৮০ বছর বয়সে মারা গেলেন চে'র হত্যাকারী তেরান
বলিভিয়ার লা-হিগুয়েরা শহর। সময়টা ১৯৬৭ সালের অক্টোবরের ৯ তারিখ। দুপুর একটার খানিক পরে একটি মাটির ঘরে প্রবেশ করলেন বলিভিয়ান সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট মারিও তেরান। তার হাতে একটি এম-২ কারবাইন।
পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ঘরের ভেতর থাকা আর্নেস্তো 'চে' গুয়েভারার দিকে সে কারবাইন তাক করলেন তেরান। অবশ্য তখন তার হাত কাঁপছিল। এর আগের দিন গুয়েভারাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রথম গুলিটি চালান তেরান। আহত হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়েন ৩৯ বছর বয়সী বিপ্লবী চে গুয়েভারা। সে অবস্থায় সরাসরি তেরানের চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, 'নিজেকে শান্ত করুন। আর ভালোভাবে লক্ষ্য ঠিক করুন। আপনি একটা মানুষকে মারতে যাচ্ছেন।'
সেদিন চে-এর শরীরে একাধিক গুলি চালিয়েছিলেন মারিও তেরান। হাতেপায়ে অনেকবার গুলি করা হয় চে-কে। কিউবান আমেরিকান সিআইএ এজেন্ট ফেলিক্স রদ্রিগেজের হুকুম তামিল করছিলেন মারিও তেরান। রদ্রিগেজ চেয়েছিলেন, চে যুদ্ধে মারা গেছে এমনটা চাউর করতে হবে। সেজন্য তার আদেশ অনুযায়ী, চে-এর শরীরে একাধিক গুলি করেন তেরান।
গত ১০ মার্চ ৮০ বছর বয়সে মারা যান মারিও তেরান। বলিভিয়ার সান্তা ক্রুজ-এর একটি হাসপাতালে কোনো অজানা রোগে ভুগে তিনি মারা গেছেন।
সেসময় তেরানের ঊর্ধ্বতন অফিসার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল গ্যারি প্রাডো। তার নেতৃত্বেই চেকে আটক করা হয়।
চেকে খুঁজে বের করার জন্য বলিভিয়ার সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিলেন সিআইএ এজেন্ট রদ্রিগেজ। পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি এবং সিআইএ চেয়েছিল গুয়েভারাকে জীবিত রাখতে; কিন্তু বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে ব্যারিয়েন্তোস ও বলিভিয়ান সেনাবাহিনীর হাই-কমান্ডই গুয়েভারার নিয়তির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
রদ্রিগেজকে বলা হয়েছিল, চে-এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে। তিনি প্রত্যাখান করলে, তখন মারিও তেরানের কাঁধে এ দায়িত্ব পড়ে। এর আগে চে ও তার দলের সদস্যদের সাথে এক বন্দুকযুদ্ধে একাধিক সহযোদ্ধা হারিয়েছিলেন তেরান। স্প্যানিশ পত্রিকা এল পাইস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রদ্রিগেজ জানিয়েছিলেন, মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার পর স্যুভেনির হিসেবে চে-এর পাইপটি তেরানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি।
তেরান আমার কাছে এসে বলেছিলেন, 'ক্যাপ্টেন, ওই পাইপটা আমার চাই। আমি তাকে মেরেছি, তাই এটা আমারই প্রাপ্য।' তার সাথে ভালো আচরণ করা কোনো বলিভিয়ান সেনাকে পাইপটি দেওয়ার জন্য রদ্রিগেজের কাছে অনুরোধ করেছিলেন গুয়েভারা। কিন্তু চে তার দেশের প্রতি যা করেছে, সেকথা মনে করে, তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে আগ্রহ দেখাননি রদ্রিগেজ।
গুয়েভারার মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে কিংবদন্তি থেমে যায়নি। যদিও অনেকে বিশেষত, কিউবান-আমেরিকানেরা গুয়েভারার লাশ দেখে খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগের কাছেই চে-এর মৃত্যুর খবর ধাক্কা হিসেবেই লেগেছিল। বিশেষত, মানুষ যখন জানতে পেরেছিল চে-এর বন্দী হওয়া ও মৃত্যুর পেছনে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা- সিআইএ'র হাত ছিল, তখন অনেকে তা সহজভাবে নিতে পারেননি।
মৃত্যুর পর পুরো বিশ্বের কাছে গুয়েভারা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠেন। চে-র মুখ আজও তরুণ-তরুণীদের টিশার্টে দেখা যায়। অন্যদিকে মারিও তেরান চেয়েছিলেন বিস্মরণের অতলে হারিয়ে যেতে।
নিজের নাম পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন তেরান। পরে যখন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল মুন্ডো তাকে খুঁজে বের করে, তখন তিনি দাবি করেছিলেন তিনি অভীষ্ট তেরান নন, বলিভিয়ায় একই নামে অনেক তেরান আছেন।
মারিও তেরান সালাজার বলিভিয়ার কোশাবাম্বায় ১৯৪১ সালে ৯ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মিলিটারি একাডেমি থেকে বলিভিয়ার সেনাবাহিনীতে যান তিন। ছিলেন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স রেজিমেন্টের সদস্য।
তাকে 'বীরপুরুষ' হিসেবে অভিহিত করেছেন তার সাবেক কমান্ডার প্রাডো। প্রাডো জানান, গণমাধ্যমের তাকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ পছন্দ করেননি তেরান। তেরান একজন সেনা সদস্য হিসেবে কেবল তার আদেশ পালন করেছিলেন বলেই মন্তব্য করেন জেনারেল প্রাডো।
মারিও তেরানের দুই সন্তান ও স্ত্রী জুলিয়া পেরাল্টা বেঁচে আছেন। গণমাধ্যমেরর কাছে ওইদিনটি নিয়ে তাকে কখনো বেশি কথা বলতে দেখা যায়নি। তবে বলিভিয়ান সাংবাদিকদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তেরান বলেছিলেন, 'এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন। চে আমার চোখের সামনে বিশাল হয়ে ফুটে উঠেছিলেন সেদিন। তিনি আমার দিকে তাকানোর পর আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠছিল।'
পরে যখন চে তাকে মাথা ঠাণ্ডা করে গুলি করতে বলেছিলেন, তখন তেরান দরজার দিকে এক পা পিছিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে গুলি চালিয়েছিলেন।
- তথ্যসূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, ও এল পাইস