‘মোটরসাইকেল ডায়েরিস’: বিপ্লবী চে গুয়েভারার চোখ খুলে দিয়েছিল যে ভ্রমণ
'এল চে' নামে মার্কসবাদী বিপ্লবী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা ছিলেন আর্জেন্টিনার একটি মেডিকেল স্কুলের শিক্ষার্থী, তবে পড়াশোনায় মন ছিল না তার। চেয়েছিলেন বিশ্বটাকে ঘুরে দেখতে।
১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি ২৩ বছর বয়সী গুয়েভারা এবং তার বন্ধু আলবের্তো গ্রানাদা চেপে বসেন একটি পুরনো মোটরসাইকেলে। শুরু করেন দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে আট মাসের যাত্রা।
তাদের এ ভ্রমণ নিয়ে ২০০৪ সালে ব্রাজিলিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা ওয়াল্টার স্যালেস নির্মাণ করেন 'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিস'।
সিনেমায় দেখা যায়, দক্ষিণ আমেরিকার সে যাত্রায় অর্থকষ্টসহ বেশকিছু কঠিন অভিজ্ঞতা হয় গুয়েভারা ও গ্রানাদার। ইতিহাসবিদ এবং জীবনীকাররা এ বিষয়ে একমত যে, এই অভিজ্ঞতা চে গুয়েভারার উপর গভীর প্রভাব ফেলে; যিনি পরবর্তীতে সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত গেরিলা নেতাদের একজন হয়ে ওঠেন।
আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের ইউনিভার্সিডাড ন্যাসিওনাল দো লানুস-এর ইতিহাসের অধ্যাপক কার্লোস এম ভিলাস বলেছেন, 'অর্থকষ্ট, শোষণ, অসুস্থতা এবং দুর্ভোগের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে চে গুয়েভারার, সেটির সাথে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক জাগরণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।'
একজন ভ্রমণপিপাসু
বুয়েনস আইরেসে ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন গুয়েভেরা, বেড়ে ওঠেন উচ্চ-মধ্যবিত্ত এক পরিবারে।
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নর্থ আমেরিকান কংগ্রেস অন ল্যাটিন আমেরিকার সম্পাদক মার্শাল বেক বলেছেন, 'যদিও গুয়েভারার পরিবারে রাজনৈতিক গোঁড়ামি ছিল না, তবে তার পরিবারে প্রতিবাদী স্বাধীনতার চেতনা ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়।'
মেডিকেল স্কুলে গড়পড়তা শিক্ষার্থী ছিলেন গুয়েভেরা। তার গ্রেডও তেমন একটা ভালো ছিল না। ক্যাম্পাসে বামপন্থী দলগুলো থেকে দূরেই থাকতেন তিনি, রাজনীতিতে ছিল না তেমন আগ্রহ।
গুয়েভারা সবসময়ই চেয়েছেন ভ্রমণ করতে। ১৯৪৯ সালে তিনি একাই বাইসাইকেলে পুরো আর্জেন্টিনা ভ্রমণ শুরু করেন। চে গুয়েভারাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন আলবের্তো গ্রানাদা। আর্জেন্টিনার কর্দোবা প্রদেশের একটি কুষ্ঠরোগ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন তিনি। গ্রানাদা যখন গুয়েভারাকে তার সাথে মোটরসাইকেলে করে উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের প্রস্তাব দেন, তখন সাথেসাথেই এতে রাজি হয়ে যান তরুণ গুয়েভারা। এ ভ্রমণে যাওয়ার অর্থ হলো তার মেডিকেল স্কুলের পড়াশোনা স্থগিত রাখা।
১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি তারা নর্টনের ৫০০ সিসির মোটরবাইক লা পোদেরোসা ২-এ করে শুরু করেন যাত্রা। বাইকটি ছিল গ্রানাদার। কর্দোবায় গ্রানাদার বাড়ি থেকে যাত্রা শুরুর পরপরই একটি স্ট্রিটকারের সাথে সংঘর্ষ হতে যাচ্ছিলো তাদের মোটরবাইকের।
প্রথম স্টপ: মিরামার
মিরামার নামক একটি ছোট রিসোর্টে গুয়েভারার বান্ধবী চিচিনা তার পরিবারের সাথে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। এখানে দুদিন থাকার কথা থাকলেও তারা এই রিসোর্টে ছিলেন আট দিন। গুয়েভারাকে চিচিনা ১৫ মার্কিন ডলার ধার দিয়েছিলেন, বলেছিলেন আমেরিকা থেকে তার জন্য একটি সুইমসুট কিনে আনতে। গুয়েভারা তার কাছে শপথ করে বলেছিলেন, তিনি প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবেন, কিন্তু এ ডলার অন্য কোথাও ব্যয় করবেন না।
গুয়েভারা-গ্রানাদা ১৪ ফেব্রুয়ারি চিলিতে পাড়ি জমান। এক পর্যায়ে তারা একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে নিজেদের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। সংবাদপত্রের সে আর্টিকেল দিয়ে যাত্রাপথে স্থানীয়দের থেকে খাবারসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়েছিলেন।
এ ভ্রমণে বেশকিছু ঝামেলার মধ্যেও পড়েন তারা। লতারো শহরে একটা দুর্ঘটনায় পড়েন তারা। এরপর মোটরসাইকেল মেরামত করতে গেলে গুয়েভারা-গ্রানাদা নাচের আমন্ত্রণ পান। তবে এর শেষটা ভালো যায়নি। এক বিবাহিত নারীকে প্রলুব্ধ করতে গিয়ে ধরা পড়েন গুয়েভারা। পরে বিক্ষুব্ধ জনতার ধাওয়া খেয়ে শহর ছেড়েই পালিয়ে যেতে হয় তাদেরকে।
চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে মোটরসাইকেলটি একেবারেই বিকল হয়ে যায়। এরপর পায়ে হেঁটেই যাত্রা করেন তারা।
গুয়েভারার রাজনৈতিক চেতনা আলোড়িত হতে শুরু করে যখন তারা চুকিকামাতা তামার খনি পরিদর্শন করেন। বিশ্বের বৃহত্তম ওপেন-পিট খনি এবং চিলির সম্পদের প্রাথমিক উৎস ছিল এটি। একচেটিয়া মার্কিন ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত এ খনি ছিল মার্কিন আধিপত্যের একটি জ্যান্ত প্রতীক।
খনিতে কাজের সন্ধানে আসা এক গৃহহীন কমিউনিস্ট দম্পতির সাথে দেখা হয় গুয়েভারার। এ অভিজ্ঞতাও তাকে বেশ প্রভাবিত করে।
গুয়েভারা তার ডায়েরিতে লিখেছেন, 'একটিমাত্র মোমবাতির আলোয়... ওই দুই শ্রমিকের থেকে রহস্যময় ও করুণ আভা ছড়াচ্ছিল...মরুভূমিতে রাতে হিমায়িত হয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করে থাকা ওই দম্পতি ছিলেন বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের সর্বহারা (প্রলেতারিয়েত) শ্রেণীর এক জীবন্ত উদাহরণ।'
বদলে যাওয়া এক মানুষ
পেরুতে গুয়েভারা পুরানো ইনকা সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভারতীয় এবং পশুদের সাথে ট্রাকে চড়ে তিনি আদিবাসীদের সাথে ভ্রাতৃত্ব অনুভব করেন।
রাজধানী লিমাতে তারা শীর্ষ কুষ্ঠ গবেষক, মার্কসবাদী হুগো পেসকে দেখতে গিয়েছিলেন। এসময় তারা রাজনৈতিক আলাপচারিতা শুরু করেন। এক দশক পরে গুয়েভারা তার প্রথম বই `গেরিলা ওয়ারফেয়ার' এর একটি কপি হুগো পেসকে পাঠান এবং তার নিজের জীবনে এই চিকিৎসকের প্রভাবের কথা স্বীকার করেন।
লিমা থেকে গুয়েভারা এবং গ্রানাদা যান আমাজন রেইন ফরেস্টে ভ্রমণে। তারা গভীর জঙ্গলের কুষ্ঠরোগী চিকিৎসা কেন্দ্র সান পাবলোতে তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। যেখানে তারা কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা দেন।
নিজের ২৪ জন্মদিনে চিকিৎসক ও নার্সদের সামনে গুয়েভারা তার প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ দেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ লাতিন আমেরিকার প্রত্যাশার কথা বলেন।
গুয়েভারা বলেন, এই সফরের পরে আমরা আগের চেয়ে আরো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, অলীক এবং অনিশ্চিত জাতীয়তার ভিত্তিতে লাতিন আমেরিকার বিভাজন সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
পরে গুয়েভারা ও গ্রানাদা কলম্বিয়া এবং ভেনিজুয়েলায় ভ্রমণ করেন। যেখানে গ্রানাডা একটি কুষ্ঠুরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রে কাজ পেয়ে যান। আর গুয়েভারা মিয়ামি হয়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে যান। বিমানের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় তাকে ২০ দিন মিয়ামিতে কাটাতে হয়েছিল।
ততদিনে গুয়েভারা বদলে যাওয়া এক মানুষ।