চলতে থাকে খুন্তি।
উভয় হাত যেহেতু বন্দী, তিনি তাই পায়ের সাহায্যে চুল্লীর লিভার টেনে আগুনের শিখা বাড়াতে-কমাতে থাকেন। অর্থাৎ এখানে তিনি রান্না এবং খাবারের তাপ নিয়ন্ত্রণ উভয়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। কখনো কখনো আগুন এসে কড়াইয়ের পুরো খাবার গ্রাস করে নেয়, কিন্তু কেয়ুং তুংয়ের হাতে থাকে পুরো নিয়ন্ত্রণ।
কাউন্টারে খাবার পরিবেশন করতে করতে তিনি জানান, একগাদা সাদা চালের ভাত সোনারঙা ফ্রায়েড রাইসে রূপান্তর করতে নাকি আদতে মাত্র তিন মিনিট লাগে!
বিস্ময়ে ভরা এই কারিকুরিকে বলা হয় 'ও'ক হেই'। যেকোন ক্যান্টনিজ রান্নায় এটি একটি অদৃশ্য অথচ অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান।
'দ্য চেয়ারম্যান' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড্যানি ইপ বলেন, "ও'ক হলো দক্ষিণ চীনের রান্নার নির্যাস। ক্যান্টোনিজ শেফরা আগুন এবং ও'ক নিয়ে খেলা করার একেকজন পন্ডিত"।
২০২১ সালে এশিয়ার শীর্ষ রেস্তোঁরার সম্মানে ভূষিত হয়েছে এই 'দ্য চেয়ারম্যান'। ২০১৯ সালে বিশ্বের ৫০টি সেরা রেস্তোঁরার তালিকাতেও এর স্থান শীর্ষে ছিল। (মহামারীর কারণে ২০২০ সালে কোন তালিকা তৈরি করা হয়নি)। 'হেই' (রোমান উচ্চারণে হে') হলো ক্যান্টনিজ শব্দ 'চি' এর প্রতিশব্দ যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়- শক্তির প্রবাহ।
যারা ক্যান্টনিজ পরিবারে বেড়ে ওঠেন তাদের জন্য কোন রেস্টুরেন্টে যাবার নির্ধারক এই ও'ক। খাবার খেতে বের হবার আগেই বাড়ির মুরুব্বিরা জানিয়ে দেবেন 'গও ও'ক হেই' (অর্থাৎ সে রেস্টুরেন্টে পর্যাপ্ত ও'ক হেই আছে) কিংবা 'এনজি গও ও'ক হেই' (যথেষ্ট ও'ক হেই নেই)। এ থেকেই যেকোন চীনা রেস্টুরেন্টের জনপ্রিয়তা নির্ণয় করা হয়।
১৯৯০ এর দশকে কিংবদন্তি আমেরিকান চীনা খাদ্যবিষয়ক লেখক গ্রেস ইয়ং তার "দ্য উইজডম অফ দ্য চাইনিজ কিচেন: ক্লাসিক ফ্যামিলি রেসিপিজ ফর সেলিব্রেশন অ্যান্ড হিলিং" গ্রন্থটির মাধ্যমে 'ও'ক হেই' প্রত্যয়ের সাথে আন্তর্জাতিকভাবে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি তার লেখনীতে একে প্রকাশ করেছিলেন 'দ্য ব্রিদ অব ও'ক' হিসেবে।
ইয়ং তার গ্রন্থতে লেখেন, 'ও'ক হেই কোন মজাদার গরম খাবার নয়, বরং এটি সেই মজার স্বাদ ও নির্যাস যা কেবল এক বা দুই মিনিটের জন্য অনুভব করা যায়'।
অন্য কথায়, এটা একটি সংমিশ্রণ। খাবারের বাষ্পীয় সুগন্ধ আপনি প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করছেন এবং একই সময়ে আপনার জিভে একটি জ্বলন্ত সংবেদন তৈরী হচ্ছে-এটি সেই সংমিশ্রণ।
রান্নায় যেভাবে ও'ক-এর প্রভাব বোঝা যায়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, খাদ্য গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা চীনা রান্না নিয়ে যেমন নতুন করে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন, তেমনি ও'ক হেই নিয়েও তাদের আগ্রহের শেষ ছিল না।
জর্জিয়ার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ডক্টরাল শিক্ষার্থী হাং-টাং কো, আইজি (ব্যাঙ্গাত্মক) নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী ডেভিড হু'র সাথে চীনা খাবারের এই টসিং কৌশলের ওপর একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। শিরোনাম- ফ্রায়েড রাইস নাড়ানোর পদার্থবিদ্যা বা 'দ্য ফিজিকস অফ টসিং ফ্রায়েড রাইস'।
কেন শেফরা ফ্রায়েড রাইস রান্নার সময় টস করতে ও'ক ব্যবহার করেন, তা নিয়ে হাং-টাং কো মাসের পর গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, "ও'ক হেই এবং মেইলার্ড প্রতিক্রিয়ার জন্য উচ্চমাত্রার তাপ প্রয়োজন। আর বাণিজ্যিক চীনা চুলাগুলো হতে প্রচুর পরিমাণে তাপ উদগীরণ হয়"।
এখন এই মেইলার্ড প্রতিক্রিয়া আবার কী! এটিও আরেকটি কৌশল।
মেইলার্ড প্রতিক্রিয়া হল অ্যামিনো অ্যাসিড এবং শর্করা হ্রাস করার মধ্যে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া যা উচ্চ তাপে সংঘটিত হয়। এটি খাবারকে বাদামী রঙ এনে দেয় এবং সুগন্ধ ও স্বাদ বাড়িয়ে তোলে।
কিন্তু এত দ্রুত নাড়িয়ে রান্না করার পেছনে তাৎপর্যটা কী? অন্যান্য দেশের রান্নায়ও চাইনিজ বিভিন্ন পদ তৈরী করা হয়। কই তারা তো কেউ এত তাড়াহুড়োর মধ্যে রান্না করে না!
'দ্য চেয়ারম্যান' রেস্টুরেন্টের ড্যানি ইপ বলেন, "স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সর্বাধিক ও'ক হেই নিষ্কাশন করা হয়। এটাই এ রান্নার বিশেষত্ব। মেইলার্ড প্রতিক্রিয়ার ফলে রান্নায় যে নির্যাসটুকু নিঃসরিত হয়, সেটি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। খাবারে সেটি যেন সর্বোচ্চ মাত্রায় উপস্থিত থাকে সেজন্যই এত দ্রুত নাড়তে থাকতে হয়"।
আগুন আর অন্যান্য উপকরণের পাশাপাশি রন্ধনশিল্পীর নিজের টসিংয়ের ভেলকিও ও'ক হেই এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
টসিং সাধনার ব্যাপার!
ক্রিকেটে খেলা শুরুর আগে যে টস হয়, সেটি নিছকই ভাগ্যের ব্যাপার, সেখানে কোন কলাকৌশল থাকে না। কিন্তু রান্নার সময় টস করাটা একদিনের কর্ম নয়, এর জন্য দিতে হয় শ্রম, লাগে দীর্ঘ অনুশীলন।
দ্য চেয়ারম্যান রেস্তোঁরার নব্য নিযুক্ত শেফদের গ্রাহকের সামনে খাবার পরিবেশনের আগে অন্তত এক বছর ও'ক হেই এর অনুশীলন করতে হয়।
কেন শুধু চীনা শেফরাই? অন্য দেশের রান্নায় টস করার এই সুনিপুণ প্রতিভা দেখা যায় না কেন!
মজার ছলে ইয়েপ বলেন, "আসলে ক্যান্টোনিজ রান্নায় ব্যবহৃত পাত্র অত্যন্ত ভারী এবং যেকোন সময় নিয়ন্ত্রণ হারালে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখন নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন, চীনা শেফদের হাতে কেন কোন পশম দেখা যায় না"!
যারা চায়নিজ রান্নার সাধারণ জ্ঞান রাখেন, তারা মাত্রই জানেন যে, এ ধরনের খাবার সব সময় উচ্চ তাপে রাঁধতে হয়। এটিও দ্রুত নাড়ার অন্যতম কারণ।
"ও'ক প্রক্রিয়ায় টসিংয়ের ফলে খাদ্যের উপাদানগুলো ভালভাবে মেশার সুযোগ পায়, আর উচ্চ তাপে এটাই জরুরি। কারণ, আপনি যদি অতিরিক্ত তাপমাত্রা বজায় রেখে রান্নার সময় শুধু হালকাভাবে নেড়ে যান, তাহলে খাবার পুড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে", বলেন কো।
তাছাড়া গবেষণার মধ্য দিয়ে কো বুঝতে পেরেছেন যে, শক্তি বাঁচাতে এবং গতি বাড়ানোর জন্য শেফরা প্রায়শই চুল্লির কিনারা ব্যবহার করে থাকেন।
প্রতিবার টসিংয়ের সময় একসাথে দুটি গতি কাজ করে, 'সামনে-পিছনে ঠেলা এবং টানা' এবং 'উপরে-নিচে ঘড়ির কাঁটার মত ও'ককে ঘুরানো'। অনেকটা শিশুদের সী-স খেলার মত।
কো বলেন, "আপনাকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে যে, অভুতপূর্ব গতিতে আপনি রান্নার প্রতিটি উপাদানে সমপরিমাণ তাপের প্রবাহ নিশ্চিত করছেন"।
তার গবেষণাটিতে উঠে এসেছে, শেফরা গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ২ দশমিক ৭ বার টস করে থাকেন। অনেক চায়নিজ শেফদের যে পেশির ব্যথায় ভুগতে দেখা যায়, তার কারণও এটিই।
কো এর এই গবেষণার উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী। তার আশা, একদিন এমন কোন রোবট তৈরী হবে যা শেফদের হয়ে রান্নার সময় টসিংয়ে সাহায্য করবে এবং তাদের পেশীর ব্যথা কমাবে।
- সিএনএন অবলম্বনে