চে গুয়েভারার জন্মস্থান এখন কেনা যাবে
বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী নেতা চে গুয়েভারা আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের একটি ভবনের যে অ্যাপার্টমেন্টে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেটি বিক্রির জন্য তোলা হয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিও-ক্ল্যাসিকাল ঘরানার ওই ভবনের ২ হাজার ৫৮০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টটি ফ্র্যান্সিসকো ফাররুজ্ঞিয়া নামে এক ব্যক্তি ২০০২ সালে কিনেছিলেন।
ওই ব্যক্তি জানান, অ্যাপার্টমেন্টটিকে তিনি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে নানা বাস্তবতায় সেটি আর রূপ দিতে পারেননি।
তবে এই এপার্টমেন্টের জন্য তিনি কতো টাকা দাম নির্ধারণ করেছেন তা জানাননি বিবিসিকে।
বছরের পর বছর রোজারিও শহরের উরকুইজা এবং এন্ত্রে রিওস স্ট্রিটের এই ভবনটি বহু বিখ্যাত ব্যক্তির পদচারণায় মুখরিত হয়েছে।
এদের মধ্যে যেমন ছিলেন উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে পেপে মুজিকা তেমনি এই ভবনটি দেখতে আসেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদের কাস্ত্রোর সন্তানরাও। আবার এখানে ঘুরতে আসেন পঞ্চাশের দশকে তরুণ চে যখন মোটরসাইকেলে করে দক্ষিণ আমেরিকার ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁর সেসময়কার ভ্রমণসঙ্গী আলবার্তো গ্রানাদোস।
১৯২৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে জন্ম হয় চে গুয়েভারার। তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব।
তার প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না। তবে সারাবিশ্বে তিনি লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত।
তরুণ বয়সেই ডাক্তারির ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এসময় এসব অঞ্চলের দারিদ্র্য তার মনে গভীর রেখাপাত করে। এই ভ্রমণকালে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান হল বিপ্লব।
এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা আরও বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন তারা। দ্রুততম সময়েই বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন চে গুয়েভারা। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তার পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চে।
কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচার। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান; ফলত এই বাহিনী পিগস উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
চে ছিলেন একজন লেখক। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আমেরিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তার অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তার বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভিয়ান সেনার হাতে বন্দী ও নিহত হন চে।